ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নিত্যপণ্যের দামে চাই নজরদারি

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

নিত্যপণ্যের দামে চাই নজরদারি

করোনা দুর্ভোগে জনজীবন বিপর্যস্ত, দিশেহারা। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধিকে নিরাপত্তার বলয়ে ঢেকে দিতে উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে স্থবির তা দৃশ্যমান হয়েছে। মানুষ এক দুর্বিষহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে এক প্রকার বাধ্যই হচ্ছে বলা যায়। করোনার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে বিশ্বসহ সারাদেশে যে অবর্ণনীয় বিপন্নতা, তাকে সামলাতে আরও কত সময় ব্যয় করতে হবে তা ধারণা করাও মুশকিল। তবুও চলিষ্ণু জীবন প্রবাহকে থামানোও বেশ কঠিন। জীবন চলে জীবনের নিয়মে, নদীর স্রোতের মতো। সেখানে বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা আঘাত হানলেও থেমে থাকার সুযোগ পর্যন্ত থাকে না। সমস্ত দুঃসময়ে, স্থবিরতার চরম আকালে সবার আগে যেহেতু মানুষকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয় সঙ্গত কারণে সেখানেই প্রকোপ দেখা দেয় দৃষ্টিকটুভাবে। তবে করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে আশ্বস্তের ব্যাপার ছিল নিত্য পণ্যের মূল্যের স্থিতিশীলতা। লাগামহীন দামের উর্ধগতি করোনাকালকে সেভাবে দুঃসহ যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয়নি। সহনীয় মূল্যে মানুষ তার প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতে প্রাসঙ্গিক পণ্যকে হাতের নাগালেই পেয়েছে। এখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কার্যক্রমে নিত্য পণ্যের মূল্যের ওপর কঠোর নজরদারিও সহায়ক শক্তির ভূমিকায় নেমেছে। তার ওপর কৃষি অর্থনীতির ফলনেও তেমন কোন অভাব পরিলক্ষিত হয়নি। বরাং ধান এবং অন্যান্য শাক-সবজির বাম্পার ফলন মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে তেমন কোন বিপত্তি দৃশ্যমানও হয়নি। করোনা সংক্রমণকে ঠেকাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগারের ওপর। এত সব সঙ্কট মোকাবেলা করার পরও দ্রব্যমূল্য তার সহনীয় পর্যায়কে অতিক্রম করতে পারেনি। বিশেষ করে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজের যে অস্বাভাবিক মূল্য সেখানেও কোন ধরনের আকাল পড়েনি। গত বছর ভারতের মহারাষ্ট্রের বন্যার কারণে পেঁয়াজ উৎপাদনে ধস নামলে তার প্রভাবে বাংলাদেশেও পেঁয়াজের উর্ধগতি প্রতীয়মান হয়। একেবারে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকার দরে এ পেঁয়াজ বিক্রি হতে থাকে। পেঁয়াজ আমদানিতেও ভাটা পড়ে যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে নানামাত্রিকে ব্যাহত করেছে। দ্রব্যমূল্যের অবধারিত গতি নির্ণয়ে যে কোন একটির দাম লাগাম ছাড়া হলে অন্যগুলোও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দুঃসহ কবলে পড়ে যায়। সঙ্গত কারণে শাক-সবজির দামেও দেখা দেয় এক ধরনের মূল্যের চাপ। যা সাধারণ ভোক্তা শ্রেণীকে বিপর্যস্ত করতে যথেষ্ট। করোনার মতো দুঃসহ সংক্রমণ পুরো দেশকে রুদ্ধতার কঠিন নিগড়ে আটকে দিলেও দ্রব্যমূল্য কিন্তু সেভাবে বাড়তে দেখা যায়নি। ফলে করোনা সঙ্কটে মানুষ তাদের নিত্যব্যবহার্য পণ্য নিয়েও তেমন কোন বিপন্নতা ভোগ করেনি। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে রমজান মাসেও দ্রব্যমূল্যের ওপর কোন অসহনীয় চাপ ভোক্তাদের সামনে পড়েনি। প্রতিবছর যা একটা স্বাভাবিক নিয়মে আবশ্যক হিসেবে পরিগণিতও হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ব্যবসায়ি সংগঠনের অসাধুচক্র যে মাত্রায় কঠিন, অভেদ। সিন্ডিকেটের জাল বিস্তার করে সেখানে খুচরা বিক্রেতা থেকে সাধারণ ক্রেতারা পর্যন্ত বের হয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। সিন্ডিকেটের নীরব ঘাতকের ভূমিকা একেবারে নতুন কিছু নয়। সেটা যে কোন দুঃসময়, দুর্ভিক্ষ এবং মহাসমরের চরম বিপদকালে সর্বদা দৃশ্যমান হয়েছে। এমনকি গত বছর পেঁয়াজের আকালের চরম অবস্থায় বস্তা বস্তা পেঁয়াজ সমুদ্রে বিসর্জন দেয়ার দুঃসহ চিত্রও সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয় গুদাম ভর্তি পচা পেঁয়াজও সাধারণ ভোক্তশ্রেণীকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের নির্মম সিন্ডিকেট ভোক্তাশ্রেণীর