ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা, লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা, লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বর্ষা বিদায় নেবে কয়েকদিন পরই। অথচ বর্ষার এই অবেলায় দেশের উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ শুরু হয়েছে অকালবন্যা। দীর্ঘ বন্যার ধকল কাটিয়ে কৃষক যখন সোনালি স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি বন্যায় তলিয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তরের সব নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে ধরলা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। হঠাৎ বন্যার কারণে উত্তরের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যায় দিশেহারা তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে বন্যার কোন সম্পর্ক নেই। বৃষ্টি থেমে গেলে পানি কমে যাবে। দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রভাব পড়বে না। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, তিনদিন ধরে উত্তরের জেলাগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আগামী দুদিন এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। ফলে দুদিনের মধ্যে সেখানে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী তাদের পর্যবেক্ষণকৃত নদ-নদীর ১০১ সমতল স্টেশনের মধ্যে ৬৬ স্টেশনের পানি বাড়ছে। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, মৌসুমিবায়ুর বিদায়বেলায় দেশের উত্তরাঞ্চলের ওপর সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে গত তিনদিন সেখানে ধারাবাহিকভাবে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আরও দুদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তরাঞ্চল থেকে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে মৌসুমিবায়ু। এ কারণে অসমেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তিনি জানান, সেপ্টেম্বরে অনেক সময় বন্যা হতে পারে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে এই সময় সাধারণত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা দেখা যায়। এবার একটু ব্যতিক্রম; তা হলো ভারি বৃষ্টির কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য অক্টোবরের মধ্যে মৌসুমিবায়ু দেশ থেকে বিদায় নেবে। এই সময়ের মধ্যে সারাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টিপাত হতে পারে। এদিকে ভারতের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী রবিবার নাগাদ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের ওপর একটি নিম্নচাপ তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে আগামী রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও আবার ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও রয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলাগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাত দেখা দিতে পারে। এবার চার দফায় দেশের বন্যা পরিস্থিতি প্রায় ২ মাস স্থায়ী হয়ে পড়ে। আগস্টের শেষ নাগাদ দেশ থেকে বন্যা বিদায় নেয়। সরকারী হিসাব মতে, দেশের ৩৩ জেলার প্রায় ১ কোটি লোক কমবেশি বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে। বন্যা চলে যাওয়ায় নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্নে বিভোর কৃষক। মাঠে মাঠে এখন সোনালি ধানের হাসি। বন্যা কাটিয়ে যখন তারা নতুন ফসলের স্বপ্ন দেখছে ঠিক তখনি উত্তরের কিছু কিছু জেলায় ভারি বৃষ্টিতে বন্যার ফলে অনেক ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। হঠাৎ বন্যায় হতাশা ভর করেছে কৃষকের মাঝে। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগ থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে দেশে আগাম বন্যা দেখা গেছে। সাধারণত দেশে মধ্য জুলাইয়ে বন্যা হলেও এবার জুনের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়। চার দফায় উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর- পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যা কবলে পড়ে। সেই বন্যার ধকল কাটতে না কাটতে আবারও উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই পানি নেমে এসে দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যা দেখা দিতে পারে। তবে এটা সাময়িক। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পড়বে। এদিকে কুড়িগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামের সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, ফুলবাড়ী ও উলিপুর উপজেলার অর্ধশত চর প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৪০ হাজার মানুষ। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে কুড়িগ্রাম সদর ও ফুলবাড়ী উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শত শত হেক্টর আমন ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কোন কোন আমন ক্ষেতে ৪/৫ ফুট পানি জমে আছে। ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক। এদিকে ধরলার ভাঙ্গনে সদর উপজেলার সারডোব, মোগলবাসা, পাঁচগাছি, যাত্রাপুর এবং তিস্তার ভাঙ্গনে বজরা, থেতরাই ও গুণাইগাছ এলাকায় বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর ও আবাদি জমি। লালমনিরহাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার জেলার মোগলহাটে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৯ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। রাতে ফলিমারীর দ্বীপ চরটি ডুবে গেছে। গভীর রাতে ফলিমারীর চরে নিরাপদ আশ্রয়ে গ্রামের মানুষ ছোটাছুটি করতে গিয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মানুষের আর্তনাদ ও চিৎকারে গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে যায়। ফলিমারী চরবাসীর রাত কেটেছে নির্ঘুম। পরে নিজেদের উদ্যোগে রাতেই সকলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। জানা গেছে, ধরলা নদী ভারত হতে প্রবাহিত হয়ে মোগলহাটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সারারাত বৃষ্টি ও ভারতের উজানি ঢলে ধরলা নদী রাতে বিপদসীমার ১৯ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে জেলা সদরের মোগলহাট ইউনিয়নের দ্বীপ চর ফলিমারী চর হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। ফলিমারী চরে হু হু করে পানি বাড়তে থাকায় রাতে চরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মোগলহাট ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, ফলিমারী চরে ১৬২ পরিবারের বসবাস। ফলিমারী চরের চারধারেই ধরলা নদী। নদীর মাঝখানে ফলিমারী দ্বীপচর। কয়েক শত একর জমির এই চরটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এখানে সারাবছর সবরিকলার চাষ হয়। অসময়ে বন্যার কারণে চরবাসীর কোন প্রস্তুতি ছিল না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, ধরলা নদী এবারে চওরাটারী, বুমকা, খারুয়া, শিবেরকুটি, দক্ষিণ শিবেরকুটি ও মোগলহাটে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল। পানি যখন কমছিল তখন এসব ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এখন হঠাৎ বন্যায় ডুবে গেছে। পানি কমলে বোঝা যাবে নতুন কোন জায়গায় ভাঙ্গন দেখা দেয় কিনা। তিনি আরও জানান, ফলিমারী চরের ভাঙ্গন রোধে স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলেছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের নতুন জিও ব্যাগ সরবরাহ করেছে। শেরপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ী ঢলের পানিতে শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা পরিষদ চত্বরসহ ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়ন, মালিঝিকান্দা, হাতিবান্ধা ও গৌরিপুর ইউনিয়নের আংশিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে ঢলের স্রোতে ওইসব ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বাড়ি-ঘর, পুকুর এবং কয়েক হাজার একর রোপা আমন আবাদ তলিয়ে গেছে। জানা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহারশি নদীর পানি হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই উপজেলা চত্বরের ১২ থেকে ১৩টি দফতরের অফিসের ভেতর পানি প্রবেশ করে। এরপর আস্তে আস্তে ঝিনাইগাতী প্রধান সড়কসহ বাজারের বিভিন্ন দোকানপাট এবং আবাসিক এলাকার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে পানি প্রবেশ করে।
×