ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাসান মোঃ হামিদুর রহমান

টেকসই কৃষি উন্নয়নে আইসিটি বিষয়ে বিবেচ্য

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

টেকসই কৃষি উন্নয়নে আইসিটি বিষয়ে বিবেচ্য

বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ব আজ করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাস মহামারীতে জর্জরিত। চীনের উহান থেকে ২০১৯ এর ডিসেম্বরে সৃষ্ট এই মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সকল দেশ ও অঞ্চলে। উন্নতির চূড়ায় থাকা দেশ থেকে শুরু করে চরম দরিদ্র দেশটি পর্যন্ত কেউই রেহাই পায়নি এর ব্যাপক বিধ্বংসী, ভয়াবহ তা-বলীলা থেকে। আক্রান্ত তো বটেই, মৃতের তালিকাও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় তিন কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং নয় লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধে দিনের পর দিন লকডাউন পদ্ধতি চালু রাখার ফলে একদিকে যেমন থমকে গেছে মানুষের জীবন, অন্যদিকে তেমনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবিকা তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় কিছু কিছু দেশে লকডাউন তুলে নিয়ে ‘নিউ নরমাল’ ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপোড়নে, জীবিকার চাকা সচল রাখতে কোন কোন দেশে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে লকডাউন শিথিল/ তুলে নেয়া হয়েছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং তা হাতের নাগালে না আসা পর্যন্ত এ থেকে বিশ্ববাসীর মুক্তি নেই। জীবন ও জীবিকার এই দোলাচলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশেষত সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পেতে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশের জন্য তা আরও বেশি প্রযোজ্য। আর করোনাকালীন এই মহাদুর্যোগে অন্যান্য সেক্টরের মতো কৃষি সেক্টরেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বা আইসিটি। টেকসই কৃষি উন্নয়নে তথা করোনাকালীন কৃষি উন্নয়নে আইসিটির ভূমিকা অপরিসীম। উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, সাপ্লাই-চেইন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, ভোক্তা অধিকার, কৃষি আবহাওয়া, জলবায়ু পূর্বাভাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী আইসিটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অটোমেশনের মাধ্যমে সহজেই উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি করা যায়। ডাটাবেজ (কৃষক ডাটাবেজ, ফসলের ডাটাবেজ, কৃষি প্রযুক্তি, পোকামাকড়, রোগবালাই ইত্যাদি) কেন্দ্রিক ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নীতি-নির্ধারক পর্যায় থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের উপকারভোগী (কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, গবেষক ইত্যাদি) সময়মতো সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ প্রথাগত আইসিটি টুল যেমনঃ ডাটাবেজ সিস্টেম, রিমোট সেনসিং/ জিআইএস ভিত্তিক সল্যুশন, বায়ো-ইনফরমেটিক্স প্রযুক্তি ইত্যাদি একদিকে যেমন কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে অন্যদিকে তেমনি কৃষি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রণয়নেও এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। (কৃষি বলতে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদকে বোঝানো হয়েছে)। পাশাপাশি আইসিটির বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি যেমন: অনলাইন সেবা প্লাটফর্ম, ভার্চুয়াল মিটিং/ ট্রেনিং প্লাটফর্ম (জুম, মাইক্রোসফট মিটিং, গুগল মিট ইত্যাদি), মোবাইল এ্যাপস, সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেনটেড রিয়েলিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ডাটা এনালিটিক্স, সিমুলেশন গেমস, রোবটিক্স, ড্রোন, আইওটি ইত্যাদি ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যের অনেক উদাহরণ আছে এবং ভবিষ্যতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আইসিটির আধুনিক প্রযুক্তিসমূহ কিভাবে কৃষিখাতে অবদান রাখছে সে বিষয়ে একটু নজর দেয়া যাক। ধরা যাক, একজন কৃষক ঘুম থেকে উঠে তার স্মার্টফোন বা ট্যাব খুলে দেখল তার ফসলের জমিতে আর্দ্রতা কমে গেছে; সেচ দেয়া প্রয়োজন বা তার জমিতে পোকামাকড় আক্রমণ করেছে; ওষুধ ছিটাতে হবে অথবা শস্যের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে; সার দিতে হবে। এই তথ্যটি সে পেল তার ক্ষেত্রে স্থাপিত আইওটি ডিভাইস/সেন্সর এর মাধ্যমে। মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য; একটি গরুর খামারের সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কাজটিও আইওটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেনটেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই করা যায়। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজ করাকে প্রিসিশন এগ্রিকালচার বলে। ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, অস্ট্রেলিয়ায় এসব প্রযুক্তি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। আইওটি ডিভাইস হতে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রোবট বা ড্রোনের মাধ্যমে সেচ, সার বা ওষুধ ছিটানোর কাজটি দূর হতে সমাধা করা যাচ্ছে। তদ্রƒপ স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে আগাম ফলন বা উৎপাদনের তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। অটোমেশন এবং অনলাইন প্রযুক্তির কল্যাণে হিউম্যান ইন্টার‌্যাকশন ছাড়াই বা ন্যূনতম ইন্টার‌্যাকশনের মাধ্যমে ফসল কর্তন থেকে শুরু করে ফসল প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাতকরণের কাজও সম্পন্ন করতে পারবে। পাশাপাশি গ্রিনহাউস, হাইড্রোপনিক চাষাবাদ, ভারটিক্যাল ফারমিং-এ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি/ অগমেনটেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির কল্যাণে মনিটরিং এবং কৃষিকাজ সম্পাদনের মাধ্যমে পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনার চিত্র পাল্টে দেয়া সম্ভব। