ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ ঘণ্টায় ৭৩ জন গ্রেফতার

অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে মাদক পাচার, সেবন

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে মাদক পাচার, সেবন

শংকর কুমার দে ॥ দেশে মাদক বিরোধী অভিযান জিরো টলারেন্স নিয়ে চলমান সত্ত্বেও মাদক পাচার, বিক্রি, সেবন বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। মাদক পাচার, বিক্রি, সেবন কি পরিমাণ বেড়েছে তা রাজধানীতে গত চব্বিশ ঘণ্টার মাদক বিরোধী অভিযানের ফলাফলই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। চব্বিশ ঘণ্টার অভিযানে খোদ রাজধানীতেই মাদক বিক্রি ও সেবনের দায়ে এক দিনেই ৭৩ জন গ্রেফতার, বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল উদ্ধার, এবং মাদক আইনে ৫১টি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর গত আগস্টে এক মাসেই ৫০ কোটি টাকার বেশি বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। প্রতি বছরই হাজার কোটি টাকার বেশি মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কোন মাদকদ্রব্য উৎপাদন হয় না, অথচ সারাদেশে প্রতিবছর মাদকের লেনদেন হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। মাদক পাচার, বিক্রি, সেবনের পেছনে এই বিশাল অঙ্কের টাকায় বাড়ছে মাদকাসক্ত। দেশে প্রায় ৬৮ লাখ মাদকাসক্ত। দেশের সীমান্তের ৫১২ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ২৪ ধরনের মাদক। এর মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। মাদক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে দেশের সীমান্তের এসব পয়েন্ট দিয়ে দিনমজুরশ্রেণীর ৩০-৩৫ হাজার লোক মাদক আনা-নেয়ার কাজে জড়িত। সারা দেশে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২৫ সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই সাত থেকে আট হাজার ব্যক্তি মাদক কেনাবেচা করে থাকে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশজুড়ে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার মতো মাদক পাচার কোনমতেই থামানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন চোরাইপথে ৩০ লক্ষাধিক পিস ইয়াবা দেশে ঢুকে বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা গেছে। সে হিসেবে শুধু ইয়াবা বাবদই প্রতিবছর অন্তত মিয়ানমারে ৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে থাকে। দেশে জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ মাদকাসক্ত হওয়ায় তাদের ঘিরে সংঘবদ্ধ চক্র নানারকম বাণিজ্য ধান্ধায় মেতে উঠেছে। মাদক সরবরাহ, ভেজাল মাদক তৈরি, পুলিশের ধরা ছাড়া বাণিজ্য, মাদক বিরোধী সামাজিক কর্মকান্ড চালানোসহ নানা নামে, নানা কৌশলে, নানা ধরনের চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ৬০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। ৩২ ধরনের মাদকের ছড়াছড়িতে বর্তমান ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামে যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, ব্রুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এ ছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে। এসব দ্রব্যের নেশাজনিত চাহিদা থাকায় বেশিরভাগই ভেজাল উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই। নতুন প্রজন্ম এখন ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ। ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। এ কারণে অন্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রি করছে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এক লাখের বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ, ১৩ ভাগ নারী। তবে বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যাই সর্বাধিক এবং ইয়াবাই মাদক সাম্রাজ্যের সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও উদ্ধার হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে অভিযান পরিচালনা, বন্দুকযুদ্ধ, আত্মসমর্পণ করানোর ঘটনাসহ নানাভাবে চেষ্টা করেও ইয়াবা পাচার, সেবন, কারবার সবই আবার আগের মতো অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস) এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান)-এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে এদেশে মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটছে। তিন দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। এ কারণে মাদক পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। বাড়ছে মাদক বেচাকেনা। মাদকসেবীর সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার ও ভারত-এই দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে। মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বার্ষিক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি বিবেচনার উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, তাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদাহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরে মাদক ঢুকছে। আর ভারতের অসম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারতের অসম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং ফেনীতে। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব রুট দিয়ে দেশে হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা ঠেকাতে বাংলাদেশের আহ্বানে ভারত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা। ইয়াবার অবাধ প্রবেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশে। বেশিরভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান এবং কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মুয়াংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের গুনদুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতিবছর দেশ থেকে মাদকের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতিবছর কত টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে মাদক পাচারের সিন্ডিকেট দেশে ও বিদেশে সক্রিয় থাকায় মাদক পাচার, বিক্রি, সেবন কোনটাই বন্ধ করা যায়নি, এটা সত্য। মাদক বিরোধী অভিযানের ফলে সাফল্য আছে বলেই আগের মতো মাদক কারবার প্রকাশ্যে চলছে না।
×