ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নীতিমালা অনুসরণ না করে ড্রোন ওড়ালে কঠোর শাস্তি

প্রকাশিত: ২৩:০১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

নীতিমালা অনুসরণ না করে ড্রোন ওড়ালে কঠোর শাস্তি

আজাদ সুলায়মান ॥ ড্রোন শুধু বিনোদনের নয়, প্রয়োজনেরও। এটা শুধু শিশুদের খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় না- জঙ্গীদের হাতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। আর দুনিয়ার শক্তিশালী দেশগুলো তো একজায়গায় বসে আরেক জায়গায় ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তাই ইন্টারন্যাশাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) পরামর্শে কিছু সাধারণ শর্ত রেখে দুনিয়াব্যাপী নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। বিমানবন্দর এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য বিলম্বে হলেও বাংলাদেশে অনুমোদিত হয়েছে ড্রোন নিবন্ধন নীতিমালা ২০২০। যা বুধবার বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। এদিকে নীতিমালার বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ড্রোন উড্ডয়ন নিয়ে খবর প্রচারিত হওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে কিছু তথ্যগত ভুল থাকায় তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতামত দেয়া হলো। ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা ২০২০ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে কিন্তু তা গেজেট আকারে এখনও প্রকাশিত হয়নি। নীতিমালার গেজেট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর,সংস্থার প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বে এ নীতিমালার আওতায় কোন ব্যক্তি বা সংস্থা ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন করতে পারবে না। কোন কোন পত্রিকায় ‘ক’ শ্রেণীর ড্রোন ৫০০ ফুট উচ্চতায় উড্ডয়নের যে তথ্য প্রদান করা হয়েছে তা ভুল। নীতিমালা অনুযায়ী ‘ক’ শ্রেণীর ড্রোন হচ্ছে বিনোদনের কাজে ব্যবহৃত ড্রোন। এ শ্রেণীর ড্রোন বিমানবন্দর কেপিআইয়ের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে উড্ডয়ন করতে পারবে না। তবে ৩-৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ৫০ ফুট উচ্চতায় এবং ৫কজির কম ওজনের ড্রোন উড্ডয়ন করতে পারবে। বিমানবন্দর বা অন্যান্য কেপিআইয়ের ৫ কিলোমিটারের বাইরে ১০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় এবং ৫ কেজির বেশি ওজনের ড্রোন নিবন্ধন ও অনুমতি ছাড়া উড্ডয়ন করা যাবে না। ৫০ থেকে ১০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে সক্ষম এবং ড্রোনের ওজন ৫ কেজির বেশি হলে ‘ঘ’ ব্যতীত যে কোন শ্রেণীর ড্রোন উড্ডয়নের জন্য বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ হতে নিবন্ধন এবং অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে কোন তথ্যের প্রয়োজন হলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিভিল এভিয়েশন অনুবিভাগে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে ড্রোনের ব্যবহার সম্পর্কে বেবিচক সূত্র জানায়- বর্তমানে বিশ^ব্যাপী কৃষি উন্নয়ন, আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ, মশার ওষুধ স্প্রে করা, বিভিন্ন সার্ভে পরিচালনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কাজে ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এদেশেও ব্যক্তিগত, সরকারী, বেসরকারী, সামরিক, বেসামরিক কাজে ড্রোন ব্যবহার বাড়ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার কাজেও এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ড্রোন উড্ডয়ন নীতিমালা না থাকায় অনিয়ন্ত্রিত ও অননুমোদিত ড্রোন ওড়ানোর কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ভঙ্গ বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে এর অপব্যবহার করার আশঙ্কা রয়েছে। ইন্টারন্যাশাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) দেশের বিমানবন্দর এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য ড্রোন উড্ডয়ন নীতিমালা করার পরামর্শ দিয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালার খসড়া অনুযায়ী ব্যবহারের ভিত্তিতে ড্রোনকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক শ্রেণী: বিনোদনের জন্য ব্যবহার। খ শ্রেণী: শিক্ষা ও গবেষণার মতো অবাণিজ্যিক কাজে সরকারী, বেসরকারী সংস্থা বা ব্যক্তিগত ব্যবহার। গ শ্রেণী: সার্ভে, স্থিরচিত্র ধারণ, চলচ্চিত্র নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মতো বাণিজ্যিক ও পেশাদার কাজে ব্যবহার এবং ঘ শ্রেণী: রাষ্ট্রীয় ও সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার। বিমান ও জনসাধারণের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ড্রোন অপারেশন জোনকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রীন জোন: বিমানবন্দর ও গুরত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) তিন কিলোমিটারের বাইরে এবং ৫ কিলোমিটারের কম দূরত্বে ৫০ ফুটের কম উচ্চতায় ড্রোন ওড়াতে অনুমতি লাগবে না। ইয়েলো জোন: প্রবেশ নিষিদ্ধ- এমন এলাকা, সামরিক এলাকা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং