ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শর্মিষ্ঠা পণ্ডিত

শাস্ত্রীয় নৃত্য কথন

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

শাস্ত্রীয় নৃত্য কথন

কাউকে শাস্ত্রীয় নৃত্য দেখার আমন্ত্রণ জানালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাকে যা শুনতে হয় তা হলো ‘শাস্ত্রীয় নৃত্য আসলে তেমন বুঝি না’। শাস্ত্রীয় নৃত্য, যা সত্যিকার অর্থেই আয়ত্ত করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য তা বুঝতে হলে দর্শকের চিন্তা ও বোধের সীমার পরিব্যাপ্তিও যথেষ্ট উদার হতে হয় বৈকি! ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য ৮ প্রকারের এবং এর যে কোনটি আয়ত্ত করতে গেলে দীর্ঘসময় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজন অটুট মনোবল, অসীম ধৈর্য এবং গুরু ও নৃত্যের প্রতি অপরিসীম ভক্তির। এই শিক্ষার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, যদিও নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য কোর্সগুলোর সময় বেধে দেয় কিন্তু আসলে এই শিক্ষা প্রক্রিয়া একজন নৃত্যশিল্পীর আজীবন চলতে থাকে নতুন নতুন মুদ্রা ভঙ্গি শেখা এবং চর্চার মধ্য দিয়ে। এত কষ্টসাধ্য যে বিদ্যা সেটি কেন অনেকের কাছে অবোধ্য? এর একটি কারণ হতে পারে সংস্কৃতির পার্থক্য, শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলো প্রায় পুরোপুরি হিন্দু পুরাণ নির্ভর, সে কারণে হিন্দু পুরাণ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে এই নাচ বোঝা কঠিন, দ্বিতীয়ত ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, শাস্ত্রীয় নৃত্যে ব্যবহৃত গান বা পাঠগুলো সাধারণত সংস্কৃত এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা হয়ে থাকে তাই সেসব ভাষা জানা না থাকলে গানের বিষয় অবোধ্য থেকে যায়, যে কারণে নৃত্যের রসও সম্পূর্ণভাবে আস্বাদ করা যায় না। সেই সঙ্গে নাচের কিছু প্রচলিত মুদ্রা সম্পর্কেও ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় যেন নৃত্যের ভাষা বোঝা যায় কারণ যে কোন নাচই আসলে কোন না কোন গল্প বা কাহিনী উপস্থাপন করে। সমসাময়িক অনেক নাচ বা তুলনামূলক আধুনিক নাচগুলোর মতো শাস্ত্রীয় নাচের মুদ্রাগুলো ততটা সহজবোধ্য নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় নাচের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় হিন্দু পুরাণের নানা কাহিনী বিশেষত দেবদেবীদের কাহিনী। সেক্ষেত্রে দর্শকের যদি হিন্দুদেব তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকে তাহলে সে কি করেই বা এ নৃত্যের ভাষা বুঝবে? যদি শাস্ত্রীয় নাচের মাধ্যমে শুধু হিন্দু পুরাণই নয় যে কোন কাহিনীই উপস্থাপন করা সম্ভব। দর্শক যদি জেনে থাকে যে দুর্গার দশটি হাত বা গণেশের শরীরের উপর হাতির মাথা বসানো এবং কেন গণেশের মাথা হাতির মতো হলো সেই কাহিনী তাহলে সে নৃত্যশিল্পীর প্রতিকায়িত অঙ্গভঙ্গি বুঝবে এবং তা উপভোগও করবে। সেই সঙ্গে নাচের মৌলিক মুদ্রা সম্পর্কেও জানতে হবে, নাচের মুদ্রাগুলো সব আমাদের চার পাশের প্রকৃতি ও জীবনা চরণের সামগ্রীগুলোকে উপস্থাপন করে। এবার আসি কেন শাস্ত্রীয় নৃত্য সবার কাছে বোধগম্য নয় সে প্রসঙ্গে। আমি প্রথমেই বলেছি যে এর একটা কারণ সংস্কৃতির পার্থক্য। