ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভুয়া এনআইডি দিয়ে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছে প্রতারক চক্র

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

ভুয়া এনআইডি দিয়ে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছে প্রতারক চক্র

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। এই কাজে তাদের সহায়তার জন্য কোন কোন ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে। এজন্য তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্যই ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি তৈরি করত। গত দুই বছরে তারা অন্তত ৬৫-৭০টি ভুয়া বা দ্বৈত এনআইডি কার্ড তৈরি করছে। তারা এই ভয়ানক প্রতারণা করে রাজধানীতে একাধিক বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছেন। এ রকমই প্রতারক চক্রের গ্রেফতারকৃত নির্বাচন কমিশনের দুই কর্মীসহ পাঁচজনকে রিমান্ডে দ্বিতীয় দিনে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত শনিবার রাতে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের ডি ব্লক থেকে নির্বাচন কমিশনের দুই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরসহ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতাররা হচ্ছেÑ নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২) ও আনোয়ারুল ইসলাম (২৬) ও তাদের দুই দালাল সুমন পারভেজ ও মজিদ। এছাড়া আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে আরেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত মামুন নিজের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে স্ত্রীর নামে আরেকটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ জানান, রিমান্ড নিয়ে গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা কাকে কাকে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দিয়েছিল তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। চক্রটি ব্যাংক ঋণ পাস হলে সেই ঋণের ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রের হোতা সুমন পারভেজ ও মজিদ। তারা গ্রাহক খুঁজে এনে নির্বাচন কমিশনের দুই কর্মী সিদ্ধার্থ ও আনোয়ারুলের কাছে নিয়ে যেত। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তাদের তৈরি করে দেয়া জাল এনআইডি দিয়ে মিল্টন নামে এক ব্যক্তি সাউথ বাংলা এ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের শাখা থেকে তিন কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ইয়াছির নামে এক ব্যক্তি সিটি ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখা থেকে দশ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। সালেহ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। আব্দুল মজিদ নামে এক ব্যক্তি এনআরবি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। গ্রেফতার হওয়া আব্দুল্লাহ আল মামুন নিজেই ভুয়া এনআইডি দিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৯ লাখ ২৫ হাজার ও সিটি ব্যাংকের নিকেতন শাখা থেকে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই চক্রের মাধ্যমে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে আশিক নামে এক ব্যক্তি ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা, জাভেদ নামে এক ব্যক্তি লংকা-বাংলার ধানম-ি শাখা থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা ও জহুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি মেঘনা ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এরা ছাড়াও বাকি যারা ভুয়া বা জাল এনআইডি নিয়েছে, তারা প্রত্যেকেই কমবেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে জালিয়াতি করে নেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা হবে। আলোচিত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম জানান, জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক নাম বেরিয়ে আসছে। তিনি জানান, এরা জালিয়াতি করে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে। তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে কতজন ভুয়া এনআইডি নিয়েছে তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ডিবি পুলিশ জানায়, এই চক্রের এক হোতা সুমন আগে আরএম গ্রুপে চাকরি করত। মজিদ ছিল ব্যবসায়ী। বছর দুয়েক আগে তারা নির্বাচন কমিশনের গুলশান ও খিলগাঁও কার্যালয়ের দুই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে জাল এনআইডি তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। যারা একবার ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপী হয়েছে তাদের সাধারণত দ্বিতীয়বার কোন ব্যাংক ঋণ দিতে চাইত না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এনআইডির মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতার তথ্য সংরক্ষণ করত। এ কারণে এই চক্রটির মাধ্যমে ঋণ খেলাপী অনেকেই ভুয়া এনআইডি তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিত। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রের সঙ্গে কোন কোন ব্যাংকের কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছে, ইয়াছির নামে এক ব্যক্তি সিটি ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখা থেকে দশ লাখ টাকা ঋণ নেয়ার সময় ওই ব্যাংকের আরিফ নামে এক কর্মকর্তা ইয়াছিরকে ঋণ পেতে সহায়তা করে। এ কারণে আসামিদের কাছ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কেউ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত কিনা তাও জানার চেষ্টা চলছে। ডিবি সূত্র জানায়, প্রতারক চক্রের হোতা সুমন ও মজিদ জালিয়াতি করে ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি কিনেছে। সুমনের উত্তরায় নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে। মজিদের মিরপুরসহ রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও গাড়ি রয়েছে। গত দুই বছর ধরে তারা মূলত জাল এনআইডি তৈরির কাজই করত।
×