ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বহুরূপী লুপার আমলনামা

বাবা রাজাকার হলেও তার স্বপ্ন ছিল এমপি হওয়ার

প্রকাশিত: ২১:৪০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাবা রাজাকার হলেও তার স্বপ্ন ছিল এমপি হওয়ার

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ বাবা নান্না তালুকদার তালিকাভুক্ত রাজাকার হলেও মেয়ে লুপা তালুকদারের স্বপ্ন ছিল আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার। তাই মুজিবকোট গায়ে চড়িয়ে এমপি, মন্ত্রী, নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়াই ছিল তার অন্যতম কাজ। একইসঙ্গে কখনও সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, কবি, সমাজকর্মী। আবার কখনও এনজিও ব্যক্তিত্ব, এমন সব পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। সর্বশেষ একটি টিভি চ্যানেলের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে নানান ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি এসব পরিচয় ব্যবহার করে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা একটি জোড়া খুনের মামলা থেকে অব্যাহতিও নিয়েছিলেন। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বহু মানুষের অর্থ। শিশু জিনিয়া অপহরণ মামলায় বর্তমানে জেলে থাকা লুপার জন্মস্থান পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গ-ি ছাড়িয়ে গত কয়েকদিন ধরে দেশ জুড়ে তাকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অনেকে ‘লেডি সাহেদও’ বলছে। লুপা তালুকদারের (৪২) পুরো নাম নূর নাজমা আক্তার। তার বাবা হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না তালুকদার পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার মূল পেশা ছিল ইজারাদারি ও সুদের ব্যবসা। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট লুপা তালুকদারের বড় বোন লুচি তালুকদার বেশ কয়েক বছর আগে আত্মহত্যা করেন। স্থানীয়রা জানান, ছোটবেলা থেকেই লুপা জিনসের শার্ট প্যান্ট পরে মোটরসাইকেল নিয়ে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেন। ছিলেন সব ধরনের নেশায় অভ্যস্ত। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরদার মুঃ শাহআলম জানান, ১৯৯৫ সালে লুপা তালুকদার গলাচিপা ডিগ্রী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদিকা পদে ছাত্রদলের হয়ে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। যদিও সে নির্বাচনে ওই একটিমাত্র পদ ব্যতীত পুরো প্যানেল ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। লুপা তালুকদার ওই নির্বাচনে ছাত্রলীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার বাবার ভূমিকার কারণে ছাত্রলীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। নির্বাচনে জয়লাভ করেই লুপা তালুকদার কলেজের এক শিক্ষককে বিয়ের প্রস্তাব দেন। শিক্ষক সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে লুপা ওই শিক্ষককে প্রকাশ্যে অপমান করেন। এ ঘটনায় ছাত্র সংসদ তাকে বহিষ্কার করে। এখানেই তার পড়াশোনার ইতি ঘটে। এ যাবত বেশ কয়েকটি বিয়ে করেছেন লুপা তালুকদার। কিন্তু বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য কোন বিয়েই বেশিদিন টেকেনি। পারিবারিক উত্তরসূরি হিসেবে লুপা তালুকদার প্রচুর সহায় সম্পদের মালিক ছিলেন। ‘লুপা এক্সপ্রেস’ নামে তার মালিকানায় চারটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ছিল। একটি দোকান ছাড়াও ছিল চারটি আড়ত। জমি, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ ছিল প্রচুর। কিন্তু সে সব সম্পদের বেশির ভাগই বিক্রি করে দিয়েছেন। সর্বশেষ তিনি তার ফেসবুক পেজে বাড়ি বিক্রি করার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুদিন সেভ দ্য ডিপ্রাইভড পিপল এসডিপি নামের একটি এনজিও নির্বাহী পরিচালক ও মালিক হিসেবে পরিচালনা করেন। ওই সময় তিনি তার নামের সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রী যোগ করেন। ২০০৩ সালের ২৪ মে তার বাসার গৃহপরিচারিকা তিন বছরের শিশু সেলিনাসহ শাহিনূর বেগম (২২) খুন হয়। এ ঘটনায় শাহিনূরের মা নিলুফা বেগম ওই বছরের ১ জুন গলাচিপা থানায় লুপা তালুকদারকে প্রধান আসামি করে মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তার বাবা, দুই ভাই ও তৎকালীন স্বামী বাদলকেও আসামি করা হয়। পুলিশ ঘটনার ৮ দিন পরে রামনাবাদ নদীর চর থেকে বস্তাবন্দী শাহিনূরের লাশ উদ্ধার করলেও শিশু সেলিনার লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। পুলিশ মামলার দেড় মাস পরে লুপা তালুকদার, তার বাবা, দুই ভাই ও স্বামীসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। চার্জশীটে হত্যার মোটিভ হিসেবে দু’টি কারণ তুলে ধরা হয়। প্রথমত-গৃহপরিচারিকা শাহিনূরের সঙ্গে লুপার স্বামী ও ভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়া। দ্বিতীয়ত-প্রতিবেশী একটি পরিবারকে শাহিনূরের মাধ্যমে ফাঁসানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়া। ঘটনা প্রসঙ্গে চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়, শিশু সন্তানসহ শাহিনূরকে ঘটনার দিন বিকেলে বেড়ানোর নাম করে একটি ট্রলারে তুলে নেয়া হয় এবং একটি নির্জন চরে নিয়ে দু’জনকে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দী অবস্থায় নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয়রা জানায়, এ ঘটনার পর থেকে লুপার সে সময়ের স্বামী বাদল ওরফে বাদল শহীদের আর কোন খোঁজ মেলেনি। শহীদ বাদল ঢাকার নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ ছিলেন