ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থান যেন কমে না যায়

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

কর্মসংস্থান যেন কমে না যায়

অর্থনীতির ভাষায়, একজনের ব্যয়, আরেকজনের তা আয়। কেউ যদি তার ব্যয় কমিয়ে দেয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট অন্যদের আয় কমে যায়। ফলে তারা ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়। তার উপর নির্ভরশীল অন্যদেরও আয় কমে যায়। আমরা জানি, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গেলে তার সঞ্চয় ও কমে যায়, সঞ্চয় কমে গেলে বিনিয়োগ কমে যায়, বিনিয়োগ কমে গেলে আবার মূলধন ও আয় কমে যায়। এটা হচ্ছে একটি দুষ্ট চক্রের মত। এজন্য গরিবরা গরিবই থেকে যায়, আর ধনীরা ধনীই হতে থাকে। তাই অর্থনীতিবিদ মার্র্কস বলেছেন, ‘a man is poor beacuse he is poor. আর এই দুষ্টচক্র ভাঙ্গতে কোন দেশেরই বাজার অর্থনীতি পুরোপুরি সক্রিয় নয়। সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে। সরকার ধনীদের উপর করারোপের মাধ্যমে তাদের অতি উপার্জিত অর্থ-সম্পদ গরিবদের মাঝে বণ্টন করে, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বলয় যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, বেকার ভাতা ইত্যাদি এছাড়া বিভিন্ন অনুদানের মাধ্যমে কিংবা সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে কিংবা সরকারী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের মাধ্যমে অথবা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে। যদিও আমাদের দেশে সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর। যেটা প্রকৃতপক্ষে ধনীর থেকে গরিবরাই বেশি বহন করে। কেননা এটা একটা পড়হংঁসঢ়ঃরড়হ ঞধী, বা পরোক্ষ কর, যার করাঘাত প্রথম ভোগকারীর উপর পরে, তাই আমাদের দেশের সরকারী অর্থ ব্যবস্থা আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টনে কতটুকু কার্যকর, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গণমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম যে, একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ১২০ জন কর্মীকে ছাঁটাই বা লেঅফ করেছে। এটি মোটেই কোন নিছক খবর নয়, এই করোনা মহামারীতে এটি একটি বিশাল বার্তা। এর মানে এই যে, অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করেছে, অনেকেই করছে এবং এদের দেখাদেখি অনেকেই করবে। এই যে ছাঁটাই মহামারী, এটা করোনা মহামারী থেকে ও ভয়াভয় হচ্ছে। কারণ করোনা হয়ত ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে দূর হয়ে যাবে কিন্তু এ ছাঁটাই মহামারীর মাধ্যমে যে মন্দার সৃষ্টি হবে তা দূর হতে কত সময় লাগে তা শুধু মন্দা পুনরুদ্ধার নীতির সফলতার উপর নির্ভর করবে। যাদের ব্যবসা নেই, তাদের আয় কমে যাবে, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী, পরিবেশক, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক মধ্যস্তকারী কর্মীদের আয় কমে যাবে বা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। আবার তাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাবে, এভাবে পুরো সমাজে মন্দা ছড়িয়ে পড়ে। যদি এটা শুধু স্থানীয় মন্দা হতো, তবে বৈদেশিক সাহায্য, অনুদান, বা ঋণের মাধ্যমে, বাড়তি সরকারী ব্যয় বা বাজেটর মাধ্যমে সহজেই পুনরুদ্ধার করা যেত। এখন যেহেতু এটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিষয়, তাই বিষয়টা এত সহজ হবে না। আজকে যে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীর চাকরি গেল, এখন তার অনেক রকম ব্যয় কমে যাবে, ধরা যাক সে তার ড্রাইভার, বুয়া, বাচ্চাদের টিউটর বাবদ আর ব্যয় করতে পারবে না। তার কেনাকাটা স্বাভাবিক হবে না। ফলে তাদের ব্যয়ের খাতগুলো মন্দার কবলে পড়বে, সে আর চাইনিজে যাবে না, সিনেমায় যাবে না, টুর এ যাবে না, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখবে না। এভাবে তার সঙ্গে জড়িত সকল পক্ষের আয় কমে যাবে, ফলে তাদের সঞ্চয় কমবে, তাদের বিনিয়োগ ও মূলধন কমবে, এভাবে তাদের আয় আরও কমবে। এটাই ভবিতব্য। কিন্তু এই ভবিতব্যকে পরিবর্তন করার জন্য সরকারী সাহায্য, সরকারী পরিকল্পনা, হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য সরকার ও শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক বেশি দায়িত্ব। সর্বপ্রথম সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন কারও কর্মসংস্থান বন্ধ না হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজির অভাবে চলতে পারছে না, তারা যেন কিছুতেই বন্ধ না হয়, কারণ তার সঙ্গে অনেক লোকের রুটি রুজির সম্পর্ক। তাদের বিভিন্ন রকম অনুদান, ঋণ, কর রেয়াত, অন্যান্য সাহায্য করে চালিয়ে যেতে দিতে হবে, সরকারী, বেসরকারী কোন লোকের বেতন বন্ধ করা যাবে না, তানা হলে অর্থনীতিতে মুদ্রা সংকোচন দেখা দেবে, যেটি বিশাল অশনি সংকেত। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বিভিন্ন ভাতা অনুদান বৃদ্ধি করতে হবে, সরকারী ব্যয় বাড়িয়ে দেশে অর্থ সরবরাহ বাড়াতে হবে, সুদের হার কমিয়ে, সহজ শর্তে ঋণ বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রা সংকোচন ঠেকাতে হবে, কৃষকদের আয় বাড়াতে সরকারকে ফুড প্রকিউরমেন্টের আওতা বাড়াতে হবে। যে কোন মূল্যে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। অন্যথায় বেকারত্ব, মুদ্রা সংকোচন আর উৎপাদন কমে যাওয়া যদি পাশাপাশি অধিক সময় বিদ্যমান থাকে, তাহলে সেই অর্থনীতিকে টেনে তোলা খুবই কঠিন। কারণ আমাদের দেশে সেই রুজভেল্ট নেই, হেনরি মরগেনস্থ বা হ্যারি হপকিন্সও নেই।
×