ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মহালয়ায় দেবী দুর্গার কাছে করোনামুক্ত শান্তিময় বিশ্বের আর্জি

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

মহালয়ায় দেবী দুর্গার কাছে করোনামুক্ত শান্তিময় বিশ্বের আর্জি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ভোরে চ-ীপাঠের মধ্য দিয়ে আবাহন ঘটেছে দেবী দুর্গার। দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মর্ত্যলোকে। সঙ্কটতারিনী দেবী দুর্গা যখন মর্ত্যলোকে আসছেন, তখন পুরো বিশ্ব জর্জর করোনা মহামারীতে। শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার মহালায় দেবী দুর্গার কাছেই করোনামুক্ত সুখী-শান্তিময় বিশ্বের আর্জি জানালেন ভক্তরা। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ সারাদেশে শুরু হয় মহালয়ার আচার। ঘট স্থাপন, চ-ীপাঠ ও পূজার মধ্য দিয়ে চলে ‘মহাশক্তি, মহামায়া, দুর্গতিনাশিনী’ দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে নেমে আসার আহ্বান। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে উত্তরণের পর সমৃদ্ধশালী পুর্ণ্যভূমির প্রার্থনা জানান দশভূজা দেবী দুর্গার কাছে। হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে বৃহস্পতিবার মহালয়া হলেও দেবীর পূজা এবার আশ্বিনে হবে না। পূজা হবে কার্তিক মাসে। সেই হিসাবে এবার দেবী দুর্গা ‘মর্ত্যে পৌঁছাবেন’ মহালয়ার ৩৫ দিন পর। অর্থাৎ দুর্গোৎসব শুরু হবে ২২ অক্টোবর থেকে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তীও বলেন, ‘মল মাসে পূজাদি করা যাবে না, বৈদিকভাবে নিষেধ আছে।’ মহালয়া উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মন্দির ও পূজাম-পগুলোতে ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। চ-ীপাঠ ছাড়াও মঙ্গলঘট স্থাপন, চ-ীপূজা এবং ঢাক-কাঁসা ও শঙ্খ বাজিয়ে দেবীকে মর্ত্যে আহ্বান জানান ভক্তরা। ভক্তিমূলক সঙ্গীত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় আলোচনা সভা ছিল দিনের আনুষ্ঠানিকতার অংশ। অনেক ভক্তই তাদের মৃত আত্মীয়-পরিজন ও পূর্বপুরুষদের আত্মার সদগতি প্রার্থনা করে তর্পণ করেন। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সব অনুষ্ঠানই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজিত হয়। ভোর ৬টায় ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির আয়োজনে শুরু হয় মহালয়ার আচার অনুষ্ঠান। চ-ীপাঠের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে দেশের বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পীরা আবাহন ও ভক্তিমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরে ঘট স্থাপন করে ফুল, তুলসী ও বেলপাতা দিয়ে পূজার মধ্য দিয়ে চলে মহাশক্তি, মহামায়া, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে নেমে আসার আবাহন। ঢাকেশ^রী মন্দিরে মোমবাতি প্রজ্বলন করে মহালয়া অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যার্টাজি, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার প্রমুখ। পরে মন্দিরের নিজস্ব জলাশয়ে গত বছরের দেবী প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। মন্দিরের পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তীর পরিচালনায় মহালয়ার দিনব্যাপী এসব আচার-অনুষ্ঠান চলেছে। রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ মন্দিরেও ছিল অনুরূপ আনুষ্ঠানিকতা। সেখানে চ-ীপাঠ ও চ-ীপূজা ছাড়াও আবাহন সঙ্গীত পরিবেশিত হয়েছে। গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন ভোর সাড়ে ৫টায় চ-ীপাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে মাথায় রেখে সীমিত আকারে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে বনানী মাঠের পূজাম-পের অদূরে ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে মহালয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছর মহালয়ার ঐতিহ্যবাহী আয়োজন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-এর ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওই অনুষ্ঠানের আদলে সব পরিবেশনা সাজানো হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন প্রখ্যাত শিল্পী প্রমোদ দত্ত, চম্পা বণিক ও ছায়া কর্মকার। গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় ছিলেন খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনোজ সেনগুপ্ত। ফাউন্ডেশনের সভাপতি দিলীপ দাশগুপ্তসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘের (সসকস) পূজাম-পে মহালয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া স্বামীবাগের লোকনাথ মন্দির, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, সিদ্ধেশ^রী কালীমন্দিরসহ রাজধানীর অন্য মন্দির ও ম-পেও ভোরে চ-ীপাঠ, আবাহনী সঙ্গীত, ধর্মীয় আলোচনা সভা ও ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দিনটি উপলক্ষে বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারী টেলিভিশন স্যাটেলাইটগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙ্গানোর বন্দনা পূজা। পরদিন শুক্রবার সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। তবে এবার করোনার কারণে পূজার অনুষ্ঠানমালা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পূজায় আলোকসজ্জা, মেলা, আরতি প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। খোলা জায়গায় অস্থায়ী প্যান্ডেলে স্থাস্থ্যবিধি মেনে পূজা করার বিষয়েও সংশ্লিষ্ট আয়োজকদের অনুমতি নিতে হবে। করোনার সংক্রমণ এড়াতে সামাজিত দূরত্ব রক্ষা, ভিড় এড়ানো এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার জানান, এ বছর ঢাকায় ২৩৮টির মতো ম-পে পূজা হবে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরের ৫০ থানা কমিটির সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে করা যাবে, তা নিয়ে আরও কয়েকটি বৈঠকের পর সারাদেশে পূজাম-পের সংখ্যা নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি জানান, পূজাম-পে বয়োবৃদ্ধদের আসতে নিরুৎসাহিত করা হবে। তারা যেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে অঞ্জলি দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা রাখতে প্রতিটি কমিটিকে বলে দেয়া হবে।
×