দুঃসহকাল অতিক্রমকে কোনভাবেই আমলে নেয় না। তারা তাদের হীনস্বার্থ কায়েম করতে যা করার সবটাই করে নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ। লভ্যাংশ যতখানি সম্ভব আদায় করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার প্রয়োজনও মনে করে না। কিন্তু এই বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তীক্ষè নজরদারি, যথার্থ ও সুষ্ঠু গৃহীত পদক্ষেপ দ্রব্যমূল্যের ওপর যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তার সুফল ভোগ করেছে সাধারণ মানুষ। ধারাবাহিকতায় কোরবানি ঈদের বাজারও ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীল অবস্থা জনজীবনে স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিরও অবতারণা করেছে। কিন্তু বর্তমানে তেমন দুর্যোগে আবারও বাংলাদেশ পড়তে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে সরকার কঠোর নজরদারি এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে সামাল দিতে বিভিন্ন কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। প্রথমত ট্রাক ভর্তি পেঁয়াজ ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রির সিদ্ধান্ত টিসিবির মাধ্যমে নেয়া সেটাও এক সময়োপযোগী পদক্ষেপ। খোদ রাজধানীতেই ৮০টি ট্রাক এই ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা হবে। আর সারাদেশে ২৭৫টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাক এই দায়িত্ব পালনে কাজ করে যাচ্ছে। যার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজার দরে। বাজারে এই পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোন সুযোগ থাকবে না বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করছে। পাশাপাশি ৮০ টাকা লিটারে সয়াবিন তেল এবং ডাল, লবণ ও চিনি সহনীয় দরে সাধারণ ভোক্তার মধ্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এবারও পেঁয়াজের দাম বাড়ার মূল কারণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে বন্যা ও অতি বৃষ্টি। আর আমাদের দেশে অকারণে, অপ্রয়োজনে তার ওপর ভিত্তি করে পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। এই মুহূর্তে সরকারও ভর্তুকি মূল্যে এই পেঁয়াজ বিক্রির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাজার দরকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে। টিসিবির উর্ধতন কর্মকর্তা আশ্বস্ত করেছেন বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত সরকারী এই সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে। আর এভাবেই বাজার পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে বাড়তি কোন কারসাজিতে বাজার অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে না যায়। শুধু যে পেঁয়াজ কিংবা শাক-সবজির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে তা কিন্তু নয়, মাছ নিয়েও হরেক রকম ওজর-আপত্তি উঠে আসছে। বিশেষ করে মাছ বিক্রির ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ঠকানোর অভিযোগ উঠেছে। চাষের মাছকে নদীর মাছ বলে বিক্রি করার দৃশ্যও প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে আসা অন্য দেশের মাছে বিভিন্ন রকম হঠকারিতায় ক্রেতাদের হয়রানি করার তথ্যও মিলছে। মাছের বাজারেও চলছে এক প্রকার নৈরাজ্য। ফলে হরদম বিপাকে পড়ছে অতি সাধারণ ভোক্তা শ্রেণী। প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করে দেশের ঐতিহ্যিক হরেক প্রজাতির মাছের সম্ভারকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নেয়াও সময়ের দাবি। কারণ কৃষি বিশেষজ্ঞরা সম্ভাবনার দিকনির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের অভাবনীয় সম্ভারকে সযতœ প্রচেষ্টায় সংরক্ষণ করে সেখান থেকেই আমাদের চাহিদা মেটানো যাবে। বিদেশ থেকে মাছ আমদানি করার মতো সঙ্কট বাংলাদেশে এখন তৈরি হয়নি। বরং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত মৎস্য সম্পদ বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করে। সুতরাং বাইরে থেকে আসা বরফাচ্ছাদিত অচেনা মাছের তো কোন প্রয়োজনই পড়ে না। মাছ উৎপাদনেও আমরা বিশ্বের তৃতীয়তম আসনে। সুজলা-সুফলা আর মাছে ভাতে বাঙালী এমন ঐতিহ্যিক প্রবাদ পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দেয়াও সময়ের দাবি। লেখক : সাংবাদিক
×