ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের নতুন নক্সা তৈরির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ২২:২৩, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের নতুন নক্সা তৈরির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

মশিউর রহমান খান ॥ পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প নতুন করে নক্সা (রি-ডিজাইন) তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে গার্ডার তৈরি করায় ও পদ্মা সেতুতে বড় যানবাহন ও লরি, কাভার্ড ভ্যানসহ উচ্চতার যানবাহন চলাচল করতে বাধা ও নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে বিধায় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাই দ্রুত রি-ডিজাইন করে তা জমা দিতে ও নতুন ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছেন বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। গত বুধবার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান সেতু সচিব। একইসঙ্গে উচ্চতা নিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পূর্ব থেকেই রেল কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলেও জনকণ্ঠকে জানান তিনি। এদিকে নির্দেশ অনুযায়ী নতুন ডিজাইন (রি-ডিজাইন) আগামী রবি কিংবা সোমবার সেতু মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হতে পারে বলে জানান সেতু বিভাগের সচিব। এরপরই তা যাচাই বাছই করে নতুন করে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতাসম্পন্ন গার্ডার তৈরির কাজ শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরেজমিনে দেখতে যান। এ সময় তারা বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার মাওয়া প্রান্তে দোগাছি এলাকার সার্ভিস এরিয়া ১ এর সভাকক্ষে এ নিয়ে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা ও সেতু সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মেজর জেনারেল জাহিদ, চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির প্রতিনিধি ও রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না রেলওয়ে গ্রুপের কর্মকর্তাবৃন্দ ও প্রকৌশলীগণ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কিভাবে ডিজাইন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন উপস্থিত সবাই। জানা গেছে নির্দিষ্ট সময় রি-ডিজাইন করে অতি দ্রুততার সঙ্গে নিয়মানুযায়ী কিভাবে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায় সে জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই গত সপ্তাহে সিদ্ধান্ত নিলেও সরেজমিনে এসে বিষয়টি পরিদর্শন করতেই সেতু বিভাগের সচিব ও রেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই পদ্মা সেতু এলাকায় আসেন এসব উর্ধতন কর্মকর্তারা। নতুন ডিজাইন অনুযায়ী রেলের তৈরি পুরনো গার্ডার সরিয়ে ফেলতে হবে। সড়কের সঙ্গে রেললাইনের হেডরুম উচ্চতা কমপক্ষে ৫ দশমিক ৭ মিটার করে নতুন ডিজাইন সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে আগামী সপ্তাহে জমা দেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সেতু সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত সপ্তাহে পদ্মায় রেল সংযোগ প্রকল্পের রি-ডিজাইন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সরেজমিনে দেখতে শুক্রবার আমরা যাই। আমি ও রেলপথ সচিব সেলিম রেজাকে নিয়ে সেতুর ওপর উঠে রোডওয়ে ও রেলওয়ে ডেক বসানোর কাজ পরিদর্শন করেছি। তিনি বলেন, মূলত এমন সেতু তো আর এক দশকের জন্য তৈরি করা হয় না। বর্তমানের অবস্থা সরেজমিনে দেখে বুঝা গেল এ অবস্থায় থাকলে গার্ডারের উচ্চতার কারণে ভয়াবহ সমস্যার তৈরি হতো। ঘটত নানা প্রকার দুর্ঘটনা। একটি সেতুর গার্ডার নিয়ম অনুযায়ী ৫ দশমিক ৭ মিটার উচ্চতা থাকার কথা। এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ফলে অনেকটা দূর থেকেই বাঁকা ও কম উচ্চতা দেখা গিয়েছে। সচিব বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেলসেতুটি ১০০ বছরের বেশি সময় হলেও এখনও তা তেমন কিছুই হয়নি। আর এই সেতুটি তৈরির আগেই গার্ডারের উচ্চতা কম দেয়া হয়েছে। ফলে মূল সেতুতে যান চলাচলে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হতো। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি রেলসেতু তৈরিতে যে কোন রকমের সমস্যা থাকতে পারে। এ জন্য রেল কর্তৃপক্ষ অনেক আগে থেকেই এ সমস্যাটি নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সমন্বয় না করায় বর্তমান এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বেলায়েত বলেন, বিখ্যাত ডিজাইনার ড. এম শামীম জেড বসুনিয়াকে প্রধান করে গঠিত দলকে এটি রি-ডিজাইন করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আশাকরি তিনি আগামী সপ্তাহের রবি বা সোমবার এর ডিজাইন আমাদের কাছে জমা দেবেন। রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ড. জেড বসুনিয়া কমপক্ষে ৩টি ডিজাইন তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছেন। এর মধ্যে যেটি পছন্দ হবে সেটিই যাচাই বাছাই শেষে চূড়ান্ত ডিজাইন হিসেবে রাখা হবে। আগামী সপ্তাহে ডিজাইন পাওয়ার পরই নতুন ডিজাইন অনুযায়ী এর কাজ শুরু করা হবে। রেলসেতুর কারণে যাতে কোন প্রকার সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেদিকটি অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের ত্রুটিগুলোর সঠিক সমাধানকল্পে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে যেসব গার্ডার রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করে নতুন করে বসানো হবে। সড়ক পথ থেকে রেল লাইনের উচ্চতার যে স্ট্যান্ডার্ড আছে সেটি অনুসরণ করতেই এটা করা হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়রিং কোম্পানি মূল পদ্মা সেতুর ভেতরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ কাজ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে সেতুর দুই পাড়ের রেললাইন নিয়ে যা ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত এবং মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ওই পারের জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প নামে পরিচিত যার কাজ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। পদ্মা সেতু সূত্র জানায়, সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুই পাশের কিছু অংশে রেললাইন ওপর দিয়ে গেছে। এসব জায়গায় হেডরুম যে উচ্চতায় দেয়ার কথা সেটি দেয়নি রেলওয়ে। এ অবস্থায় সেতুতে ওঠানামা করতে পারবে না বড় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানগুলো। হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল দুটো দিকেই রেলওয়ের কাজে আপত্তি দেয়া হয়েছে। দেশের সড়ক পথের হেডরুম স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে হরাইজন্টাল ১৫ মিটার, ভার্টিক্যাল ৫ দশমিক ৭ মিটার যা এই সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি। এ অবস্থায় সেতুতে ট্রাক কাভার্ড ভ্যানও দুই তলা বাস যেতে পারবে না। সূত্র জানায়, দেশের মহাসড়কগুলোতে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ও নিয়ম অনুযায়ী হেডরুম উচ্চতা রাখতে হয় সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৭ মিটার। কিন্তু পদ্মা রেললিংক প্রকল্পে মাত্র ৪ দশমিক ৮ মিটার উচ্চতা দেয়া হয়েছে। ফলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, পদ্মায় রেলসেতু লিংক প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে দেখতে আমরা শুক্রবার প্রকল্পে গিয়েছিলাম সেতু বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সঙ্গে নিয়ে। মূলত গার্ডার নিয়ে একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেটি তেমন বড় কোন সমস্যা নয়। পুরো সেতুর নকশা রি-ডিজাইন করতে হবে এমনটা নয়। ডিজাইন নিয়ে একটু সমস্যা ছিল তা আমরা সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতেই সাইট ভিজিট করেছি। তবে যেটুকু ছোটখাট সমস্যা ছিল তা সমাধানে আমাদের টেকনিক্যাল টিম কাজ করছে। অতিদ্রুতই তা সমাধান করা হবে।
×