ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

নতুন নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

নতুন নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোতে চলা শুদ্ধি অভিযানে যে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, সেই ফাঁক দিয়েই প্রবেশের চেষ্টা করছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর নীতিহীন লোকজন। আর তাদের এই কাজে সহায়তা করেছেন, করছেন বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করা ও সুবিধা নেয়া একটি অংশ। মূলত তারাই দলে থেকে ভিন্ন মতাদর্শের নেতাকর্মীদের দলে রিক্রুট করে থাকেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টিতে এরা ‘কাউয়া’। এই কাউয়াদের উৎপাতে প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা বরাবরই কোণঠাসা। প্রায় দুই শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে ফায়দা লুটেছে। আবার মূল সংগঠন থেকে বের হয়ে সেই নামেই আরেকটি শাখা সংগঠন খুলে কেউ কেউ সুবিধা নেয়ার চেষ্টায় রত। এতে বিভ্রান্ত হন আমজনতা। দুর্নাম হয় সংগঠনের। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে মামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেকেই এখন নৌকায় সওয়ার হয়েছেন। আরেকটু এগিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা এসব নেতা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলসহ বিভিন্ন অপকর্মেও যুক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের যেখানেই হাত দেয়া হচ্ছে সেখানেই দুর্নীতির চিত্র উঠে আসছে। সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, লুপারা ধরা পড়ছে। আসলে দলকে ভালবাসা, আবার তার কাছ থেকে ফায়দা নেয়া- দুটো একসঙ্গে হয় না। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে কিছুদিন আগে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অভিযান চলবে অনিয়মের আবর্তে থাকা অন্যান্য খাতেও। এরপর পর্যায়ক্রমে তা তৃণমূলেও ছড়িয়ে যাবে। রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে কেউই অনিয়ম-দুর্নীতি লুকিয়ে রাখতে পারবে না। সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। কেউ এর উর্ধে নয়।’ সম্প্রতি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল হওয়ার পর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটিও বাতিল করা হয়েছে। এমন ঘটনা যখন পত্রিকার পাতার শিরোনাম হয় তখন আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে শঙ্কায় পড়তেই হয়। তৃণমূল পর্যায়ে বঞ্চিত, উপেক্ষিত অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী মনে করেন, বিভিন্ন দল থেকে আসা দুধের মাছিরা সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জমা দেয়া হয়েছে সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে। দক্ষিণে চলছে যাচাই-বাছাই। আওয়ামী লীগের ৫টি সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের নবেম্বরে। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বেই চলছে সংগঠনগুলো। এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ২৩ নবেম্বর। এর আগে দলের ভেতরে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। পরে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে শেখ ফজলে সামস পরশ চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ সভাপতি মাইনুল হাসান খান নিখিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৬ নবেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে নির্মল রঞ্জন গুহ এবং কে এম আফজালুর রহমান বাবু। একইদিনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিও ঘোষণা করা হয়। কৃষক লীগের সম্মেলন হয় ৬ নবেম্বর। ওইদিন কৃষিবিদ সমীর চন্দ চন্দ্রকে সভাপতি ও এ্যাড. উম্মে কুলসুম স্মৃতিকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৯ নবেম্বর। সভাপতি হন ফজলুল হক মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক কে এম আজম খসরু। ২৯ নবেম্বর আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি নির্বাচিত হন সাইদুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হন শেখ আজগর লস্কর। যারা এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম জমা দিতে পারেননি তাদের নাম জমা দিতে বলা হয়েছে। পরে যাচাই-বাছাই করে সভাপতির অনুমোদন নিয়ে চূড়ান্ত কমিটি ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে কাক্সিক্ষত পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সব পর্যায়ের নেতাকর্মী। ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রভাবশালী নেতাদের বাড়িতে। এই পদ পাওয়া নিয়ে অনেক জায়গাতেই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা। পদোন্নতির মতো গণতান্ত্রিক বিষয়টি যেন জোরাজুরির পর্যায়ে চলে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে উপেক্ষিত নেতাকর্মীদের তেমন কিছু বলার থাকে না। অথবা, তারা বলতে পারেন না। পদের মূল লড়াইটা হয় সেয়ানে সেয়ানে। এজন্য মাঝে-মধ্যে অন্তর্কোন্দলের অনেক রক্তাক্ত ঘটনা পত্রিকার শিরোনামও হতে দেখা যায়। যা মোটেও কাম্য নয়। দলের মধ্যে দলাদলি থাকতেই পারে। তবে, তাকে বেশি বাড়তে দেয়া ঠিক নয়। কাউকে না কাউকে উদার হতেই হয়। সেটা যত আগে করা যায় ততই দলের জন্য মঙ্গল। সবার দৃষ্টি এখন নতুন কমিটির দিকে। কারা আসছেন সেই কমিটিতে? শুদ্ধি অভিযানে ধরা পড়া সুবিধবাদীদের অবস্থান কি হবে? তাদের জায়গায় যে নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টা চলছে- সেই নেতৃত্ব যারা দেবেন, তারা কতটুকু দেশ ও দলকে ভালবেসে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে পারবেন? ছড়িয়ে পরা দুর্নীতির বিষবাষ্প তাড়াতে তাদের ভূমিকা কি হবে? তার উত্তর খুঁজতে উদগ্রীব থাকবেন তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ সচেতন মহল। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে অঙ্গ সংগঠনে দুর্নীতির যে বলয় একদা গড়ে তুলেছিল সুবিধাভোগীরা, সেই প্রাচীর ভাঙতে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন নেতৃত্বকে অবশ্যই কঠোরভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। অর্থ ও দখলের মোহে আচ্ছন্ন থাকা তরুণদের কঠোর শাসনের পাশাপাশি নতুন স্বপ্নের বিস্তার ঘটাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নবপরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আগামী প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি ও খেলাধুলাই পারে কিশোর-তরুণদের বাজে চিন্তা ও কাজ থেকে দূরে রাখতে। পদে না থেকেও দলের জন্য কাজ করা যায়। সেটা স্বতঃস্ফূর্ত, নির্মোহভাবে দলকে ভালবেসে। সবার আগে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদীদের অবস্থান নিয়ে অনেকদিন ধরেই দলের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা হচ্ছে। অন্যদিকে কাউয়া, কাউয়াকে ডেকে দল ভারি করছে। এমন ভারি কিছু যেন জগদ্দল পাথর হয়ে ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির বুকে চেপে না বসে- সেই প্রত্যাশাই করি। লেখক : সাংবাদিক
×