ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইতিহাস বিকৃতির চির অবসান চাই

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

ইতিহাস বিকৃতির চির অবসান চাই

প্রতিটি দেশের জন্মের পটভূমি, মুক্তির সংগ্রামের গৌরবময় গল্প-কাহিনী এবং নেতা ও নেতৃত্বের সঠিক ইতিহাস শুধু অমূল্য সম্পদই নয়, বরং দেশাত্মবোধে উদ্যমী করে তোলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে। বিশ্বের একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যে দেশের মানুষ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়ে মায়ের ‘বাংলা ভাষা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজের ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণের মধ্যে অলিখিত স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল এবং নেতার অনুপস্থিতিতে কী করণীয়Ñদাড়ি-কমায় সুকৌশলে তুলে ধরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ জাতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের সময় ছিল জিয়াউর রহমান, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল। পাকিস্তান-স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেই সে হত্যার বিচার কাজের পথে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’, সহযোগী খুনীদের পুরস্কৃত করা, তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজ-বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা, ধ্বংস করা এবং সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে ইতিহাস বিকৃতির অপকৌশল ষড়যন্ত্র করেছে। যার ধারাবাহিকতা স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপিও অব্যাহত রেখেছে। ‘আওয়ামী নেতাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের পরিবার-পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন এ দেশবাসীকে মৃত্যুফাঁদে ফেলে দিয়ে নেতৃত্বহীন অবস্থায়। যাকে ঘিরে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখত সেই শেখ মুজিবুর রহমানও। জাতির এ সংকটকালীন মুহূর্তে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেমের মহানমন্ত্রে উজ্জীবিত এই টগবগে যুবকের কণ্ঠে ২৬ মার্চ রাতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর তার আগে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি’-কথাগুলো ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ নিবন্ধে মোর্শেদ হাসান খান লেখেন। তিনি একজন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক। প্রশ্ন ওঠে, এই ধরনের শিক্ষকের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী শেখেন, কী ধরনের ইতিহাস তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরেছেন এবং তার এই ইতিহাস বিকৃতির উদ্দেশ্য কী-এটি খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। মিথ্যা তথ্য ও বিকৃত ইতিহাস যেমন মোর্শেদ হাসান খানের অধ্যাপনাকে বিতর্কিত করেছে, তেমনি তার দ্বারা দেশ, জাতি বিভ্রান্ত হচ্ছেন, হবেন। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শিক্ষার্থীরাও সঠিক তথ্য-উপাত্ত থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, হবেন। জিয়াউর রহমান, স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানরা এভাবেই পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরে আসছেন। মিথ্যাচার শেখানোর চেষ্টা করেছেন, করছেন। তাদের এই শেখানোর মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একটা প্রজন্ম নিজের গালে, টি-শার্টে ‘আমি রাজাকার’ বলে নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্ট অপরাধী যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীর অন্তর্ভুক্ত-পরিচয় দিতেও আজ লজ্জা পায় না। বিবেকবোধও কাজ করে না তাদের! ব্যক্তিগতভাবে ওইসব বিভ্রান্ত প্রজন্মকে দোষারোপ করছি না, কারণ ‘রাজাকার হচ্ছে’ ‘রাজার নীতি’। দেশে কখনও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়নি, বাংলাদেশে কোন রাজাকার নেই বলে একটা প্রজন্মকে শেখানো হয়েছে। আবার যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকাজের মাধ্যমে যখন রাজাকার কী, রাজাকার বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধে কী ধরনের অপরাধ-বর্বরতা চালিয়েছে, ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যাসহ গণহত্যার স্থির-ভিডিওচিত্র যখন সবার হাতে-হাতে পৌঁছাতে শুরু করেছে, তখন শুরু হলো আরেক ধরনের অপপ্রচার-তারা মূলত রাজাকার নয়, এই কাদের মোল্লা, সেই কাদের মোল্লা নয়! দেইল্লা রাজাকারের অপরাধ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওপর চাপিয়ে অপরাধী সাজানো সরকারের নীল নকশা বলে একশ্রেণীর মানুষ, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও কতিপয় প্রচার-প্রকাশযন্ত্র মাঠে নেমেছিল। সেসঙ্গে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন ‘শাহবাগীরা নাস্তিক’ বলে বক্তব্য দিল, তখন শুরু হলো ধর্মকে ব্যবহার করা, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশের প্রতিভাবান ব্লগার-লেখকদের চাপাতি দিয়ে হত্যার করার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র! বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে শেখানো এক শ্রেণীর বিভ্রান্ত প্রজন্মকে স্বাধীনতাবিরোধীরা নিজেদের প্রয়োজনেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। কুখ্যাত রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদের ছবির সঙ্গে যুক্ত করে ‘চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে’ বলে অপপ্রচার করে দেশের সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করা, অগ্নীসংযোগসহ স্বাধীনতাকামী মানুষদের হত্যা করার বর্বর দৃশ্য পুরো দেশকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছিল। আবার পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তনের সময়কার ছবি এডিট করে সাঈদীর মুক্তির দাবিতে স্বয়ং কাবা শরীফে মানববন্ধন হচ্ছে-এমন ভুয়া খবর প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করে বিভ্রান্ত করার অপকৌশলগুলোও জাতি কখনও ক্ষমা করবে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আজকের দিনেও এই ধরনের অপপ্রচার, ইতিহাস বিকৃতি ‘রোধ’ করার কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। মাঠে বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য আর বিষোদগার-সমালোচনা ছাড়া ‘বাস্তব উদ্যোগ’ খুব একটা নেয়া হয়েছে বলেও জানা নেই। একের পর এক রাজনৈতিক ব্যক্তি, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং কতিপয় বিতর্কিত গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করার পরেও কোন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত দ্বারা প্রমাণিত মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসির দ- কার্যকর করা অপরাধীদের নামের সঙ্গে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করছে কতিপয় বিতর্কিত গণমাধ্যম! আর যে সরকারের প্রতি আশা করতে পারি সেই আওয়ামী লীগ সরকারের মাঝেও এক ধরনের নমনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। যেমন, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায়ে জানিয়েছে-‘জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক’। সেইসঙ্গে আদালত জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খ- বাতিল ঘোষণা করেছে। এই খ-টি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখনজনক হলেও সত্য, স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট অধিবেশনের বৈঠকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে দুইজন আইন-প্রণেতা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ও ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে তাদের বক্তব্য শুরু করেন! প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ও ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জেনে-শুনে কেন ইতিহাস বিকৃতি করলেন? কেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অবজ্ঞা, অবমাননা করে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করলেন? কারণ, তারা জানে ইতিহাস বিকৃতি করলে কিচ্ছু হবে না, বরং একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা যাবে। যাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। ঐতিহাসিক প্রমাণ ও দলিলাদি দেখার পরেও খালেদা-তারেক জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়ির-জুনিয়র নেতৃবৃন্দ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করলেও জিয়াউর রহমান কিন্তু জীবিত অবস্থায় নিজেকে কখনও এই একটি মিথ্যাচার-ইতিহাস বিকৃতির অংশীদার করেননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা জাতির জনক শিরোনামের প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কোথাও তিনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। ওই প্রবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক বলে আখ্যায়িত করেন। আবার ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান যখন ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আপনাদের উদ্দেশে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল’। জিয়াউর রহমান ওই ভাষণেও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন-২০১৬’-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ওই আইন নিয়ে বিস্তর আলোচনা, জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এ নিয়ে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। জনমত তৈরি করতে ভাল কোন উদ্যোগও চোখে পড়েনি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধের আইন কবে আলোর মুখ দেখবে-এটিও স্পষ্ট নয়। একটি জাতি তখনই দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হবে যখন তার দেশের জন্মের সঠিক ইতিহাস জানবে, নেতা ও নেতৃত্বের পটভূমি নিয়ে অবগত হবে। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পরে পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলা, ধ্বংস করার চেষ্টা বহুবার করা হয়েছে। এক প্রকার নিষিদ্ধই করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। পাঠ্যপুস্তকেও ইতিহাস বিকৃতি জুড়ে দিয়েছিল, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়, মন-মগজে মিথ্যাচার, বিকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে পড়েছিল! একবিংশ শতাব্দীর অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি আর তথ্য-প্রমাণের মাঝেও মোর্শেদ হাসান খানদের মতো অধ্যাপক, হারুনুর রশীদ আর ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাদের মতো সংসদ সদস্যের ধারাবাহিক মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির অব্যাহত অপচর্চা থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি মিলবে কবে? লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×