ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমূল্য কুমার বৈদ্য

মানবসভ্যতা ও যুক্তি

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

মানবসভ্যতা ও যুক্তি

যে প্রাগৈতিহাসিক সুদীর্ঘকাল যাত্রায় মানবসভ্যতা মানব মুক্তির পথে আলোর দিকে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে, যে চলা অনন্তকালের দিকে সৃষ্টির এক প্রবহমান ধারা, সৃষ্টির আদিমূল থেকে মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি, বুদ্ধি, কৌশল ও যুক্তিবোধের আশ্রয় অবলম্বন করে প্রকৃতির সঙ্গে নিজের দেহ-মনপ্রাণকে মিলিয়ে নিয়েছে এবং এই আলিঙ্গন তাকে শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছে এবং তাকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছে। এমনিভাবে কাল থেকে কালান্তরের ভেতর দিয়ে তার বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটেছে। বিশ্বপ্রকৃতিতে মনুষ্য সৃষ্টি এক মহাবিস্ময়। এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে যা কিছু সৃষ্টি তার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মতোই মানবকুলও ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ বছরের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার ফল আজকের এই মনুষ্যদেহ সৌষ্ঠব। এভাবে মহাকালের এই অভিযাত্রায় মানুষ পৃথিবীতে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও সভ্যতার উদ্ভব ঘটিয়ে সম্মুখপানে ক্রম উন্নততর অস্তিত্বে রূপ পরিগ্রহ করেছে। সভ্যতার অগ্রগতির ধারার মধ্য দিয়ে অন্তর্নিহিত চেতনার দীপ্তি জ্বালিয়ে নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিশক্তি এবং কল্পনাশক্তির অধিকারী হয়ে আরও উন্নততর সোপানে পৌঁছে মানব মুক্তির পথ উন্মোচিত করে যেতে চলমান থেকেছে। সভ্যতার এই যে গতি পরম্পরা তার কোন সীমা নেই, বাধা নেই। অসীমই তার ধর্ম। বিশ্বপ্রকৃতি এবং বিশ্বমানবের রূপান্তরিত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে যেখানে কোন বিরতি নেই, নেই কোন নিশ্চলতা। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তার সমস্তের মধ্যেই যেন একটি মহা আবেগ, এক মহা অস্থিরতা যেন নিরবচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞেই তার শান্তি। মানুষের চিন্তার জগত এবং ভাবনার মধ্যেও যেন সে রকম এক অবিচল শক্তি যেটি জন্ম থেকে প্রাপ্ত। তারও স্বভাবে যেন আবিষ্কারের নেশা, উদ্ভাবনের আকাক্সক্ষা তাকে তাড়া করে ফেরে সর্বক্ষণ এবং এতেই তার আনন্দ, সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য নিহিত। জন্মস্বভাবই তাকে নিয়ে যাবে আরও আরও অনন্তের পানে, সীমাহীনের অভিমুখে। মানুষ দেহগত নয় অন্তঃকরণের সীমাহীন শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। পৃথিবীতে মানুষ তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মননশক্তির যে অভবানীয়, অকল্পনীয় প্রকাশ সাধন করেছে তার ফলে সৃষ্টির সকল ক্ষেত্রই আজ মানুষের মেধাশক্তির কাছে পরাজিত হতে চলেছে। মানবের অন্তর্নিহিত শক্তির মাধ্যমে নব নব আবিষ্কার তার করায়াত্ত হয়েছে। এভাবে মানুষ তার সুপ্ত ক্ষমতাকে জেনেছে এবং নিজের বুদ্ধিশক্তি, আত্মশক্তির খোঁজ পেয়েছে; যা সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সত্যিকার ভূমিকা পালন করছে। এমনি করে বিশ্বমানব নব উদ্ভাবনে উদ্যোমী হয়েছে, সাহসী হয়েছে এবং অজেয়কে জয় করতে আজ একটি ভাল অবস্থানে পৌঁছেছে। মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ, বুদ্ধিশক্তি, মানবিক নীতিবোধ ও ন্যায় দর্শনের মতো মানসিক শক্তির উন্মেষ ঘটেছে। এরই প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্মোচিত হয়ে সর্বাত্মক মানবমুক্তি যথার্থতার দিকে গতিময় যাত্রা করবে এবং এভাবেই মনুষ্যধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানুষ মানবিক সত্তায় প্রতিষ্ঠা পাবে। নীতি-পন্ডিতদের নীতিতত্ত্ব ও ভাবাদর্শ পরিবর্তনের অভিমুখে সত্য খুঁজে পাবে। এই সত্য বিকাশের সভ্যতা আলোর সন্ধান পাবে। অনন্তকালের এই প্রবাহে মানব ইতিহাস নতুন নতুন সভ্যতার রূপধারণ করেছে এবং এখানে মৃত্যুধর্মী জীবন তার থেকে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে, সৌন্দর্যে, আনন্দে কর্মযজ্ঞে নিজেকে শামিল করে অমর জীবনের সোপানে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে। এই জগত সংসারে মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ তার ব্যক্তিক জীবনকে উপেক্ষা করে, স্বার্থবৃত্ত থেকে বেরিয়ে দুঃখভোগ করে এবং দ্বিজত্ব প্রমানের মধ্য দিয়ে প্রাচীন সভ্যতাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর অবস্থানের দিকে প্রবহমান রেখেছে। কিন্তু সভ্যতার এই যাত্রাপথে এক অংশ মানুষের ভ্রান্ত নীতি ও ভাবাদর্শের ফলে কত সভ্যতা তার আলো নিভিয়ে আত্মহত্যার পরিণতি বরণ করেছে। কিন্তু তার পরও সভ্যতার আলো প্রজ্বলিত থেকেছে বিশ্ব প্রকৃতির আপন স্বভাব-সত্যের অভিমুখে আরও জ্যোতির্ময় হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। এমনিভাবে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি তথা মনুষ্যত্বের মিলনের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতা জয়ের পথে, মুক্তির নিশানায়, পরিবর্তনশীলতার দিকে অগ্রসরমান রয়েছে। লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×