ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের কথা স্বীকার করল মিয়ানমার

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের কথা স্বীকার করল মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্বীকার করে আসার পর এই প্রথম মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে স্বীকার করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপকহারে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিবৃতিতে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতার বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রমাণসমূহ নষ্ট করার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। গত সোমবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ বিবৃতি দেয়ার পর বার্তা সংস্থা রয়টার্স তা বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের গভীর রাতে পরিচালিত সেনা অভিযানে জড়িত দুই সদস্য আন্তর্জাতিক আদালতে ঘটনার সত্যতা ফাঁস করে দেয়ার পর বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এদিকে রাখাইনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে নতুন এক প্রতিবেদনে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রকাশিত বিবৃতির বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের আগে ও পরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলেছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে এও দাবি করা হয়েছে, সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী, সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নয়। বিবৃতিতে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে অপরাধ সংঘটনের জন্য কিছু সেনা সদস্যের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কি সাজা দেয়া হয়েছে তা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন বার্তা সংস্থায় উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন, চীন, শান, কাচিনসহ বিভিন্ন প্রদেশে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বর্তমানে যে ৪৫তম অধিবেশন চলছে তাতে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়েও আলোচনার কথা রয়েছে। সীমান্তে নতুন করে সেনা সমাবেশ যে কারণে- গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে মিয়ানমার পক্ষ নতুন করে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। এর কারণ হিসাবে সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন সূত্রে বুধবার জানানো হয়েছে, সে দেশে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির (এএ) ভিশন, আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের দুই সেনা সদস্যের গণহত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, বিদ্রোহী আরাকান আর্মি ও আরসার মধ্যে সমঝোতার ঘটনা নিয়ে সম্ভাব্য বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা রোধে সীমান্তে নতুনভাবে সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। সূত্রে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের বেশকিছু অঞ্চল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। মিয়ানমারের পাত্তরকিল্লা এলাকায় সম্প্রতি আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের বেশকিছু সদস্য আহত হয়। এদের মধ্যে ১০ রোহিঙ্গা রয়েছে। আহত এ রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছে আরাকান আর্মির ক্যাডাররা। যেসব এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের কোন সদস্য প্রবেশ করতে পারে না। সেখানে বাজার বসিয়েছে আরসা ও আরাকান আর্মির সদস্যরা। অপরদিকে আগামী ৮ অক্টোবর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রোহিঙ্গা নেতার মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দিয়েছে। এতে করে আরসার সঙ্গে আরাকান আর্মির সৌহার্দ্য আরও বেড়েছে। এ দুই সংগঠনের মধ্যে একটি সমঝোতাও নাকি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় গ্রুপের মধ্যে রয়েছে ভারী অস্ত্র। এদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর অবস্থান গহিন অরণ্যে। এর উপর রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার কার্যক্রম বাংলাদেশের কক্সবাজারে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার বিষয়টি অবহিত হয়েছে মিয়ানমার পক্ষ। মূলত এসব ঘটনা নিয়েই সীমান্তে নতুন করে সৈন্য সমাবেশের ঘটনা ঘটেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে সেনা সমাবেশ ঘটানোর বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদপত্র প্রদানের পর বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) বিজিপিকে (বর্ডার গার্ড পুলিশ) এ পর্যন্ত তিনটি পত্র দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষ এখনও সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়নি। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হলেও এর কোন উত্তর এখনও মেলেনি। জানা গেছে, ওপারে সীমান্তরক্ষী দল বিজিপির কাছে প্রেরিত পত্র প্রথমে যাবে মংডুতে। এরপর যাবে রাখাইনের রাজধানী সিটওয়েতে। সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক কোন চাপের বিষয় উপলব্ধি করতে পারলেই মিয়ানমার পক্ষ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ফেলে। অতীতে এ ধরনের বহু নজির রয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার এ যাবতকাল তাদের কোন আন্তরিকতা এবং প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে পারেনি। মিয়ানমার পক্ষ বাংলাদেশে এসে কয়েক দফায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কথা জানালেও এর কোন কার্যকারিতা এ পর্যন্ত মিলেনি। এর পাশাপাশি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দাবি রয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ এখনও হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার বাংলাদেশে করার দাবি ॥ রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারপূর্ব যে শুনানি হবে, সেটি যেন নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পরিবর্তে অন্য কোন দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে আদালত বসিয়ে করা হয়, সেরকম একটি আবেদন ইতোমধ্যে পেশ করা হয়েছে। বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সব কার্যক্রম সাধারণত চলে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে। কিন্তু এই প্রথম এরকম কোন উদ্যোগ নেয়া হলো যেখানে নির্যাতিতদের শুনানির জন্য আদালতকেই অন্য কোন দেশে বসানোর আবেদন জানানো হয়েছে। গত মাসে এই আবেদন করেন রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করছে এমন তিনটি ‘ভিকটিম সাপোর্ট গ্রুপের আইনজীবীরা। তারা এমন একটি দেশে এই শুনানির অনুরোধ জানিয়েছেন, যেটি নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের কাছাকাছি কোন দেশে হবে। আবেদনে দেশের কথা উল্লেখ না থাকলেও, আইসিসি এই আবেদনের অগ্রগতির যে বিবরণী প্রকাশ করেছে, তাতে এই দেশটি ‘বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত সরানোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসির রেজিস্ট্রি বিভাগকে আদেশ দেয়া হয়েছে, দ্য হেগ থেকে অন্য কোন দেশে আদালতের কার্যক্রম সরিয়ে নেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে। আগামী রবিবারের আগেই এই সম্ভাব্যতা যাচাই করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। যেভাবে বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ ॥ ২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা এবং নিষ্ঠুরতার পর ওই সময়ে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা আরও বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি। এছাড়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে নতুন জন্ম নিয়েছে ৯০ হাজারেরও বেশি শিশু। রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসে। পরে জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও এই চিত্র তথ্য-প্রমাণসহ বিস্তারিতভাবে প্রকাশ পায়। এরপর থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা মাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করে। তবে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর অপতৎপরতা থেমে থাকেনি। এ অবস্থা থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে মিয়ানমার সীমান্তে সন্দেজনক সেনা টহল শুরু করেছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। কারণ এর আগেও তারা সীমান্ত ঘিরে এ ধরনের উস্কানির ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে বাংলাদেশ তাদের উস্কানিকে প্রশ্রয় না দিয়ে বরং দৃঢ় কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তার জবাব দিয়েছে। এই সেনা টহল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক ভাবমূর্তিকেই প্রকট করবে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের ধারণা।
×