ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্ফোরণ গ্যাস লিকেজেই ॥ নারায়ণগঞ্জে মসজিদের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিস্ফোরণ গ্যাস লিকেজেই ॥ নারায়ণগঞ্জে মসজিদের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তিতাসের গ্যাস পাইপ লাইনে লিকেজ থেকে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও এর কোন দায় নিল না তিতাস। বিতরণ কোম্পানিটি বৃহস্পতিবার বিকেলে বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় তিতাস কিভাবে দায়ী তা তারা বুঝতেই পারছে না। তবে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন সবে আমরা হাতে পেয়েছি কারও দায় থাকলে অবশ্যই তাদের খুঁজে বের করা হবে। দুর্ঘটনার পর জ্বালানি বিভাগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল ওহাবকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটির বাকি চার সদস্যও তিতাসেরই কর্মকর্তা। ফলে তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ হয়েছে একই সঙ্গে তদন্তে তিতাস নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কী না এসব বিষয়ে এরমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। তবে নিজেদের দায় এড়িয়ে গেলেও ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে এজন্য আঞ্চলিক বিপণন বিভাগ- নারায়ণগঞ্জকে অবিলম্বে তাদের গ্যাস পাইপ নেটওয়ার্ক, বিভিন্নসংযোগ পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত করার এবং লিকেজ স্থান অবিলম্বে মেরামতের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া উক্ত অফিসকে তাদের নিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কে কিছু দিন অন্তর অন্তর পরীক্ষা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বরের এই ঘটনায় আগুনে পুড়ে ৩১ জন মারা গেছেন। আর একজন বাড়ি ফিরতে পারলেও এখনও চারজন হাসপাতালেই রয়ে গেছেন। মসজিদে অগ্নিকান্ডের এই ঘটনা সম্প্রতি বছরগুলোর মধ্যে সব থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তিতাস তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলছে তিতাসের গ্যাস পাইপ লাইন বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে লিকেজের সৃষ্টি হয়েছে। এই লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমেছে। আর সেই জমা গ্যাস আগুনের সংস্পর্শে এসে আগুন ধরেছে। মসজিদের দুটি বিদ্যুত লাইনের একটি বিদ্যুত লাইন অবৈধ। তিতাস বলছে গত রমজান মাসে মসজিদ কমিটি মৌখিকভাবে লাইনটি নিয়ে ছিল। একটি লাইনে বিদ্যুত চলে গেলে আরেকটি লাইন থেকে বিদ্যুত ব্যবহারের জন্য লাইনটি সুইচ টিপে লাইন পরিবর্তনের সময় স্পার্ক থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তিতাস বলছে ১৯৮৭ সাল থেকে ওই এলাকায় তারা গ্যাস বিতরণ করে। আর সেখানে মসজিদটি টিনশেড ঘর থেকে স্থায়ী বিল্ডিং করা হয় ১৯৯৬ সালে। তদন্তে দেখা গেছে শওকত আলী (গ্রাহক সংকেত নং ০১১০৬০১৫১৫৫১৮) এবং জনাব মোঃ বারেক দেওয়ান (গ্রাহক সংকেত নং- ০১১০৬০৫২৬৩১৮) কে। এর দুটি গ্যাস সংযোগ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা নিজ উদ্যোগে, কোম্পানিকে না জানিয়ে রাইজার স্থানান্তর করে। তিতাস বলছে এটি তারা জানত না। তারা জানলে স্থায়ীভাবে লাইনটি অপসারণ করে ফেলত। এতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না। কিন্তু এভাবে পাইপ লাইন পরিত্যক্ত রাখায় সেখানে লিকেজের সৃষ্টি হয়েছে। তিতাসের এ ধরনের সব কাজই করে দেয় ঠিকাদারা। এসব ঠিকাদার নিয়োগও দেয় তিতাস। পরে দুর্ঘটনা ঘটলে তিতাস যেমন দায় এড়িয়ে যায় আবার সেই ঠিকাদারও খুঁজে পাওয়া যায় না। তিতাস দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে বলছে তাদের এক ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয় যা থেকে তিনটি আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়। যার একটি ছিল মসজিদের দক্ষিণে এবং অপর ২টি মসজিদের উত্তর দিকে ছিল। মসজিদের উত্তর পাশের রাস্তায় সংযোগ দুটির সার্ভিস লাইন প্রায় ৪’-০’’ ফুট মাটির নিচে ছিল। মসজিদের পূর্ব পশের তিতাস গ্যাসের ১’’ ০ ব্যাসের একটি বিতরণ লাইন ছিল। এছাড়া মসজিদের উত্তর পাশের রাস্তায় ২টি ৩/৪’’ ব্যাসের পরিত্যক্ত সার্ভিস লাইন রয়েছে। মসজিদের উত্তর পূর্ব হতে উত্তর দিকের ৪ নম্বর কলামের বেজ ওই সার্ভিস লাইনের নিচ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বেজ নির্মাণ করার সময় মাটি খনন, সাটারিং স্থাপন কাজে কোদাল, গেতি, হাতুড়ি ব্যবহার হয়েছে। এতে করে পাইপ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইপের উপরি ভাগ ডেবে গেছে এবং গ্যাস লাইনের ট্যাপিং নষ্ট হয়েছে। গ্যাস পাইপ (এমএস পাইপ) মাটির সংস্পর্শে এসে মরিচাজনিত কারণে পাইপে লিকেজের সৃষ্টি হয়েছে। মসজিদ কমিটি মসজিদের কলামের বেজ তৈরি করার সময় তিতাস গ্যাসকে জানালে উক্ত সার্ভিস লাইন অপসারণ করতে বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করে দিত। এতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না। দুর্ঘটনার পর থেকেই তিতাসের পাইপ লাইনে লিকেজ থাকার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর আগেও বিস্ফোরক পরিদফতর এবং ফায়ার সার্ভিস তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে লিকেজ থাকার বিষয়টি আলোচনার আনে। মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয়রা অভিযোগ করে তিতাসের কাছে বার বার অভিযোগ করার পরও তারা লাইনটি ঠিক করেনি। