ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসচ্ছল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করণীয়

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

অসচ্ছল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করণীয়

কিছু দিন আগে একটি টেলিভিশনে দেশের অসহায় ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকারভিত্তিক একটি বিশেষ প্রতিবেদন দেখছিলাম। ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে উঠে আসে দেশের অসহায় ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের উর্র্ধগতির বাজারে কত কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অপর এক প্রতিবেদনে এক অসহায় মুক্তিযোদ্ধার ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করার করুণ বিষয় উঠে আসে। এরপর মনে মনে ভাবলাম, ‘হায় সেল্যুকাস! সত্যিই বিচিত্র এই দেশ। কারণ, এ দেশে কোন রাজাকারকে ভিক্ষা করতে দেখা যায় না এবং কেউ কখনও কোন রাজাকারকে ভিক্ষা করতে দেখেছে বলে মনেও হয় না। অথচ এ দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করেন। কারণ, তাঁদের সামনে আর বিকল্প কোন উপায় থাকে না। একটি স্বাধীন দেশে এর চেয়ে বড় কষ্টের বিষয় আর কি হতে পারে? এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে ও বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে এ দেশের বীর সন্তান। সব বাধাবিপত্তি আর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে যাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করার কল্পনা করতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন, কেবল তাঁরাই পারেন বিপ্লব আনতে, বিপ্লব সংঘটিত করতে। ১৯৭১ সালে এ বিষয়টিই আরেকবার প্রমাণ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নামক এ দেশের বীরসন্তানেরা। ১৯৭১ সালে তাঁরা সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত পাক হানাদার বাহিনীর হিংস্রতার সামনে শুধু দেশপ্রেমকে পুঁজি করে যুদ্ধে নেমেছিলেন। সেই বীর সংশপ্তকেরা সেদিন সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন শুধ দেশমাতৃকার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য। এহেন গর্বিত সন্তান বিশ্বের ইতিহাসে অনেকটাই বিরল। একাত্তরের সেই উত্তাল ও অগ্নিঝরা দিনগুলিতে কিভাবে এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন প্রশিক্ষিত হিংস্র হায়েনাদের সঙ্গে তা ভাবতেই অবাক লাগে। বৃষ্টিতে ভিজে, কনকনে শীতের রাতে খালি গায়ে, নগ্ন পায়ে, কখনও বা বনে-জঙ্গলে, কখনও বা পচা পুকুর-ডোবায় গলা ডুবিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন এ দেশের দামাল সন্তানেরা। মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর বুলেট-বেয়নেটের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধের মাঠে শত্রুর আঘাতে আহত হয়ে শেষ পর্যন্ত পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। পঙ্গুত্ব বরণকারী এসব মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি দেশে রয়েছে অনেক অসহায় ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্মৃতির পাতায় পাতায় এসব বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরগাঁথা কাহিনী লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে যুদ্ধাহত পরিবারের কথা। লুকিয়ে আছে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর গণহত্যার কথা। আরও লুকিয়ে আছে সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের অজানা বেদনার কথা, অব্যক্ত ব্যথার কথা। অথচ আমরা বর্তমান প্রজন্ম দেশের এসব বীর সন্তানের স্মৃতিকথাগুলো রক্ষা করার চেষ্টা কতটুকু করছি? যদি অবহেলায় হারিয়ে যায় এসব মানুষ, তা হলে আমাদের গৌরবময় স্মৃতি পরিণত হবে শুধু আনুষ্ঠানিকতায়। আর আজ যারা অসহায়, অসচ্ছল ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন, তাঁদের জন্যই বা আমরা কতটুকু করতে পেরেছি? শুধু বিশেষ দিনগুলোতে বা ডিসেম্বর কিংবা মার্চ মাসে আমরা স্মরণ করি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রকৃতপক্ষে দেশমাতৃকার এসব বীর সন্তানের জন্য আমরা স্থায়ীভাবে কতটুকু করতে পেরেছি তা ভেবে দেখা দরকার। মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যে সমস্ত পরিবার ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁরা সরকার থেকে যা অনুদান বা সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন (যদিও পূর্বের তুলনায় সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে), তা দিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বাজারে তাঁদের সংসারের প্রয়োজন মেটানো, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগানোসহ জীবন ধারণ করা অনেকটাই কষ্টকর। এসব বিষয় ভাবতেই যেন অবাক লাগে। গা শিউরে ওঠে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা নামক বীর সন্তানদের জন্য আমাদের যদি কিছু করার থাকে, তবে এখনই তার উপযুক্ত সময়। এরই প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, আনসার বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর উন্নয়নের জন্য ব্যাংক থাকলেও এখন পর্যন্ত অসহায়, অসচ্ছল ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সব মুক্তিযোদ্ধার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আজ পর্যন্ত কোন ব্যাংক চালু করা হয়নি। আনসার উন্নয়ন ব্যাংক, সেনাবাহিনীর জন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড (এমটিবিএল) ব্যাংকের মতো মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা অসহায়-যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংক গড়ে তোলা যেতে পারে। কেননা দেশের অসংখ্য অসহায়-দুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা সরকারীভাবে মাসিক যে অনুদান বা সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন, তা দিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে দিনাতিপাত করা কঠিন। আবার বাংলাদেশ যেহেতু একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এখানে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাসহ অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাই সরকারের পক্ষেও দেশের সব অসহায়-দুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করা বাস্তবিক অর্থে সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থসংস্থান দু’ভাবে হতে পারে। প্রথমত, সব মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এককালীন ৫০০ টাকা (নির্ধারিত) সংগ্রহ করে একটি ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে। থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা এ টাকা প্রত্যেকের কাছ থেকে তালিকার মাধ্যমে সংগ্রহ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের কাছে এককালীন ফান্ড হিসেবে জমা দিতে পারেন। বাকি টাকা সরকার জোগান দিয়ে ব্যাংকটি চালু হতে পারে। এক্ষেত্রে সন্দেহ দূর করার জন্য তালিকা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ে টাকা পৌঁছানোর পর প্রত্যেকে যেহেতু একই পরিমাণ অর্থ দিচ্ছেন, তাই অর্থ মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে সমগ্র দেশের এককালীন সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করবে। অথবা সমস্ত টাকাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে : * ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারকে হতে হবে সচেতন। কারণ, পরবর্তীতে যেন অন্য কোন সরকার মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা দিতে না পারে। এ ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। * এ ব্যাংকে যোগ্যতার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যা ও আত্মীয়স্বজনদের চাকরির সুযোগ থাকবে শতকরা ৯০-১০০ ভাগ। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে, যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ, তাঁদের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের এ সুযোগ-সুবিধাটুকু দেয়া খুব একটা বেশি অনুচিত হবে না। * দেশের প্রতিটি থানা, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে অসহায়-দুস্থ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যার শিকার পরিবারের সন্ধান করতে হবে। এ দায়িত্ব পালন করতে পারে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী বা যে সব সংস্থা, সংগঠন, লেখক বা গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করেছেন অথবা করছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। এসব পরিবারের সদস্যদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ও সহজ কিস্তিতে ঋণ শোধের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। স্বাধীনতার চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এসব পরিবারকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সমস্ত কষ্ট এঁরা বুকে ধারণ করলেও এখন পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবাতাস পাননি। * ব্যাংকের উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে এ ব্যাংকের অর্থ মুনাফাভিত্তিক শর্তে বিনিয়োগ করতে পারেন। * সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা মুনাফাভিত্তিক শর্তে অন্যান্য ব্যাংকের মতো এ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারেন। * ব্যাংকের উপার্জিত/লভ্যাংশের একটি অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক বেতন হিসেবে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয়ভার কমে যেতে পারে। * সরকার যদি ব্যাংকের লভ্যাংশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক অনুদান বৃদ্ধি করে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা পাবেন এবং সরকারও তাতে লাভবান হবে। বর্তমানে দেশের স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যাংক। তাহলে কেন আমরা এ দেশের অবহেলিত, বঞ্চিত, নিঃস্ব যোদ্ধাদের বস্তুত সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ‘ম্ুিক্তযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না। পাশাপাশি, হিসেব করলে দেখা যাবে, এদেশে বিত্তশালীদের সংখ্যা নেহায়তই কম নয়। এসব বিত্তশালী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বীর সন্তানদের অবদানকে সম্মান জানাতে এবং সর্বোপরি অসহায় ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মানবেতর তথা কষ্টের জীবনের অবসান ঘটাতে স্থায়ীভাবে যেমন : হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামার করে দিয়ে, দোকানপাট বা ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো কিছু ব্যবস্থা করে দিয়ে বা কুটির শিল্প জাতীয় কিছু করে দিয়ে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারেন। এতে করে অবশ্যই ওই অসহায় ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হবে এবং তখন আর ওইসব অসহায় ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে আর মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে যাঁদের রক্ত উষ্ণ হয়েছিল স্বাধীনতার প্রত্যাশায়, বর্তমান সরকারের সময়ে আজ তাঁরা অবার অনেক স্বপ্ন নিয়ে বুক বাঁচতে শুরু“ করেছেন। বর্তমান সরকারসহ সব দেশপ্রেমিক জনগণের আন্তরিক সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কল্যাণে ‘মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ব্যাংক’ গড়ে তোলা কি অসম্ভব? নিশ্চয় নয়। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। আর এগুলো সম্ভব হলেই অসহায়, অসচ্ছল ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের জীবনের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির (যুক্তরাজ্য) সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্টের সহযোগী সদস্য
×