ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী বলে প্রতারণা

বিশেষ মহলের ইন্ধন-ভাসানচরে যাবে না রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিশেষ মহলের ইন্ধন-ভাসানচরে যাবে না রোহিঙ্গারা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ দিন তারিখ নির্ধারণ করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাছাইকৃত রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচর পরিদর্শন করে এসেছেন। সেখানকার পরিবেশ, অবকাঠামো নিয়ে প্রশংসা করায় কেউ কেউ ভাসানচরে যেতে রাজি হয়। কিন্তু ১০ দিনের মাথায় এখন বলাবলি করছে, তারা নিজ দেশে ফিরতে রাজি, ভাসানচরে যেতে রাজি নয়। সচেতন মহল বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রিত উদ্বাস্তু মাত্র। তাদের আশ্রয়কল্পে সরকারের যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই থাকতে হবে ওই উদ্বাস্তুদের। তবে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত কতিপয় বিদেশী এনজিও কর্মকর্তা ও পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা যা বলেন, তাই দলিল হিসেবে মেনে নেয় আশ্রিতরা। তাদের ইন্ধনে ক্যাম্পে প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে, ভাসানচরে যাওয়ার চেয়ে নিজ দেশে ফিরতে আগ্রহী তারা। গত ৫ সেপ্টেম্বর তিন নারীসহ রোহিঙ্গাদের ৪০ জনের একটি প্রতিনিধি দল নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর পরিদর্শনে যান। তারা দেখেছেন সেখানকার থাকার ঘর, খাদ্যগুদাম, খেলার জায়গা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, মসজিদ, কবরস্থান, পুকুর ও আশ্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি। ৮ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পে ফিরে অনুভূতি প্রকাশ করেন ওই রোহিঙ্গা নেতারা। সেখানকার সৌন্দর্য্য এবং ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার কথা জানান আশ্রিতদের। বর্তমানে রোহিঙ্গারা বলাবলি করছে, তারা মিয়ানমারে যাবে, তবুও ভাসানচরে যাবে না। অথচ ইতিপূর্বে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সরকার দুইবার উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলাদেশে থাকতেই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আদায় করে দেয়ার কঠিন দাবি কাঁধে তুলে দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে অনীহা প্রকাশ করে। এদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে জেনেই রোহিঙ্গারা ভাসানচর নয়, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন হতে আগ্রহী বলে প্রস্তাব করছে। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এটি রোহিঙ্গাদের প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, ভাসানচর নয়, মিয়ানমারে যেতে কারা আগ্রহী, তা বাস্তবে দেখতে গেলে ধরা পড়বে অকৃতজ্ঞ এই রোহিঙ্গাদের এসব প্রতারণা। সরকারী দফতরে মিয়ানমারে যেতে আগ্রহীদের তালিকা করা হচ্ছে বলে ডাকা হলে কেউ সাড়া দেবে না। উখিয়া-টেকনাফে গাদাগাদি করে বসবাস করছে বলে চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিতে চায় সরকার। আর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। স্থানীয় এনজিও পাল্স’র প্রধান নির্বাহী ও কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, জনসংখ্যার আধিক্য বিবেচনা করে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিতে সরকারী সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। এটি একটি সুন্দর আয়োজন। রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত না যাওয়া পর্যন্ত ভাসানচরে যাওয়াটাই উচিত এবং যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন তিনি। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ সামছুদ্দৌজা জানান, বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ রোহিঙ্গা এখন ভাসানচরে ভালই আছেন। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল ভাসানচর ঘুরে দেখেছেন। সেখানে অবস্থানরতদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। স্বচক্ষে সব পরিবেশ দেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, একটি মহল রোহিঙ্গাদের ইন্ধন দিয়ে বলছে, ভাসানচর একটি দরিয়া (সাগর)। এই দরিয়ার মাঝে থাকা যাবে না। ভাসানচর এক প্রকার বন্দীশালা। পরিবারের কেউ যেতে পারবেনা ওখানে। প্রয়োজনে ক্যাম্পে না খেয়ে থাকা ভাল হবে। এসব শুনে কোনমতেই ভাসানচরে যেতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা। উখিয়া ক্যাম্প-১৯, ব্লক-ডি-১২ তে আশ্রিত পঞ্চাশোর্ধ মহিলা ছলিমা খাতুন জানান, তার মেয়ে নুর কায়েদা তার স্বামীর কাছে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ধরা পড়ার পর বর্তমানে ভাসানচরে আছে। প্রথমদিকে ফোনে কথা বললেও এখন মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাই ছলিমাও ভাসানচরের বিপক্ষে। তার মতে, যতদিন আছে ক্যাম্পেই থাকবে। অন্য কোথাও যেতে রাজি নয় তারা। ষাটোর্ধ রোহিঙ্গা নুরুল আমিন বলেন, ভাসানচরে পাঠানোর চেয়ে কোন একটি পাহাড়ে ফেলে দিলে অনেক ভাল হবে। ক্যাম্পে যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই। ভাসানচর ঘুরে আসা মৌলবি আবুল কালাম জানান, সেখানকার পরিবেশ ভাল, অনেক কিছু দেখেছি- তা