রশিদ মামুন ॥ বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ যখন ছড়িয়ে পড়ছিল তখন সকলের কাছে একটি প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল জীবন আগে না জীবিকা আগে। সেই প্রশ্ন পিছনে ফেলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। তবে এখনও তা সব দিক দিয়ে স্বাভাবিক নয়। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠে দর্শক নেই, সিনেমা হলেরও সেই একই দশা। সামাজিক দূরত্ব মেনেই এখনও জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে সংক্রামক এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন একটি কার্যকর প্রতিষেধক। হোক সে ভ্যাকসিন কিংবা মুখে খাওয়ার ওষুধ, এটি যতদিন না পর্যন্ত মানুষের হাতে আসছে ততদিন একেবারে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা দুরূহ বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন একেবারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আরও বছরখানেক অপেক্ষা করতেই হবে।
বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে এখন সারা বিশ্বে দুই কোটি ৮৬ লাখের বেশি মানুষ কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে নয় লাখ ২০ হাজার ৪৬১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে গড়ে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত হয়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। বিশ্ব পরিস্থিতি বলছে দৈনিক তিন লাখের বেশি মানুষ এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে এক ভাগের মতো মানুষের অবস্থা চরম সঙ্কটজনক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতির যখন এই হাল তখন দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪৪ জন। আর এখন পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চার হাজার ৭০২ জন। প্রতিদিনই নতুন মৃত্যুর খবর আসায় দুনিয়াজুড়ে মানুষের কেউই খুব একটা স্বস্তিতে নেই।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সারাবিশ্বেই এখন তাকিয়ে রয়েছে একটি নিরাপদ কার্যকর ভ্যাকসিনের দিকে। ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ না হলে কোন ভ্যাকসিনকেই নিরাপদ বলা সম্ভব নয়। যদিও তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই রাশিয়া এবং চীন নিজেদের ভ্যাকসিনকে নিরাপদ দাবি করে তা দেশ দুটির সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করেছে। একই প্রক্রিয়াতে এগুচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী নবেম্বর থেকেও দেশটির সরকার ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। তবে এসব কিছুর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এর মধ্যেই।
নিরাপদ একটি ভ্যাকসিন পেতে আবিষ্কারের পর অন্তত ১৮ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়ে ধাপে ধাপে পরীক্ষা করে ভ্যাকসিনটির নিরাপত্তা যাচাই করা হয়। কিন্তু করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অনেক দিন ছাড় দেয়ার পরও চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি নিরাপদ ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করছে বিজ্ঞানীরা। তবে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের ট্রায়াল স্থগিত করাতে সেই আশায় এখন ভাটা পড়েছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের আরেক কোম্পানি ফাইজার বলছে আগামী অক্টোবর নাগাদ তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনটির শেষ ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল জানাতে পারবে। শেষ ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল আশাব্যঞ্জক হওয়ার পর আসে ভ্যাকসিনটির উৎপাদন এবং সরবরাহ করার পালা। ট্রায়ালে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলে এটি উৎপাদন এবং মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা সময় সাপেক্ষ বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস সম্প্রতি বলেছেন, এখন পর্যন্ত যেসব ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তা কতটা দক্ষ সে বিষয়ে কোন সংস্থাই ‘স্পষ্ট ইঙ্গিত’ দেয়নি। ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্বের পরীক্ষা একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে করা উচিত। কারণ আমাদের জানতে হবে সেই ভ্যাকসিন আদৌ মোকাবেলা করতে সক্ষম কি না। বা সেই ভ্যাকসিন আদৌ নিরাপদ তো! ডব্লিউএইচও এর এই মুখপাত্রের এমন আশঙ্কার মধ্যে ভ্যাকসিনের অগ্রগতি ঘিরে সংশয় সৃষ্টি হয়।
প্রথমে চীনের উহানে গত বছর ভাইরাসটি একজনের শরীরে শনাক্ত হয়। কেন কিভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি এটি নিয়ে সারাবিশ্বে এখনও জল্পনা-কল্পনার শেষ হয়নি। চীনা দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি আরও অনুসন্ধানের দাবি রাখছে। কিন্তু এই ভাইরাস যে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। সারা বিশ্বে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়াই তার বড় প্রমাণ। বলা হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষও ভাইরাসটি বহন করবে ততক্ষণ এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর এটি কার জন্য কতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠবে তা কেউই আগেভাগে বলতে পারে না। ফলে সচেতনভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সময় নির্বাচন করা কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের আয় কমেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুর মধ্যেই আটকে আছে মানুষ। কিন্তু কর্মহীন আর আয় কমে যাওয়া মানুষেরা আবার ঝুঁকি নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। কাজে ফেরার চেষ্টা করছে। যদিও সব ক্ষেত্রেই তা সফল হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া মেডিক্যাল স্কুলের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইজিকিয়েল জে ইমানুয়েল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আগামী এপ্রিল থেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরার চেষ্টা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর সেই ধরনের বার্তাই প্রচার করছে। কিন্তু তিনি কোভিড-১৯ এ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত দেশটির এমন উদ্যোগের বিষয় সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, একটি নরাপদ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অন্তত ১৮ মাস সময় প্রয়োজন হয় এটি সরকারকে মানতে হবে। আর এই সত্যটার জন্যই দেশবাসীকে প্রস্তুত করতে হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: