ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কটকালে জাগ্রত হোক মানবতা

প্রকাশিত: ২১:০১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

সঙ্কটকালে জাগ্রত হোক মানবতা

বর্তমানে করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য ভাইরাসের থাবায় গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফলে কর্মহীন হয়ে মানবেতর দিন কাটছে খেটে খাওয়া মানুষের। পৃথিবী এখন আক্ষরিক অর্থেই গভীর অসুখে। একদিকে রোগের আতঙ্ক, মৃত্যুভয়ে দিশেহারা মানুষ। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় বিনিদ্র। রোজ টিভি বা খবরের কাগজের পাতা খুললেই এই খবর। অন্যদিকে ঠিক উল্টো এক ছবি। মানুষের সাহায্যে পথে নেমেছেন মানুষ। এহেন এক পটভূমিতে অত্যাশ্চর্য সেই পরশপাথর আমাদের সামনে। মানুষের নতুন রূপ দর্শন। এ যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। আত্মকেন্দ্রিক সমাজ হঠাৎ করেই যেন এক অনির্বচনীয় মানবিক সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত। মানুষ অন্যের আপন হতে ঘর থেকে বের হয়েছেন। বিশেষ করে-সেলিব্রিটি, কর্পোরেট, রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা নেতা। আবার সাধারণ মানুষও রয়েছে এই দলে। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত ইতালিতে যখন কিউবা মেডিক্যাল সরঞ্জাম ও চিকিৎসক দল পাঠায় তখন বিশ্ব হাততালি দিয়েছে একটি মানবিক পৃথিবীর জন্য। ভেনিজুয়েলা কূটনৈতিক টানাপোড়েনের সম্পর্কের দেশ কলম্বিয়াকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর সার্ক সংস্থার নেতারা বৈঠকে বসেছেন মহামারী মোকাবেলায়। চীন-জাপান বৈরিতা ভুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। বহির্বিশ্বের এ রকম চিত্র এখন অহরহ। সঙ্কটময় এ পরিস্থিতি উত্তরণে অতি দরিদ্র মানুষের পাশে থাকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে আমাদের সরকার। এগিয়ে আসছে সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। চরম অভাবের জীবনে নিম্নবিত্তের কাছে কাক্সিক্ষত ত্রাণই যেন আবির্ভূত হচ্ছে ত্রাতা রূপে। কিন্তু বেশকিছু স্থানে পরোয়া করা হয়নি সামাজিক দূরত্বের রীতি-নীতির। খাদ্য সঙ্কটে কোথাও কোথাও বেঁধেছে লড়াই। আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। এমনটাই প্রচার চালাচ্ছে সরকার। তবু মানুষের ভেতর আতঙ্ক কমছে না। করোনা শনাক্ত হলেই ওই ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি নির্দয় হয়ে উঠছেন আশপাশের মানুষ। সংক্রমিত কারও মৃত্যু হলে ওই পরিবার হয়ে পড়ে আরও অসহায়। তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়েও আসেন না। যে মানুষটি প্রিয়জনদের বিপদে নানাভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মানুষটি করোনায় আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে অবহেলার পাত্র হয়ে দাঁড়ান। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেন। তার পরিবার নিদারুণ এক কষ্টের মুখে পড়ে। যারা এই আচরণগুলো করছেন তারা কি নিশ্চিত তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না? করোনার সংক্রমণ থেকে যদি বেঁচেও যান কিন্তু মনের ভেতরের এমন নির্দয়তা ও নির্মমতার ভাইরাস থেকে তারা মুক্ত হবেন কীভাবে? জীবনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জীবিকা, আবার জীবিকা ছাড়া জীবন হয়ে পড়ে অনিশ্চিত, অসহায়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধজনিত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা সবচেয়ে জরুরী। একইভাবে জীবিকার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সবদিক সমন্বয় করে পরিকল্পনামাফিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম দুটোই এগিয়ে নিতে হবে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করেই আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে করোনা। করোনায় আক্রান্তদের প্রতি আমাদের করণীয় বা আচরণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন- ‘করোনা রোগী থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তাই পাড়ায়, গলিতে, ওপরতলায় বা নিচতলায় কিংবা পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে করোনা রোগী থাকলে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব হলো রোগী ও তার পরিবারের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা, তাদের বিপদে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসা। একই সঙ্গে পাড়ার বা এ্যাপার্টমেন্টের অন্যরা যেন সুরক্ষিত থাকেন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’ আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশন মেনে চলা জরুরী। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিসেবে সবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, রোগীর পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিস বা বাজারের ব্যবস্থা করে দরজার সামনে রেখে আসা। এতে রোগীর পরিবারের কাউকে আর বাইরে বের হতে হবে না। ফলে সংক্রমণ হওয়ারও সুযোগ ঘটবে না। যারা একদিন তাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে অহঙ্কার করত, গর্ববোধ করত তারাও আজ করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে মানুষ কতটা অমানবিক হলে দেশে করোনা সৈনিক ডাক্তারদের সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে? নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে? দেশকে বাঁচাতে হবে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানুষের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে হবে। আর তা না পারলে বিশ্বমানবতা বিপন্ন হবে। করোনা পরবর্তী বিশ্বে যেন মানবতা, নৈতিকতা ও কল্যাণবোধ মরে না যায় সে লক্ষ্যে এখন থেকেই সকল প্রকার অন্যয়-অত্যাচার, অর্থপাচার, লুটপাট বন্ধ করতে হবে। করোনা আসলে কারও ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থবিত্তকে তোয়াক্কা করে না। আর করে না বলেই কিন্তু করোনা ধনী-গরিব সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×