সুন্দর লেগেছে। অন্য রোহিঙ্গাদের এসব বুঝানো হচ্ছে। তবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মত ভিন্ন। ক্যাম্প সূত্রে প্রকাশ, প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে ভাসানচরে। এতে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে। এসব অবকাঠামো-সুবিধাদি স্বচক্ষে দেখে আশ্রিতদের রাজি করাতে ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৪০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলকে। ৫আগস্ট শনিবার ভোরে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পের ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তত্ত্বাবধানে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। উখিয়ার কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের সভাপতি হাফেজ জালাল আহমদ জানান, রোহিঙ্গারা ভাসানচরে চলে গেলে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিছুটা হলেও কমে যাবে। ওইসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা কয়েকটি এনজিও এবং ক্যাম্পের বাইরে বসবাসকৃত পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে রেখেছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ার ও ভাসানচরে স্থানান্তর না হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন অভিজ্ঞজনরা। এনজিওতে রোহিঙ্গাদের চাকরি ॥ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত কিছু সংখ্যক এনজিও তাদের সংস্থায় বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছে রোহিঙ্গাদের। অথচ স্থানীয় ছেলে মেয়েরা এনজিওতে চাকরি পায়না, পদগুলো রোহিঙ্গা নারী পুরুষদের নিয়ে পূরণ করা হয়েছে। কারণ হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের রাজি না রাখলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে। শরণার্থী আইন অনুসারে আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তুরা যেদেশে আশ্রয় গ্রহণ করবে, তারা আশ্রয় ক্যাম্পে অবস্থানসহ ওই দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে। তারা চাকরিসহ বাড়তি আয়-রোজগার করতে পারেনা। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এনজিওতে চাকরিসহ ক্যাম্প অভ্যন্তরে দোকান বসিয়ে দিব্যি ব্যবসা করে আয়- রোজগার করছে। এনজিও থেকে মাসিক মোটা অঙ্কের বেতন পাচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। এসব ফেলে তারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী নয় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কক্সবাজারে আয়েশী জীবনযাপন ॥ পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার অঞ্চলে গড়ে উঠেছে তিনতারকা ও পাঁচ তারকামানের হোটেল। বিদেশী এনজিও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ওইসব হোটেলে থাকেন। সকালে রওনা দিলে মাত্র ৪৫ মিনিট বা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আশ্রয় শিবিরে পৌঁছে কাজ সেরে ফের পর্যটন শহরে ফিরে আসছেন। রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশী অর্থে সৈকত রানী কক্সবাজারে বিভিন্নভাবে বহু আরাম-আয়েশী জীবনযাপন করছেন তারা। কিন্তু ভাসানচরে পাঁচ তারকামানের হোটেল গড়ে উঠেনি। রোহিঙ্গা সেবায় নিয়োজিত থাকলেও কক্সবাজারের মতো সুযোগ সুবিধা নেই ভাসানচরে। তাই তারা রোহিঙ্গাদের ইন্ধন জোগাচ্ছেন। আশ্রয় শিবিরে ইয়াবা কারবার ॥ উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় ক্যাম্পে থেকে রোহিঙ্গারা ইয়াবা কারবারে মজা ত্যাগ করে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বা ভাসানচরে স্থানান্তর হতে চাইছেনা। ভাসানচরে গেলে ইয়াবার চালান আনতে ওপারে যেতে পারবেনা। ইয়াবা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে শীর্ষ কারবারিরা মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি (উখিয়া-টেকনাফ) শিবিরে বসবাস করতে চায়। কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী, পুটিবনিয়া, চাকমারকুল, নয়াপাড়া-মুচনি ও শামলাপুর ক্যাম্পে ইয়াবার রমরমা কারবার চলছে। ভাসানচরে গেলে ইয়াবা কারবার করতে পারবেনা। এজন্য আপাতত যে বিষয়টি সম্ভব নয় (প্রত্যাবাসন) সেইটিতে রাজি বলে রোহিঙ্গারা ধোঁকা দিয়ে চলেছে। অতিরিক্ত ত্রাণ প্রদান ॥ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে অতিরিক্ত ত্রাণ দেয়াতে তারা ওইসব বিক্রি করে নগদ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নগদ টাকা জমা করে কেউ কেউ শহরে বাসা ভাড়া করে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বসবাস করছে। ত্রাণ নেয়ার কার্ড দেখিয়ে সবাইর জন্য ত্রাণসামগ্রী উত্তোলন করে বিক্রি করে দিচ্ছে তারা। ত্রাণ দেয়ার আগে ঝটিকা অভিযানে কার্ড অনুপাতে শিবিরে কয়জন সদস্য বিদ্যমান, তা যাচাই করা দরকার। তাই তাদের সীমিত আকারে ত্রাণ বরাদ্দ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনরা। উল্লেখ্য, তিন হাজার ৯৫ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে তৈরি করা হয়েছে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাড়তি টাকা ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে। বরাদ্দ বাড়ার ফলে ভাসানচর রক্ষাকারী বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা হচ্ছে।
×