ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ শাহজাদা সেলিম

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম একটি হরমোন জনিত স্বাস্থ্য সমস্যা যা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করছে। এটি প্রধানত বালিকা ও মহিলাদের প্রজননক্ষম সময়ে হয়ে থাকে (১৫-৪৪ বছর) সংখ্যার কিছুটা তারতম্য হলেও ১৫ বছর থেকে বয়স ৪৪ বছরের দিকে যত আগাতে থাকে, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের রোগীর সংখ্যা তত বৃদ্ধি পেতে থাকে (২.২%-২৬.৭%)। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের রোগীর সংখ্যা আলাদা আলাদা রকম এবং এ সংখ্যা রোগ শনাক্ত করণের ক্রাইটেরিয়ার কারণেও আলাদা হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোর প্রজননক্ষম মহিলাদের ১৫-২০ শতাংশ এ সমস্যায় আক্রান্ত। আমেরিকার দেশগুলোতে এর সংখ্যা ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এশিয়ার দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে আশংকা করা হয়। তবে বাংলাদেশে এ হার ২৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম মূলত: নারীদেহে এন্ড্রোজেন (পুরুষ যৌন হরমোন)-এর আধিক্যের কারণে সংঘটিত শারীরিক সমস্যা। এক্ষেত্রে নারীদেহে এন্ড্রোজেন হরমোনের প্রভাবে বিভিন্ন রকম লক্ষণ দেখা দিতে থাকে, যেমন, ক) অনিয়মিত মাসিক, খ) অতিরিক্ত রক্ত¯্রাব, গ) মুখে ও শরীরে অত্যধিক লোম (পুরুষালি), ঘ) ব্রণ মুখে ও শরীরের অন্যান্য অংশে। আরো কিছু শারীরিক সমস্যা এর সাথে থাকতে পারে- তলপেটে ব্যাথা, মকমলের মতো কালো ত্বক (ঘাড়, বগল ইত্যাদি জায়গায়) বন্ধ্যাত্ব। এ রোগীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এদের অনেকেই দৈহিক স্থ’লতায় আক্রান্ত হয়, নাকডাকা ও ঘুমের সময় হঠাৎ করে শ^াস বন্ধ হওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্য হীনতা ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম একটি জীনগত ত্রুটি ও পরিবেশগত ত্রুটির সমন্বিত ফল। জীনগত ত্রুটি আছে এমন কিশোরির দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, খুব কম শারীরিক শ্রম সম্পাদন করা ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ করা ইত্যাদি এ রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম দেখা দেয় যখন, ডিম্বাশয় অতিরিক্ত পরিমাণে টেস্টোস্টেরন হরমোন তৈরি করতে উদ্দীপ্ত হয়। যার পিছনে পিটুইটারি গ্রন্থি কর্তৃক অতিরিক্ত এলএইচ (খঐ) নি:স্বরণ ও দেহে ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স এর উপস্থিতি। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম নাম হবার প্রধান কারণটি হলো এ রোগীনিদের ডিম্বাশয়ে বিভিন্ন বয়সি, বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন সংখ্যার সিস্ট থাকতে পারে। কিন্তু এটি পরিষ্কারভাবে একটি হরমোন জনিত সমস্যা। অধিকাংশ রোগীর দেহে ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স থাকে এবং তারা স্থ’লকায়া হয়। লক্ষণসমূহ : ১। অনিয়মিত মাসিক : বেশিরভাগ মেয়েদের ৪০ বা ৪৫ বা ৫০ দিন বা কারো কারো ক্ষেত্রে আরো বেশি দিন অন্তর ঋতু¯্রাব হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় ঋতু¯্রাব হতে পারে, কারো কারো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঋতু¯্রাব হয়। মাসের পর মাস ঋতু¯্রাব বন্ধ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতেই এ সমস্যা শুরু হতে পারে, প্রজননক্ষম সময়ে অন্য যে কোন সময়েও এ সমস্যা শুরু হতে পারে। ২। বন্ধ্যত্ব : যতজন নারী সন্তান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের কারণে হয়। আর এ বন্ধ্যাত্বের কারণ হলো- ঋতু চক্রের অনেকগুলোতেই ডিম্বানুর অনুপস্থিতি। ৩। পুরুষালি হরমোনের অধিক মাত্রায় উপস্থিতিও এর বহি:প্রকাশঃ এর ফল স্বরূপ নারী দেহে পুরুষদের মতো লোম দেখা দিতে পারে (হার্সোটিজম), মুখে বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় ব্রণ হওয়া, পুরুষালি টাক ইত্যাদি। প্রতি চার জন পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের নারীর তিন জনের দেহে এ লক্ষণগুলো থাকে। ৪। মেটাবলিক সিন্ড্রোম : এতে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীর দেহে ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে- ক্রমশ: দৈহিক ওজন বৃদ্ধি হওয়া, খুধাবৃদ্ধি পাওয়া, দূর্বলতা, স্মৃতিশক্তি দূর্বলতা, ঘাড়ের পিছনে বা বগলে নরম কালো ত্বকের উপস্থিতি, রক্তের গ্লুকোজ কিছুটা বেড়ে যাওয়া, কলেস্টেরোল অস্বাভাবিক থাকা ইত্যাদি। রোগ শনাক্তকরণ : পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম শনাক্ত করতে সচরাচর নিম্নলিখিত ক্রাইটেরিয়ার যে কোন দু’টির উপস্থিতি আবশ্যক- ক্স নারীদেহে অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন উপস্থিতির প্রমান। ক্স অনিয়মিত ঋতু¯্রাব। ক্স ডিম্বাশয়ে সিস্ট। পরীক্ষা-নিরীক্ষা : দ্ব সিরাম টেস্টোস্টেরন, এলিস, এফএসএইচ। দ্ব পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম। দ্ব ওজিটিটি। চিকিৎসা : জীবন-যাত্রা ব্যবস্থাপনা: চিকিৎসার শুরুতেই খাদ্য ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নজর দিতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থাপনা রোগীনির দৈহিক ওজন কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছতে সাহায্য করবে, বিপাকীয় প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটাবে যাতে করে ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স কমে যাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আদর্শ জীবন-যাপন ব্যবস্থাপনা রোগীনির হৃদ রোগ ও ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি কমাবে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের খাদ্য তালিকায় শর্করার আধিক্য কম থাকবে, শক-সবজি (আলু বাদে), রঙিন ফল-মূল ও আমিষ জাতীয় খাদ্য প্রাধান্য পাবে। দৈহিক ওজন বা বিএমআই বিবেচনায় রেখে শারীরিক শ্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। ওষুধ : া মহিলাদের জন্ম নিয়ন্ত্রের জন্য ব্যবহৃত পিলগুলো যাতে স্বল্প মাত্রায় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্ট্রেরন থাকে, তা খুব সহায়ক ওষুধ। া মেটফরমিন া অবাঞ্চিত লোম দূর করবার ক্রীম া প্রজনন সম্ভাবনা বৃদ্ধির ওষুধ পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীদের অধিকাংশই এ সমস্যার শারীরিক লক্ষণগুলোকে খুব দ্রুত বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ লক্ষণগুলো বুঝতে পারলেও সংকোচ বোধের কারণে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে দেরি করেন। যেহেতু রোগটির ব্যাপকতা ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে, তাই প্রজননক্ষম বয়সের সকল নারীকে তার এ সমস্যা আছে কিনা জানার জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞের শরনাপন্ন হওয়া জরুরী। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ মোবাঃ ০১৭৩১৯৫৬০৩৩
×