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল ওহাব বলেন, আমরা মসজিদ কমিটির সভাপতি স্থানীয় কমিশনার এবং মসজিদটির আশপাশের মানুষদের কাছে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। এছাড়া তিতাসের স্থানীয় কার্যালয়ের ছয় মাসের কল রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখেছি সেখানে এ ধরনের কোন অভিযোগ করার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আব্দুল ওহাব বলেন, এত বড় শক্তিধর কোন ব্যক্তি তা আমাদের বোধগম্য নয়। যে তার নামটিই মসজিদ কমিটির সভাপতি বলতে পারছেন না। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মাটির নিচের গ্যাসের পাইপ লিকেজ হলে সেখান থেকে গ্যাস বের হওয়টা স্বাভবিক। কিন্তু যেহেতু সেই গ্যাসের কোন প্রেসার থাকে না তাই ওই গ্যাস যে কোন ফাঁকা জায়গায় জমা হয়। মসজিদের উত্তর দিকের পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৪ ইঞ্চি পুরুত্ব বিশিষ্ট আরসিসি ঢালাই করা রাস্তা থাকায় লিকেজ থাকলেও সেখান দিয়ে গ্যাস বের হতে পারেনি। কিন্তু পাইপ লাইনের পাশেই মসজিদের দেয়াল। কিন্তু সেই দেয়ালের নির্মাণ মান খুবই খারাপ ছিল সেখানে কোন আস্তর ছিল না। এছাড়া মসজিদের ফ্লোর টাইলস সংযোগ স্থল দিয়ে তা মসজিদের ভেতরে জমা হয়েছে। গ্যাস সরাসরি উপরের দিকে বের হতে পারেনি। পাইপ লাইন তিতাসের গ্যাসর তারাই সরবরাহ করে এখানে লিকেজ থাকলে তার দায় তিতাসের ওপর কেন বর্তাবে না এমন প্রশ্নে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ না করলে আমরা জানব কি করে যে পাইপ লাইনে লিকেজ রয়েছে। এমনতো নয় যে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেছে আর আমরা সেটা ঠিক করতে যাইনি। এ সময় তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোঃ আল মামুন বলেন, আমরা অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপ লাইন সংস্কার করছি। কোথাও আমরা অভিযোগ পেয়েছি আর পাইপ লাইন ঠিক করতে যায়নি এমন কোন অভিযোগ নেই। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্রাহকেরও কিছুটা সচেতনতা দরকার রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রাহক যদি কিছুটা সচেতন হয়। এ ধরনের লিকেজের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেন তাহলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাদের সকলে মিলে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। প্রতিমন্ত্রী বলেন তিতাস তদন্ত রিপোর্টটি আমাদের দিয়েছে। আমরা এটি বিশ্লেষণ করে দেখব। এটি নিয়ে মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে কাজ করবে। এখানে তিতাসের কোন দায় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আহত ও নিহতদের পরিবারে আর্থিক অনুদান প্রদান ॥ স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, পশ্চিমতল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবারের মাঝে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ। নিহত ৩১ ও আহত আটজনের পরিবারের স্বজনদের হাতে মোট ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা তুলে দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে তল্লার বড় জামে মসজিদ সংলগ্ন ঈদগা মাঠে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইয়ের সভাপতিত্বে নিহত ও আহতের প্রত্যেক পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ মোঃ বাদল, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডাঃ আবু জাফর চৌধুরী বিরুসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় নিহতদের স্মরণে এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে দোয়া করা হয়। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় যারা নিহত ও আহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পাশে আছেন। ভবিষ্যতেও থাকবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে মসজিদের অভ্যন্তরে জমে থাকা গ্যাস জমাট বেঁধে বিদ্যুতের স্পার্ক থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে বলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদ নির্মাণে ত্রুটি, মসজিদের সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলা, রাজউক ও মসজিদের সামনের রাস্তা নির্মাণসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খাদিজা তাহেরা ববি। তবে বিস্ফোরণে জন্য তদন্তে এককভাবে কাউকে দায়ী করা হয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি ১৮টি সুপারিশ করেছেন বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান। ঘটনার পর ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের হাতে জমা দেন পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের মাঝে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ। বিস্ফোরণে নিহত ৩১ জন ও আহত আটজনের পরিবারের স্বজনদের হাতে মোট ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা তুলে দেয়া হয়। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের সময় উপস্থিত ছিলেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খাদিজা তাহেরা ববি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ টি এম মোশারফ হোসেন, ডিপিডিসির পূর্ববিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোরশেদ, ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফিন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলাম।
×