বলে জানা গেছে। তার একটি লোকসঙ্গীতের ক্যাসেটও বেরিয়েছিল। এ ঘটনা নিয়েও এলাকায় নানা কানাঘুষা রয়েছে। এ চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে ২০১৩ সালে লুপাসহ তার পরিবারকে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অব্যাহতি দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই সময়ে গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করে স্পষ্ট ভাষায় তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, লুপা তালুকদার বা তার পরিবারের অন্য কোন সদস্য তার স্বাক্ষর জাল করেছে। তিনি আরও বলেন, কাগজপত্র জালজালিয়াতি করা এ পরিবারের দীর্ঘদিনের অভ্যাস এবং এভাবে বহু মানুষের জমিজমা দখল করেছে। সে ভাবেই হয়তো তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। লুপা তালুকদারের বাবা নান্না তালুকদারের বিরুদ্ধে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার অভিযোগ। ২০০৮ সালে পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ‘মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী ও কারা ছিল রাজাকার’ নামে একটি সঙ্কলন প্রকাশ করে। এতে উপজেলাভিত্তিক ‘সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের’ খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাতে গলাচিপা উপজেলায় ৩১ জনের মধ্যে ১১ নম্বরে রয়েছে লুপা তালুকদারের বাবা মোঃ হাবিবুর রহমান তালুকদার নান্না মিয়ার নাম। বাবা রাজাকার। নিজ এলাকায় ছাত্রদল নেত্রী। সেই লুপা তালুকদার ঢাকায় গিয়ে হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের নেত্রী। তার ফেসবুক প্রোফাইলে রয়েছে তিনি আওয়ামী পেশাজীবী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। মুজিবকোট গায়ে চড়িয়ে কিংবা অন্য পোশাকে মন্ত্রী, এমপিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্তরের নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের বড় মাপের নেতা হিসেবে সর্বত্র পরিচয় দিতেন। এছাড়া, তার ফেসবুকের প্রোফাইলে রয়েছে, তিনি অগ্নি টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দু’টি টেলিভিশন চ্যানেলের ছিলেন সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার। একাধিক দৈনিক ও সাপ্তাহিকের প্রতিনিধি থেকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও। স্থানীয়রা জানায়, যখনই তিনি এলাকায় আসতেন দামী গাড়ি নিয়ে আসতেন। সঙ্গে থাকত টেলিভিশন চ্যানেলের স্টিকার ও বুম। থাকত একাধিক সুন্দরী নারী। যাদের তিনি তার টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এসব দেখে অনেকেই তার কাছে ভিড় জমাতো। কেউ কেউ তদ্বিরের জন্যও আসত। তার টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য রীতিমতো লাইন পড়তো। আর এ সুযোগে করতেন প্রতারণা। লুপা তালুকদারের কলেজ পড়ুয়া একমাত্র ছেলে অগ্নি গত নবেম্বর মাসে মারা যায়। তখন এ ঘটনাকে তিনি আত্মহত্যা বলেছেন। বর্তমানে একমাত্র মেয়ে নদী তালুকদার তার অনেক অপকর্মের সঙ্গী বলে প্রচারণা রয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার খুব একটা যোগাযোগ নেই। তার স্বপ্ন ছিল আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হওয়ার। সর্বশেষ ২০১৮ এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও কিনেছিলেন। এলাকায় অনুগতদের দিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণাও করেছেন। বিষয়টির সত্যতা অনেকেই নিশ্চিত করেছেন। গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দে বলেন, যতদূর মনে পড়ে লুপা তালুকদার মনোনয়ন পাওয়ায় আগ্রহী ছিলেন। সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, হ্যা, লুপা মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আখম জাহাঙ্গীর হোসাইনের ব্যক্তিগত সহকারী ও দশমিনা আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট সঞ্জয় কুমার দাশ বলেন, লুপা তালুকদার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও তা জমা দেননি বলেই জানি। গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সরদার মুঃ শাহআলম জানান, সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড়ে আরও অনেকের সঙ্গে লুপা তালুকদারও ছিলেন। তবে এলাকায় কোন ধরনের পোস্টার লাগাননি। কিছু কর্মী দিয়ে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এলাকায় বহুল আলোচিত-সমালোচিত বহুরূপী লুপা তালুকদার বর্তমানে শিশু জিনিয়া অপহরণ মামলায় জেলে আছেন। তিনি গত ১ সেপ্টেম্বর টিএসসি এলাকা থেকে শিশু জিনিয়াকে অপহরণ করেন। গোয়েন্দা পুলিশ ৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে লুপাকে আটকসহ জিনিয়াকে উদ্ধার করে। কোন কোন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, লুপাকে তার বোনের বাসা থেকে আবার কোন কোন গণমাধ্যমে তার মায়ের বাসা থেকে আটকের খবর বলা হয়। পুলিশকে দেয়া এসব তথ্যেও লুপা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে বর্তমানে তার কোন বোন বা মা নেই। দু’জনেই প্রয়াত হয়েছেন। স্থানীয় অনেকেরই ধারণা- প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে হয়তো লুপা তালুকদার এভাবে অনেক তথ্য এড়িয়ে গেছেন। যা কেবল ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেই বের করা সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়ে যাওয়া লুপা তালুকদারকে নিয়ে দেশ-বিদেশে সরস আলোচনার যেন শেষ নেই। অনেকে তাকে লেডি সাহেদ হিসেবে অভিহিত করছেন। প্রতারণার শিকারদেরও কেউ কেউ তুলে ধরছেন তাদের করুণ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা।
×