ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

করোনা বদলে দিচ্ছে কর্মস্থল ও কাজের ধারা

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনা বদলে দিচ্ছে কর্মস্থল ও কাজের ধারা

কোভিড-১৯ বদলে দিচ্ছে কর্মস্থল ও কর্ম্যাভ্যাস। বলা যেতে পারে কর্মস্থলের ভবিষ্যত নিয়ে লড়াই সবে শুরু হয়ে গেছে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে অফিস বলতে বোঝায় রুটিন ও নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন। সারা বিশ্বেই নিয়োগকর্তা, কর্মচারী, সরকারগুলো নির্ণয় করার চেষ্টা করছে অফিস অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে কিনা, এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্কও চলছে। ফ্রান্সে প্রায় ৮৪ শতাংশ অফিস কর্মচারী কর্মস্থলে ফিরে গেছেন। কিন্তু ব্রিটেনে ফিরে গেছে ৪০ শতাংশের কম। কেউ বলছেন কোভিড-১৯ এর কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে ঘরে থেকে কাজ করা একটা স্থায়ী ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আবার অন্যরা বলছেন এটা নিতান্তই নেতিবাচক। বোঝাই যাচ্ছে যে, করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন বের হওয়া বা তা ব্যাপক পরিসরে প্রাপ্তি সাধ্য না হওয়া পর্যন্ত এই প্রশ্নে বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, করোনার কারণে আইটি প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে হোয়াইট কলারের কাজে রূপান্তর ঘটতে পারে। দু’শ’ বছর আগে স্টিম ইঞ্জিন শ্রমিকদের কারখানায় নিয়ে এসেছিল। সেখানে তারা নতুন মেশিন ব্যবহার করতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে বৃহৎ কর্পোরেটের আবির্ভাবের ফলে সেগুলো পরিচালনার জন্য স্টাফদের প্রয়োজন হয়। এরা প্ল্যানিং নিয়ে মিটিং করে। মেমো, ইনভয়েস এবং অন্যান্য জিনিস সার্কুলেট করে। সেগুলোর রেকর্ড রাখে। এসবের জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের একত্রে কাছাকাছি আসার প্রয়োজন হয়। গাড়িতে বা ট্রেনে করে প্রধান কার্যালয়ে একত্রিত হওয়ার ধারা সৃষ্টি হয়। তবে এই ধারার মধ্যে সমস্যা ও ঘাটতিও বরাবরই ছিল। যাতায়াতের পেছনে সময় নষ্ট হয়। অফিসগামীরা সন্তানদের দেখাশোনা করা নিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়ে। কিন্তু করোনা এসে সব বদলে দিয়েছে। এই মহামারীর আগে মাত্র ৩ শতাংশ আমেরিকান নিয়মিত বাসায় থেকে কাজ করত। এখন বিপুলসংখ্যক লোক করছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, অফিসে গিয়ে কাজ করার দিন শেষ হয়ে গেছে এবং এখন বাসায় থেকেই সে কাজ করে দেয়া যায়। মহামারীর কারণে চাপের মুখে থাকা সরকারগুলোও এখন মানুষজনকে কর্মস্থলে অর্থাৎ, অফিসে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে। ব্লুমবার্গ নামক একটি সংস্থা তার কর্মচারীদের লন্ডন অফিসে ফিরে যেতে প্রণোদনা হিসেবে দিনে ৫৫ পাউন্ড দিচ্ছে বলে জানা যায়। যেসব অফিস এই সেদিন পর্যন্ত কর্মচারীদের বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, তারা এখন কঠিন সমস্যায়ও পড়েছে। কারণ বাসায় থেকে কাজ করা অনেক হোয়াইট কলার কর্মচারীর জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। তারা এতে অভ্যস্তও হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অফিসে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা তৈরি হয়েছে। এটা ঠিক যে, লকডাউন তুলে নেয়া বা শিথিল করায় লোকজন আবার বাইরের জগতে চলে এসেছে। ধনী বিশ্বে খুচরা পণ্যের পেছনে ব্যয় অনেক বেড়েছে। হোটেল-রেস্তরাঁয় রিজার্ভেশন দারুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপি অনেকে অফিস পরিহার অব্যাহত রেখেছে। যদিও স্কুলগুলো আবার খুলেছে এবং কর্মজীবী বাবা-মায়ের জন্য অফিস করা অধিক সম্ভব সাধ্য হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, পাঁচটি বৃহৎ ইউরোপীয় দেশের মাত্র ৫০ শতাংশ লোক প্রতিদিন অফিস করছে। এক-চতুর্থাংশ লোক পুরো সময় বাড়িতেই