ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার ক্ষতি পূরণ করতে হবে শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

শিক্ষার ক্ষতি পূরণ করতে হবে শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। মৃত্যু, আক্রান্ত ও সুস্থ হওয়ার হার ওঠানামা করলেও স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৫তম। যেভাবে করোনাভীতি জয় করে আমরা মাঠে-ময়দানে অলিতে-গলিতে অবাধে বিচরণ করছি, তাতে পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সংক্রমণ বাড়লেও আশার আলো দেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত সুস্থতার হার। তীব্র প্রতিকূল অবস্থায় সময় কাটাচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক, দাখিল, উচ্চমাধ্যমিক, আলিম ও উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী। তাদের অধিকাংশই ঘরে বসেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও কলকারখানা, অফিস-আদালত, হাটবাজার, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, ফুটপাথ, রেস্টুরেন্ট, পার্ক, নূরানি মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা, মসজিদসহ সব খোলা। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গণপরিবহন, লঞ্চ, ট্রেনও এখন স্বাভাবিক। অর্থনীতির চাকাও স্বাভাবিক। শুধু চালু হয়নি স্কুল-কলেজ-আলিয়া মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। কওমী ও নূরানি মাদ্রাসা ছাড়া ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ভোগ করবে, সে ঘোষণা ইতোমধ্যে স্পস্ট। একদেশে দুই নীতি মঙ্গলজনক কিনা, তা ভাবনার বিষয়। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসা বন্ধ হলে কিংবা গার্মেন্টস, শিল্প-কল কারখানা বন্ধ হলে তার ক্ষতি সহজেই লক্ষণীয় এবং তা পরিমাপও করা যায়। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে গোটা জাতির যে শিকড় নষ্ট হয়, সে অপূরণীয় ক্ষতি চোখে দেখা না গেলেও তা যে অতি ভয়ঙ্কর সেটি মানতে হবে। ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্য়ক্রম চলছে। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারী ও বাকি সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০-৭০%। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও অনলাইন ক্লাস চলছে। তবে অনভ্যস্ত এই ক্লাসের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ অনেক কম। মনে রাখতে হবে, আজকের শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকেই মেধাবীরা কিছুকাল পরেই শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবে। তাদের ভিত্তি যদি অটোপ্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার মাধ্যমে হয় কিংবা লোক দেখানো সমাধানের ভিত্তিতে হয়, তাহলে জাতির ভিত্তি কখনোই শক্ত হতে পারবে না নিশ্চিত। তাই শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়েই জাতিকে সঠিক শিক্ষা দানই হবে উপযুক্ত সমাধান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। তা ঠিক আছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাদ দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভীতিকর, প্রাণহীন পাবলিক পরীক্ষার চিন্তা করলেই হবে না, বরং অভিজ্ঞ শিক্ষক-লী, উপযোগী যোগ্য শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করে আনন্দময় সঠিক বিদ্যার্জনকেই প্রধান্য দেয়া অতিব জরুরী বোধ করি। বিদ্যাশিক্ষায় শর্টকাট পথ বলে কিছু নেই। এটি বিদ্যার্জনে প্রধান বাধাও বটে। অনলাইনে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্লাস নিচ্ছে, এটি খারাপ নয়। কিন্তু নতুন ধারার অনভ্যস্ত এই নীতি শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। অন্যদিকে প্রযুক্তির প্রভাব এখনও গ্রামে তেমন পৌঁছেনি। অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থীর ঘরে টেলিভিশন, স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সুবিধা নেই। সকলের সুবিধা নিশ্চিত না করে ন্যূনতম দৃশ্যমান অঞ্চলে এই সুবিধা থাকলেও সেটি বিবেচনায় পরীক্ষা নেয়া নিতান্তই বোকামি। তাই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে সিলেবাস শেষ করাই যুক্তিসঙ্গত। সঙ্গে সঙ্গে বাতিলকৃত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী (ইইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার সময়ও ঠিক করে নেয়াই যুক্তিসঙ্গত। সময় নষ্ট হোক, কিন্তু বিদ্যার্জন ও মূল্যায়নের পথটা মসৃণ হওয়া অতিব জরুরী। সম্প্রতি এক পলিসি ব্রিফের মাধ্যমে ইউনেস্কো জানিয়েছে, ‘করোনার কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।’ (বণিক বার্তা, ২৪ আগস্ট)। বিদ্যাশিক্ষায় শর্টকাট পথ একটি অভিশাপ। অনভ্যস্ত দূরশিক্ষণ পদ্ধতি, অনলাইন পাঠদান, অনলাইনে, রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সামান্য উপকার আনলেও শ্রেণীকক্ষ নির্ভর শিক্ষার কাছে তা কিছুই নয়। দেশের অর্ধেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর বাড়িতে যেখানে টিভিই নেই, ইন্টারনেট সংযোগ সেখানে অকল্পনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেছেন, এই মহামারী বিদায় করতে বিশ্ববাসীর আরও দুই বছর লাগতে পারে। এদিকে করোনা জয় করতে না পারলেও আমরা করোনা ভীতি জয় করেছি ঠিকই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, করোনার ভ্যাকসিন দরকারই হবে না, তার আগেই এই মহামারী বিদায় নেবে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিস্থিতি এখনও আসেনি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে কি না, সে বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত চলছেই। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের একদিকে যেমনি মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খুলে দিলে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হবে কি না, সেই শঙ্কাও কাজ করছে সরকারের মাঝে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খোলার বিষয়ে সরকার এখনও সিদ্ধান্ত দেয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ আকরাম হোসেন জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে নানা মত থাকলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সরকার এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ওই সময় ১৯৪২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত সকল বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। লাইব্রেরি তালাবদ্ধ হয়, কমন রুম নিষিদ্ধ হয়, বইয়ের আলমারি বন্ধ হয়ে যায়। হাজারো শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ে। ঠিক করোনার মতো শিক্ষাব্যবস্থা বাড়িতেই সীমাবদ্ধ হয়। তখন পরীক্ষাই ছিল শিক্ষার মাধ্যম। তবে পরীক্ষা নেয়ার আগে অবশ্যই বাড়িতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হতো। তখন অটোপ্রমোশন যেমন ছিল না, তেমনি ঝুঁকিতে বিদ্যালয়ও খোলা হয়নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও এমন বিপর্যয় দেখা গিয়েছিল। তথাপি সে সময় পাক সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখেছিল। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের জোরপূর্বক বিদ্যালয়ে যেতে বাধ্যও করত। কিন্তু এদেশের ছাত্র জনতা যুদ্ধে যোগদানের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ পরবর্তীকালে অটো প্রমোশনে তারা পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন পায়। এটির কারণ, একদিকে ছাত্র-ছাত্রী কম ছিল, অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা বিবেচনা করা। এখন কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন দেয়া হবে, নাকি পরীক্ষা নেয়া হবে? মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খোলার মতো পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। তবে জেডিসি ও জেএসসি এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বাতিল হওয়ায় এইচএসসি এবং আলিম পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনও কমেনি। এইচএসসি এবং আলিম পরীক্ষা বাদ দেয়া কোনমতেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। কিন্তু একদিকে স্কুল-কলেজ-আলিয়া মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি বাড়ল ৩ অক্টোবর পর্যন্ত অন্যদিকে কওমী মাদ্রাসা খোলা এবং কওমী মাদ্রাসার উচ্চস্তরের পরীক্ষা (দাওরায়ে হাদিস) নেয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা সরকারী দুমুখো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বৈ আর কিছু নয়। কওমী মাদ্রাসা খোলা থাকার সিদ্ধান্ত এবং দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষার অনুমোদন দেয়ার পেছনে কী যুক্তি ছিল, তা জানা যায়নি। তবে এটি সরকারের বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে হয়। কারণ করোনা হুজুর কিংবা স্যারদের আলাদা আলাদা চেনে বলে মনে হয় না। মনে রাখা দরকার, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার যত ক্ষতিই হয়ে থাকুক না কেন, পরীক্ষা না নিলে সেই ক্ষতির ষোলোকলা পূর্ণ হবে শিগগিরই। তাই শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ তিন মাস কিংবা আরও বেশি সময় বাড়িয়ে সে ক্ষতি কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে ফিরতে বাধ্য হবে এবং এ পর্যন্ত যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে মনোযোগী হবে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের করোনা ঝুঁকিতে ফেলা যেমন ঠিক হবে না, বরং অন্যায় হবে। তেমনি পরীক্ষা না নিয়ে অটোপ্রমোশন দেয়াও তাদের নিজেদের জন্য এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হবে, সন্দেহ নেই। লেখক : শিক্ষক [email protected]
×