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রত্যেকটি ভারতের কোন প্রদেশের আঞ্চলিক নৃত্য। ধরা যাক ভরত নাট্যমের কথা। এটি সবচেয়ে পুরনো একটা নাচের ফরম যেটি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশে উদ্ভাবিত হয়েছিল দুই হাজার বছরেরও আগে। বলাবাহুল্য এই নাচ হিন্দু পুরাণকেই চিত্রিত করে এবং এতে ব্যবহৃত গানের ভাষা সংস্কৃতও দক্ষিণ ভারতের প্রাদেশিক ভাষা। দক্ষিণ ভারতের ঘরে ঘরে এ নাচের চর্চা করা হয়েছে এবং হচ্ছে এবং এ চর্চা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, এটা মূলত ঈশ্বরের আরাধনার একটা মাধ্যম এবং সেদেশের অধিবাসীদের জীবনাচরণের একটি অংশ। একে টেম্পল ডান্স বলা হয় কারণ এই নাচ মন্দিরে দেবদাসীদের দ্বারা প্রদর্শিত হতো বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। এখন, যে মানুষটি জন্মেছে দক্ষিণ ভারতে, যে বড় হয়েছে ভরতনাট্যম দেখে এবং যার মাতৃভাষাতেই এই নাচের গান ও বোল রচিত তার তো এই নাচ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নৃত্যশিল্পীর আঙ্গিক মুদ্রা ও অভিব্যক্তি দেখলেই সে বুঝতে পারবে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে কি বলা হচ্ছে বা হিন্দু পুরাণের কোন কাহিনী বলা হচ্ছে। কিন্তু যে মানুষটি জন্মেছে দক্ষিণ ভারত থেকে বহু দূরে, ধরা যাক বাংলাদেশে, যার ভাষা ভিন্ন, হিন্দু পুরাণ যদি সে কখনও পড়ে না থাকে এবং শাস্ত্রীয় নৃত্য যে কোনদিন দেখেনি সে কি করে ভরত নাট্যম নাচ উপভোগ করবে? শস্ত্রীয় নৃত্যগুলোর ভাবগাম্ভীর্যের কারণেই বোধ হয় এগুলোর বাণিজ্যিক প্রচার ও প্রসার কম (যদিও দক্ষিণ ভারতে এই নাচের যথেষ্ট প্রচার ও প্রসার রয়েছে কিন্তু তার বাইরে এর প্রসার এখনও ততটা দেখা যায় না) বাজনপ্রিয় সিনেমা বা অনুষ্ঠানে এ নাচ প্রদর্শিত হয় না। যে কারণে এর দর্শক সংখ্যাও কম। কিন্তু কোন অনুরাগী যদি শাস্ত্রীয় নাচের ব্যাপারে আগ্রহী হন, তাহলে তার সে বিষয়ে গবেষণা ও পড়াশোনাই তার রুচি তৈরি করবে, পারফরম্যান্স দেখতে দেখতে তার দেখার চোখ তৈরি হবে এবং তখন শাস্ত্রীয় নৃত্য আর অবোধ্য তো থাকবেই না বরং সে এই নাচগুলোর সৌন্দর্য পুঙ্খানুপুঙ্খ উপভোগ করবে। শাস্ত্রীয় নৃত্য সবসময় গুরুশিষ্য পরম্পরা মেনে চলে, বছরের পর বছর একাগ্রচিত্তে সাধনা করলেই তবে এই শিল্প আয়ত্ত করা যায়। তাই এ শিল্পের নিগূঢ় দর্শন ভালভাবে জেনে মঞ্চে নামা নৃত্যশিল্পীর জন্য যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি দর্শকের মানসিকতাও এমনি থাকতে হবে যে, এই নৃত্যশৈলী শুধুমাত্র ক্ষণিক মানসিক পরিতৃপ্তির জন্য নয়, এ হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই ছান্দিক পরিভাষা, যা এই প্রকৃতি এমনকি মহাবিশ্বেও স্পন্দিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শেষ করছি নৃত্যের দেবতা নটরাজের কথা দিয়ে, হিন্দু পুরাণ অনুসারে সমগ্র মহাবিশ্বে নটরাজের নৃত্য চলছে অবিরত সৃষ্টি ও প্রলয়ের মধ্য দিয়ে। নটরাজের এই নৃত্য সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, অনুগ্রহ বা বন্ধনমুক্তি এবং তিরোভাব বা জাগতিক বিভ্রম উন্মোচন এই পাঁচটি পারমার্থিক বিষয়কে রূপায়িত করে। তেমনি প্রতিটি পারফর্মেন্সই মূল অর্থে নৃত্যশিল্পী ও দর্শকের জন্য এক নান্দনিক ও পারমার্থিক অভিজ্ঞতা, যা জাগতিক অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে গভীরতর বোধের ব্যাপ্তি ঘটায়। প্রবাসী নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার
×