থাকছে। এর একটা কারণ হতে পারে করোনা আতঙ্ক সামাজিক দূরত্ব রক্ষার পরামর্শের অবসান না ঘটা পর্যন্ত অফিসগুলো পূর্ণোদ্যমে অথবা পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ করতে পারবে না। পাশ্চাত্যে অফিসগুলো গড়ে ২৫ থেকে ৬০ শতাংশ স্টাফ নিয়ে এবং স্টাফদের মধ্যে ২ মিটার বা ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করছে। বহুতল অফিসে লিফট আছে। তবে সেগুলোতে একেবারে মাত্র দু’জন মানুষকে ওঠানামা করতে দেয়া হয়। ফলে অফিসে প্রবেশের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সেও এক মস্ত বিড়ম্বনার ব্যাপার। কিছু কিছু অফিস নিজেদের কাজের নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। লন্ডনের ২২ বিশপসগেটের একটি নতুন বহুতল ভবনের অফিস ম্যানেজাররা রিসারকুলেটেড এয়ারকন্ডিশনিং বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকে আবার হ্যান্ড স্যানিটাইজিং স্টেশন বসিয়েছে এবং প্লাস্টিকের প্রতিবন্ধক স্থাপন করেছে। এতে করে অফিসগুলো হয়ত নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। তারপরও অফিসে পৌঁছানো এখনও কঠিন। অনেক কর্মচারী গণপরিবহন ব্যবহার করতে চায় না বা তাতে নিরুৎসাহিত বোধ করে। তাদের অন্য পরিবহন ব্যবহার করাও কঠিন। নিউইয়র্ক সিটির কথাই ধরা যাক, সেখানে এক-চতুর্থাংশ কমিউটার অফিস থেকে ১৫ মাইলেরও বেশি দূরে বাস করে। এত দূর থেকে হেঁটে বা সাইকেলে করে আসা দুঃসাধ্য ব্যাপার। অফিসে না গিয়েও বাড়ি থেকে কাজ করার বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। এতে লোকে সুখী থাকে। ২০১৭ সালে আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর এক গবেষণাপত্রে বলা হয় যে, বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য যদি বেতনের ৮ শতাংশ কেটে রাখা হয় কর্মচারীরা তাও মেনে নিতে রাজি। তা থেকে বোঝা যায় যে, এতে তারা অর্থ বহির্ভূত সুবিধাদি পেয়ে থাকে। লকডাউন পরবর্তী অধ্যায়ে অফিসের মিটিংয়ের গড় সময়কাল কমে এসেছে। লোকে গণপরিবহনে কম যাচ্ছে কিংবা যাচ্ছেই না। বাড়ি থেকে কাজ করার সুখ ও সুবিধা আলাদা। তাতে আনন্দ ও প্রশান্তি বাড়ে। এর পরিণতিতে কর্মীদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। বেশিরভাগ দেশে গড় কর্মীরা জানিয়েছে যে, অফিসে বসে সে যে পরিমাণ কাজ করতে পারত, লকডাউনের সময়ে সে বাড়িতে থেকে তার চেয়েও বেশি কাজ করতে পেরেছে। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থাৎ, লকডাউন যেখানে তুলে নেয়া হয়েছে সেখানে বাসায় বসে কাজ করা আর অফিসে বসে কাজ করা এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি অধিক ফলদায়ক এবং দক্ষতার মাপকাঠিতে অধিক উপযোগী সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। লকডাউনের সময় অনেককে বিশেষ করে মহিলাদের বাড়িতে থেকে কাজ করার সময় বাচ্চাদেরও দেখাশোনা করতে হয়েছিল, যারা স্বাভাবিক অবস্থায় স্কুলে থাকত। এহেন অবস্থায় বাড়িতে থেকে কাজ করায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ারই কথা। তবে লকডাউনের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রভাব আছে যা বিপরীত প্রবণতা সৃষ্টি করে। এতে করে বাড়ি থেকে কাজ করা কৃত্রিম রকমের উৎপাদনশীল মনে হয়। লকডাউনের সময় কর্মচারীরা কোম্পানি থেকে ছাঁটাই হতে পারে-এই আশঙ্কা থেকে তারা কাজের বেগ ও গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই আশঙ্কা ব্যাপক পরিসরে বিদ্যমান ছিল। আমেরিকায় দেখা গেছে যে, করোনা মহামারীর কারণে অর্ধেকেরও বেশি কর্মচারী চাকরি হারানোর আশঙ্কায় ছিল এবং এখনও আছে। ওদিকে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, যারা বাসায় থেকে কাজ করে তারা অধিকতর উৎপাদনশীল। বাসার অপেক্ষাকৃত নীরব পরিবেশে তাদের উৎপাদনশীলতা এক-তৃতীয়াংশ বাড়ে। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা অধিকতর শ্রম ঘণ্টা ব্যয় করতে পারে। অন্য এক সমীক্ষায়ও একই ফল পাওয়া গেছে। সমীক্ষাগুলো ছিল করোনা সঙ্কট পূর্বকালীন সময়ের। আর করোনার কারণে লকডাউনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে আগের সমীক্ষাগুলোয় বাসায় থেকে কাজ করার সুফলের ধারা ও মাত্রাটা এই সময়টিতে আরও বেড়েছে। মহামারীর আগে থেকেই নিয়মিত বাসায় বসে কাজ করা লোকের সংখ্যা বাড়ছিল। তবে চূড়ান্ত হিসেবে তাদের সংখ্যাটা ছিল সামান্য। একটি মত হচ্ছে এই যে, অফিসে বসে কাজ করার যে ধারাটি আছে তার প্রাধান্য এত বেশি যে, এই সেদিন পর্যন্ত দেখা গেছে অফিসভিত্তিক কাজের দক্ষতা গৃহভিত্তিক কাজের তুলনায় কোম্পানি ও শ্রমিক-কর্মচারী উভয়ের ক্ষেত্রেই অধিক। অন্য একটি ব্যাখ্যাও আছে। সেটির বক্তব্য, ঘরে থেকে করা কাজ প্রকৃতপক্ষে অফিসে বসে করা কাজের চেয়ে অধিক দক্ষতাপূর্ণ। তার চেয়েও বড় কথা এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী অফিসের গৌরবের দিন শেষ হয়ে গেছে। অফিসের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন একসময় যখন কাজের জগতে প্রচুর কাগজপত্র প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন হয়েছিল। এত দীর্ঘদিন ধরে অফিস এত দাপটে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে যে, এটা এক অর্থে বাজারের ব্যর্থতার প্রতিফলন। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার আগে বিশ্ব সম্ভবত একটা বাজে বা ত্রুটিপূর্ণ ভারসাম্যের মধ্যে আটকা পড়েছিল, যেখানে বাড়িতে করা কাজের যতটা গুরুত্ব ও ব্যাপকতা পাওয়া উচিত ছিল, তা পায়নি। বর্তমান মহামারী সেই বাজে বা ত্রুটিপূর্ণ ভারসাম্যের গায়ে বিশাল এক ধাক্কা মেরেছে, যার ফলে বিশ্ব এখন এক নতুন, উন্নততর ভারসাম্যে স্থাপিত হয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ব্রেন্ট নেইম্যান বলেন, এখনকার এই অধ্যায়ের আগে তিনটি কারণে গৃহভিত্তিক কাজের বিকাশ ঘটতে পারেনি। প্রথমটি তথ্য সংক্রান্ত। একটা অফিসে ভিড় করে জড়ো হওয়া অপরিহার্য কি না কর্তাব্যক্তিরা স্রেফে তা জানতেন না। গত ৬ মাসে তা তারা জানার সুযোগ পেয়েছেন। দ্বিতীয় কারণটি সমন্বয় সম্পর্কিত। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে গৃহভিত্তিক কাজের দিকে চলে যাওয়া হয়তবা কঠিন ছিল এবং সেটা সম্ভবত এই কারণে যে, ব্যাপারটা সাপ্লায়ার ও ক্লায়েন্টদের কাছে উদ্ভট মনে হতো। করোনা মহামারী অবশ্য সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে হঠাৎ করে মুহূর্তের মধ্যে গৃহভিত্তিক কাজে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করেছে। তৃতীয় বিষয়টি হলো বিনিয়োগ সংক্রান্ত। অফিসকে গৃহভিত্তিক কাজে স্থানান্তরিত করার সঙ্গে যে বিশাল অঙ্কের স্থায়ী ব্যয় যুক্ত, সেদিকটা ভেবেই হয়ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো সে ধরনের চেষ্টা করা থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছিল। অথচ জরিপের তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কোম্পানিসমূহ স্টাফদের বাসা থেকে কাজ করতে দেয়ার জন্য ল্যাপটপের মতো সাজ সরঞ্জামের পেছনে বিরাট অঙ্গের অর্থ ব্যয় করেছে। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, বিশ্ববাণিজ্য পরিস্থিতি তারচেয়ে ভাল হওয়ার এটা অন্যতম কারণ। এ ধরনের বিনিয়োগ গৃহ বা পরিবার পর্যায়েও হয়েছে। অনেক ধনী দেশে এখন একক পরিবারের বাজারদর এ্যাপার্টমেন্টের বাজারের চেয়ে অধিকতর চাঙ্গা বা শক্তিশালী। এ থেকে বোঝা যায় যে, লোকে এখন বাড়তি স্পেসের দিকে ঝুঁকছে এবং সম্ভবত এর উদ্দেশ্য হচ্ছে গৃহকে অফিসের কাজে উৎসর্গিত রাখা। করোনা মহামারী বিদায় নেয়ার বেশ কিছু সময় পর গৃহভিত্তিক কাজের এই ধারা কি পরিমাণে জনপ্রিয় থাকবে তা নির্ভর করবে কোম্পানি এবং কর্মচারীদের মধ্যে দরকষাকষির ওপর। তবে অফিস থেকে কাজ করার ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতা প্রকৃতপক্ষে ব্যাহত হতে পারে এই বিতর্কিত তত্ত্ব কোম্পানিগুলো গ্রহণ করে না বর্জন করে, তার ওপরও এটা নির্ভর করবে। চলবে... সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×