ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারী এগোচ্ছে বেগম রোকেয়ার দেখানো পথে

ফোর ফাইভ পর্যন্ত পড়ে স্বামীর আসবাবপত্র দেখভাল করা নয়

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

ফোর ফাইভ পর্যন্ত পড়ে স্বামীর আসবাবপত্র দেখভাল করা নয়

মোরসালিন মিজান ॥ কত যে ঘেউ ঘেউ। পেছন থেকে নারীর পা কামড়ে ধরে রাখা। পশ্চাৎপদ, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই অপকর্মে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। চোখ রাঙিয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতাও। তবে নারীকে সবচেয়ে কুৎসিত আক্রমণ করেছে মৌলবাদীরা। প্রাচীন/পুরনো নারীবিদ্বেষ এখনও ধরে রেখেছে তারা। হেফাজত নামক সংগঠনটির সেই নেতার কথাই ধরা যাক। এই কিছুদিন আগে নারীদের উপদেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাইকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল কইরবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ শিশুদের যত্ন কইরবা। এই হইলো তোমাদের কাজ। তোমাদের কেন বাইরে যেতে হবে?’ নারীদের স্কুল-কলেজে পাঠানোর বিরোধিতায় সরব হয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারই মেয়ে স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। আরে, ক্লাস ফোর ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করান। বিবাহ-শাদি দিলে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব কইরতে পারে মতো, অতটুকু দরকার। বেশি বেশি আপনার মেয়েকে আইজকে স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতেছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পরে আপনার মেয়ে স্বামী একটা নিজে নিজে ধরি নিবে, লাভ ম্যারেজ, কোর্ট ম্যারেজ করি ছলি যাবে।’ তার বক্তব্য : ‘মহিলাদের ক্লাসের সামনে বসানো হয় কলেজে, ভার্সিটিতে, পুরুষরা কি লেখাপড়া কইরতেছে? মহিলা তেঁতুলের মতো, তেঁতুলের মতো, তেঁতুলের মতো। মার্কেটে যেখানে তেঁতুল বিক্রি করে ওদিকে যদি আপনে যান, আপনার মুখ থেকে লালা বাইর হয়। মহিলা তার থেকেও বেশি খারাপ!’ শফি বলেন, ‘দিনেরাত্রে মহিলাদের সাথে পড়ালেখা করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। রাস্তাঘাটে হাঁটাহুটা করতেছেন, হ্যান্ডশেক কইরা কইরা, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। যতোই বুজুর্গ হোক না কেন, এই মহিলাকে দেখলে, মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করলে আপনার দিলের মধ্যে কুখেয়াল আইসা যাবে।’ পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীকর্মীদের/অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে চাকরি করার জন্য? চাকরি তো অনেক করতেছেন। আপনার বিবিও ইশকুলে লেখাপড়া করায় ডাক্তার হইছেন। আপনেও ডাক্তার, আপনার মেয়েরাও ইশকুলে চাকরি করে গার্মেন্টসে চাকরি করে। সবাই টাকা-পয়সা অর্জন করতেছেন, তবু কুলাইতেছে না, কুলাইতেছে না।’ শফি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘গার্মেন্টসে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে সাত/আটটা বাজে চলে যায়, রাত ৮টা, ১০টা, ১২টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করতেসে তুমি তো জানো না। কতোজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না। জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?’ আরও অনেকে অনেকভাবে নারীকে অপদস্ত করতে চেয়েছে। চাওয়াটি এখনও অব্যাহত। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা আহমদ শফীদের বক্তব্য কানে তুলেননি একদমই। কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। তাদের সামনে আদর্শ হয়ে আছেন বেগম রোকেয়া। মহীয়সী নারীর উত্তরসূরি হিসেবেই এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। বাধা যত বড় হচ্ছে ততোধিক বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে নারীর সাফল্য। সবচেয়ে বড় প্রমাণ, বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের প্রধানমন্ত্রী। বহু বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। বর্তমানে সরকার পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাও একজন নারী। এমনকি জাতীয় সংসদের সবচেয়ে উপরের যে আসনটি, সেখানে একজন নারী বসে আছেন। তৃণমূলেও নারীর ক্ষমতায়ন চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বহু নারী নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছেন নিয়মিতভাবে। ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। অদ্ভুত সে নিষেধ উপেক্ষা করে নারীরা দিনরাত বাইরে বের হচ্ছেন। কাজ করছেন। চাকরি, ব্যবসা কোথায় নেই তারা? নারী এখন সচিব। নারীরা ডিসি, ইউএনও। সেনাবাহিনীতে, বিমান বাহিনীতে পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশে তো আছেনই। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীর ভূমিকায়ও সফল তারা। দেশের যেকোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের আশপাশে তাকালে নারীর অগ্রগতির ছবিটি স্পষ্ট দেখা যায়। বিদেশেও শক্ত অবস্থানে বাংলাদেশের নারী। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিবিধ সংস্থা ও দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। নারীর আয়/রোজগারে মৌলবাদীরা অখুশি হলেও, এমন নারীর সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের একটি জরিপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, পরিবারের কর্ত্রী হিসেবে অধিক সংখ্যায় সামনে আসছেন নারীরা। প্রতি ১০০টি পরিবারের মধ্যে ১৪টি পরিবারের প্রধানই নারী। ১০ বছর আগে নারীপ্রধান পরিবারের হার ছিল শতকরা ১০.৩ ভাগ। ২০১৩ সালে হেফাজত নেতা নারীদের বিরোধিতা করে নসিহত করেন। সে বছর থেকেই এ হার বাড়তে থাকে। জরিপ অনুযায়ী, অল্প বয়সী মেয়েরাও হাল ধরছেন পরিবারের। বয়স ১৫ বছরের কম এমন নারী শতকরা ২১.৬ ভাগ পরিবারের কর্ত্রী। ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ১৩.৪ ভাগ পরিবারের প্রধান নারী। শতকরা ১৪ ভাগ পরিবারে অবিবাহিত নারী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর যে গার্মেন্টস কর্মীদের অসম্মান করে ওয়াজ করা হয়েছিল সেই নারীদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। বর্তমানে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করছে প্রায় ৪০ লাখ নারী। এসব নারী যখন দলবেঁধে কাজে বের হন তখন মনে হয় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিরাট মিছিল বের হয়েছে। নারীরা স্কুলে, কলেজে যেতে পারবে না। বিচিত্র যুক্তি। সেসব যুক্তি তুড়ি মেরে প্রতিনিয়ত ওড়াচ্ছে মেয়েরা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় মেয়েদের উপস্থিতি ছেলেদের প্রায় সমান। এসএসসি, এইচএসসির ফলে তো মেয়েরা প্রায়শই ছেলেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠেও সে কী দাপট এখন নারীর! বিভিন্ন খেলায় অংশ গ্রহণ করে দেশকে গৌরবান্বিত করছেন তারা। আহমদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠিয়ে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করতে বলেছিলেন। আর্চারিতে বাংলাদেশের জন্য তিনবার স্বর্ণপদক জেতা ইতি বেগমেরও বালিকা বয়সে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সে বিয়ে নিজেই সে রুখে দিয়েছিল। তার তীর-ধনুক পছন্দ। লেখাপড়া আর তীর-ধনুক নিয়ে থাকা মেয়েটি এখন দেশের খ্যাতিমান তারকা খেলোয়াড়! ক্রিকেট, ফুটবলসহ অন্যান্য খেলায়ও নারীরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করছে। এভাবে সব ক্ষেত্রেই নারীর জয় জয়কার। কেন হবে না? ১৯৭১ সালে এ দেশের নারীরা তো অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে। তারও আগে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। এই নারীদের প্রজন্মকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে ঘরে আটকে রাখা অসম্ভব। শফীদের নয়, বেগম রোকেয়ার দেখানো পথে এগিয়ে চলেছে বাংলার নারী। আগামী দিনেও চলবে। এ সত্য ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা যত দ্রুত স্বীকার করে নেবেন ততই মঙ্গল। কবে স্বীকার করবেন?
×