ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকিপূর্ণ জেনেভা ক্যাম্পে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষাসহ স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

ঝুঁকিপূর্ণ জেনেভা ক্যাম্পে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষাসহ স্বাস্থ্যসেবা

ওয়াজেদ হীরা ॥ বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের একটি লাইনে এসে পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছেন। কেউ করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। কেউ রোগের উপসর্গ বলছেন। ডাক্তাররা রোগের বিবরণ শুনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হিসেবে প্রেসক্রিপশন এবং ওষুধ দিচ্ছেন বিনামূল্যে। বিনা পয়সায় করোনার পরীক্ষাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবার পরামর্শে ওষুধ পাওয়ায় সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লাইন দীর্ঘ হতে দেখা গেছে। দৃশ্যটি রাজধানীর অত্যন্ত ঘনবসতি এলাকা মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের। যেখানে মানুষের ভিড়ে হাটাও মুশকিল। নেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা, আর করোনার ঝুঁকিও চরমে। আর সেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘনবসতি এলাকায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে ‘নিজ বাড়ি নিজ হাসপাতাল, করোনামুক্ত বাংলাদেশ’ প্রকল্পের স্বাস্থ্যকর্মী ও মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা। যারা এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন অন্যান্য এলাকায় সেবা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। দেশকে করোনামুক্ত করতে তিন প্রতিষ্ঠানে সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠা এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশসেরা বক্ষব্যধি চিকিৎসক প্রফেসর ডাঃ মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান। জানা গেছে, রাজধানীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এই জেনেভা ক্যাম্প। ৪৩ হাজার বর্গফুট ক্যাম্পে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের ওপরে। সে হিসাবে প্রতিজন মানুষের জন্য জায়গা বরাদ্দ ২.৮৬ বর্গফুট। এর মধ্যে রয়েছে খাবার, মুদি, টেইলারিংসহ নানা ধরনের দোকান আর ক্যাম্পের ভেতরে যাতায়াতের রাস্তা। এসব বাদ দিলে একজন মানুষের জন্য বরাদ্দ এক মিটার জায়গারও কম। এমন স্থানে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই এই ক্যাম্পের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে সেবা দিতে এগিয়ে এসেছেন ‘নিজ বাড়ি নিজ হাসপাতাল, করোনামুক্ত বাংলাদেশ’ প্রকল্প। বুধবার থেকে ঘনবসতিপূর্ণ জেনেভো ক্যাম্পের সেবা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে বসবাসরত মানুষদের সেবা দেয়ার লক্ষ্যে তিনটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট বুথে মানুষ এসে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছেন। একটি এসপিজিআরসি বুথ, আল-আলফা ক্লিনিক এবং এনএলজে হাইস্কুল বুথ। সরেজমিনে বিভিন্ন বুথে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের ভিড় দেখা গেছে। এসপিজিআরসি বুথে সেবা নেয়া মোঃ মহিউদ্দিন (৫৫) বলেন, এখানে টাকা ছাড়াই সেবা পাচ্ছি এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। শরীরে ব্যথাসহ করোনা আছে কিনা জানতে এসে ওষুধও পাইছি টাকা ছাড়া। নুরুদ্দিন খান বলেন, আমাদের এখানে অনেক মানুষ করোনা আতঙ্কেতে আছে এমন সেবাটা সত্যি দরকার ছিল। এ সময় সেবা দেয়া ডাক্তার টিমদের প্রশংসা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এসপিজিআরসি বুথের টিম লিডার মোঃ মাসুম বলেন, আমাদের এই ক্যাম্পে প্রায় লাখো মানুষের বসবাস। খুব ঘনবসতি। কোন চিকিৎসা নেই বললেই চলে। করোনার এই সময়ে ঘরে ঘরে এই চিকিৎসা খুব উপকার হবে। যা বলে বুঝানো যাবে না। গত ৯ই আগস্ট থেকে মোহাম্মদপুরের খিলজিরোড করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য সেবা দেয়ার কাজ শুরু করে এই প্রকল্পটি। ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার, ট্রাই ফাউন্ডেশন ও সৌহার্দ ফাউন্ডেশন একত্রে কাজ করছে। ‘নিজ বাড়ি নিজ হাসপাতাল, করোনামুক্ত বাংলাদেশ’ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যখন বুঝলাম করোনা নিয়ে মানুষ কিছু বলতে চায় না, বা জানাতে চায় না। অথচ অসুখ বেশি হলে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে। মানুষকে নিজের বাড়িই হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করতে এই নাম দেয়া হয় নিজ বাড়ি নিজ হাসপাতাল। অর্থাৎ আপনি দ্রুত রোগের কথা বলুন সেবা নিন এবং বাড়িতে থেকে সুস্থ হোন। এই প্রকল্পের কয়েকটি দল রয়েছে। দলের মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টরা ঘরেই স্যাচুরেশন লেভেল, পালসরেট, ও প্রেসার নির্ণয় করে প্রাথমিক সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করছেন। মোহাম্মদপুরের খিলজিরোড থেকে শুরু করে পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটি, বাবর রোড, হুমায়ুন রোড এবং লালমাটিয়ায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে মোট ৩,৭৮৮টি পরিবারের ১৫,১১২ জন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এবং শুধু লালমাটিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ২,০৮২টি পরিবারের ৮,১১০ জন ব্যক্তির। এদের মধ্যে সন্দেহভাজন রোগীদের প্রকল্পের গাড়িতে করে সেন্টারে নিয়ে এসে শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন সারা ঢাকাশহর থেকে যে কেউ এই সেবা নিতে পারবেন। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে আগামী অক্টোবর মাস থেকে ঢাকার বাহিরে জেলা শহরে সেবা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বলেও জানা গেছে। বুধবার এসপিজিআরসি বুথে সেবা কার্যক্রম দেখতে এসে ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডাঃ মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, করোনা শুরুর পর থেকে খুব কাছ থেকে সেবা দিতে গিয়ে এটা বুঝেছি যত দ্রুত চিকিৎসা তত দ্রুত আরোগ্য। আইসিইউতে গেলে অনেক রোগী জটিল হয়। এখনও অনেকের মধ্যে করোনা নিয়ে ভয় আছে মুখ খুলতে চায় না। আমাদের কর্মীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মনোনীত লোক সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি। তাদের সমস্যাগুলো তখন অনেকেই বলছেন। আমরা দেখেছি শতকরা ৮২ জন মানুষের ফুসফুসে ভাইরাসটি নীরবে বিস্তার ঘটায় তাই এক্সরের সাহায্যে চিকিৎসাসেবা দ্রুত শুরু করতে পারছি। আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো সরকারী-বেসরকারী সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা যাতে করোনা মুক্ত দেশ গড়তে পারি। ট্রাই ফাউন্ডেশন সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন বাবুল বলেন, আমরা এখানে তিনটি টিম নিয়ে কাজ করছি। টিমের সদস্যরা প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যাচ্ছে, তথ্য নিচ্ছে সেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। মানুষ আগ্রহ নিয়ে আসছেন এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা পাচ্ছেন। আমরা সাবধানতা অবলম্বন করে করোনা পরাজিত করব এজন্য রণকৌশল পরিবর্তন করেছি। প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মোঃ রবিউল আলম, আমাদের এই কার্যক্রম অক্টোবর থেকে সারাদেশে নিয়ে যাচ্ছি। ৬ অক্টোবর থেকে গোপালগঞ্জ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গের জেলায় আমরা যাব। আমাদের টিম যাবে। এই প্রকল্পের অধীনে এলাকাবাসীকে সাধারণ চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি করোনা উপসর্গ আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পুরো ঢাকাবাসীর জন্য করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও করোনা রোগী শনাক্ত হলে বাংলাদেশে ব্যবহৃত ওষুধ ফেভিপিরাভিরের পূর্ণডোজ বিনামূল্যে দিচ্ছে এই প্রকল্পটি। এছাড়াও করোনা শনাক্তকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে সিবিসি ও এক্সরে, এবং প্রয়োজনে আইইডিসিআর-এর অধীনে আরটি-পিসিআর এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে যার কোন খরচ রোগীকে বহন করতে হবে না। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোট ১২৫ জনকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে যার মধ্যে ২১ জনকে ফেভিপিরাভির ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিটি রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ডোজ যার মূল্য ১৪ হাজার টাকা যা বিনামূল্যে দিচ্ছে। রোগীদের ওষুধ সেবন নিশ্চিত করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার পরে ও এক সপ্তাহ পরের ফলোআপ ভিজিটের ব্যবস্থাও করেছে প্রকল্পটি। করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও ওষুধের পাশাপাশি কোন রোগীর অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন হলে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের মাধ্যমে প্রথম ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সেবা দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। ঢাকার যে কেউ এই প্রকল্পের স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন সরাসরি প্রকল্পটির সেন্টার ৪১, রিংরোড, শ্যামলীর ‘ইনজিনিয়াস পালমো-ফিট’ এ এসে, বা যোগাযোগ করতে পারেন ০১৭০১৬৭৭৭১০ নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়েছেন।
×