সঙ্কীর্ণ এলাকায় অনুমতি নিয়ে ড্রোন চালাতে হবে। রেড জোন: নিষিদ্ধ অঞ্চল, বিপজ্জনক এলাকা, বিমানবন্দর, কেপিআই এবং বিশেষ কেপিআই-এ ড্রোন চালাতে লাগবে বিশেষ অনুমতি। নীতিমালা অনুযায়ী- বিনোদনের জন্য ড্রোন ওড়াতে পারবে যে কেউ। তবে অন্যসব ক্ষেত্রে ড্রোন অপারেট করতে বয়স হতে হবে অন্তত ১৮ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে ন্যূনতম এসএসসি। সরকারের আমদানি নীতিমালা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত পদ্ধতিতে ড্রোন আমদানি করতে হবে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ শ্রেণীর জন্য ৫ কেজির (পেলোডসহ) বেশি ওজনের ড্রোনের ক্ষেত্রে আমদানির আগেই ড্রোনের বিস্তারিত স্পেসিফিকেশন ও সংখ্যা উল্লেখ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। এই অনাপত্তিপত্র পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ড্রোন আমদানি করতে হবে। ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণীর ড্রোন চালাতে বেবিচক নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে নিবন্ধন নিয়ে একটি পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। তবে ‘ক’ শ্রেণীর ড্রোন ১০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় উড্ডয়ন ক্ষমতাসম্পন্ন হলে অথবা ৫ কেজির (পেলোডসহ) বেশি ওজনের হলে ওই ড্রোনেরও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নীতিমালা কার্যকর হলে বেবিচককে প্রতিটি ড্রোনের নিবন্ধন ও পরিচিতি নম্বর সংরক্ষণ করতে হবে। এই নিবন্ধন ও পরিচিতি নম্বর নিবন্ধিত ড্রোনের গায়ে এমনভাবে লিখে রাখতে হবে, যাতে তা সহজে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মোঃ মফিদুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, নীতিমালা তৈরি করায় এখন আগের চেয়ে আরও সহজ হবে ড্রোন ব্যবহার । এতে হয়রানির কিছু নেই। বরং নিয়ম মেনেই সবাইকে ড্রোন ব্যবহার করতে হবে। এই জন্যই একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। নীতিমালা অনুসরণ না করে ড্রোন ওড়ালে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। মোট কথা, এ নীতিমালায় ড্রোনের উড্ডয়নকে নিরাপদ করবে। বেবিচক জানিয়েছে- খোলা জায়গায় যে কোন ড্রোন ওড়ানের আগে ওই এলাকার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোন ভিভিআইপি মুভমেন্ট আছে কিনা, তা নিজ দায়িত্বে জেনে নিতে হবে। ভিভিআইপি মুভমেন্টের ৩ ঘণ্টা আগে থেকে ভিভিআইপি মুভমেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ড্রোন ওড়ানো যাবে না। খোলা স্থানে সভা, সমাবেশ এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক খেলা বা ইভেন্ট চলাকালে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ওই ইভেন্টের জন্য অনুমোদিত ড্রোন ছাড়া অন্য কোন ড্রোন ওড়নো যাবে না। ড্রোন ওড়ানোর সময় অনুমোদনের কপি এবং যে মোবাইল সিমের মাধ্যমে ড্রোনটি নিবন্ধন করা হয়েছে সেটি ড্রোন অপারেটরকে সব সময় সঙ্গে রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষ চাইলে তা দেখাতে হবে। অবকাঠামো, গাছপালা, ফসল, জনগণ ও যানবাহনের অবস্থান বা চলাচল এবং বিমান চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা এসবের জন্য হুমকি সৃষ্টি হয়- এমনভাবে ড্রোন ওড়ানো যাবে না। জনসমাগমের স্থান, যানবাহন চলাচলের স্থান, বাজার বা বাণিজ্যিক এলাকা, আবাসিক এলাকা বা ভবন এবং অফিস-আদালত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে ওড়াতে হবে ড্রোন। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা বা স্থানীয় প্রশাসন ও বেবিচকের অনুমতি নিয়ে ওইসব এলাকায় ড্রোন ওড়ানো যাবে। বিমানবন্দর ছাড়া কেপিআই বা বিশেষ কেপিআইয়ের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ড্রোন পরিচালনার জন্য কেপিআই বা বিশেষ কেপিআই সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। বিমানবন্দরের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ড্রোন পরিচালনার জন্য বেবিচক ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। বাংলাদেশে বিদেশী মিশনে কর্মরত ব্যক্তি বা কূটনৈতিক ড্রোন ওড়াতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়, জননিরাপত্তা, ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা, উড্ডয়ন সুরক্ষাসহ যে কোন প্রকার সম্পত্তির নিরাপত্তা ও সিভিল এভিয়েশনের স্বার্থে বেবিচক ড্রোনের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। নিবন্ধন ছাড়া বা নীতিমালা অনুসরণ না করে ড্রোন ওড়ালে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সাজা ভোগ করতে হবে। ড্রোন অপারেশনের কারণে জনসাধারণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ যে কোন প্রকার ক্ষতি অথবা গোপনীয়তা ভঙ্গের জন্য ড্রোন অপারেটর ও অপারেটরের নিয়োগকারীকে দায়ী করে প্রচলিত আইনে সাজা দেয়া হবে। অননুমোদিত ড্রোন উড্ডয়নকারী এই নীতিমালা অথবা বেবিচকের শর্ত ভঙ্গ করে উড্ডয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা গোপনীয়তা এবং বিমান চলাচলের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ভঙ্গকারী অপারেটর দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য হবেন।
×