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্মার্ট এগ্রিকালচার বলা হয়। তবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। এক্ষেত্রে কিছু অসুবিধাও রয়েছে, যেমন: আমাদের ফার্ম সাইজ বা কৃষি ক্ষেতের ক্ষুদ্রাকৃতি। স্মার্ট/প্রিসিশন এগ্রিকালচারের জন্য যে ধরনের ফার্মসাইজ হওয়া দরকার সে তুলনায় আমাদের ক্ষেতের আকার অনেক ছোট। ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী আমাদের গড় ফার্মসাইজ ০.৬ হেঃ যেখানে আমেরিকার ফার্ম সাইজ ১৭৫.৬ হেঃ (তথ্য সূত্র: এফএও এর কৃষি উন্নয়ন অর্থনীতি ওয়ার্কিং পেপার ১৯-০৮-২০১৯। এ জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে আইসিটি বেইজড অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমূহ বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি তো বটেই, বরং ভবিষ্যত কৃষি ব্যবস্থাপনায়ও আমাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হতে পারে- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আইসিটিভিত্তিক আধুনিক কৃষি বাস্তবায়নে কতিপয় চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতা ১) কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ, এটুআই, মন্ত্রণালয়াধীন দফতর, অধিদফতর, সংস্থা ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি; ২) কৃষকের ইউনিক ও ডায়নামিক ডাটাবেজ নাই; ৩) ক্ষুদ্রাকৃতির ফার্ম সাইজ বা জমি; ৪) কৃষক পর্যায়ে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস প্রাপ্যতা; ৫) নলেজ গ্যাপ; ৬) পাবলিসিটি বা প্রচারণার অভাব ইত্যাদি। করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে বা ভবিষ্যত কৃষিতে আইসিটির সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে আমাদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দীর্ঘায়িত করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে কৃষি সেক্টরে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন হওয়া খুব জরুরী। সময়, খরচ, যাতায়াত কমিয়ে কৃষকের বা ভোক্তার দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন তথা আইসিটির কোন বিকল্প নেই, যা করোনাকালীন দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এর জন্য শুধু ইন্টারনেট এক্সেস নয়, স্মার্ট ডিভাইস প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের জন্য ফ্রি ইন্টারনেটের পাশাপাশি ট্যাব বা স্মার্ট ফোন বিতরণের উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু কৃষিকাজে নয়, একজন কৃষকের সার্বিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এটি ভূমিকা রাখতে পারে, যেমন: কৃষকের সন্তান এই স্মার্টফোন বা ট্যাব ব্যবহার করে অনলাইনে পড়ালেখা করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবাসহ হাজারো অনলাইন পরিসেবা গ্রহণ করতে পারে ইত্যাদি। কাজেই এটাকে খরচ না ভেবে বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। যান্ত্রিকীকরণের জন্য সরকার যেমন কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছে তেমনি ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের লক্ষ্যে কৃষককে ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। সফল ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রস্তাব করা হলো: ১) কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, অধিদফতর ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ; ২) স্থানীয়, জাতীয় এমনকি আঞ্চলিক পর্যায়ে ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে সুচিন্তিত বিনিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত নীতিমালা এবং রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি; ৩) সরকারের আইসিটি পলিসি-২০১৮ তে কৃষিসেক্টরের জন্য যুগোপযোগী করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে, এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা; ৪) প্রয়োজনের নিরিখে বিভিন্ন জনবান্ধব এ্যাপ্লিকেশন তৈরিপূর্বক ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে এগুলোকে জনপ্রিয় করা; ৫) পাবলিক-প্রাইভেট-পিপলস পার্টনারশিপ (পিপিপিপি) নিশ্চিত করা; ৬) পুরো সিস্টেমের উন্নয়ন, বাস্তবায়ন এবং টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল স্তরে কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; ৭) হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক এবং কৃষিকর্মী পর্যায়ে নলেজগ্যাপ কমানো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) বিভিন্ন অনলাইন সেবা যেমনঃ দেশের কৃষি গবেষণা ডাটাবেজ, ভূমি সম্পদ ডাটাবেজ, জলবায়ু ডাটাবেজ, জিআইএস ম্যাপ (ডাটাসহ), সার সুপারিশমালা-২০১৮, ফসল পঞ্জিকা ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে ঘরে বসে কৃষিভিত্তিক তথ্য সেবা গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি করেছে। দেশের ১৩টি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের (নার্স) আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়নেও বিএআরসি নার্স প্রতিষ্ঠানের এপেক্স বডি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মাথায় রেখে বিএআরসি নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষণা সক্ষমতা ও গবেষণা ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আইসিটিভিত্তিক উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আশা করা যায়, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় বর্ণিত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করতে পারলে আইসিটির নিত্যনতুন প্রযুক্তির সহায়তায় কৃষি সেক্টরে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সফলকাম হব। আর এর মধ্য দিয়েই রচিত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আধুনিক কৃষির ভিত্তি। লেখক : পরিচালক (কম্পিউটার ও জিআইএস ইউনিট) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ফার্মগেট, ঢাকা [email protected]
×