ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুস্থ হয়েও করোনা রোগীরা নানা জটিলতায়

প্রকাশিত: ২২:৩২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

সুস্থ হয়েও করোনা রোগীরা নানা জটিলতায়

নিখিল মানখিন ॥ সুস্থ হওয়ার পরও করোনা রোগীদের বড় অংশ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রায় ৯৮ শতাংশই সুস্থ হন। অনেক রোগীর পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। সুস্থ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই মাত্রার ওপর। কিছু আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুতই সুস্থ হন আবার কারো বেশ দীর্ঘসময় নানা ধরনের সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থা কোভিড-১৯ রোগীর অসুস্থতার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। আগস্টের প্রথম দিকে করোনায় আক্রান্ত হন মোঃ সুমন আহমেদ (৪৭)। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে তার বাসা। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তিনি রাজধানীর উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রায় দশ দিন তাকে অক্সিজেন দিতে হয়েছে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে সুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, শারীরিক দুর্বলতা রয়ে গেছে। মনে আতঙ্ক কাজ করে। শ্বাস-প্রশ্বাসে স্বাভাবিকতা এবং খাওয়া-দাওয়ার প্রতি পুরোপুরি রুচি পাচ্ছি না বলে জানান সুমন আহমেদ। সুস্থ হওয়ার তিন মাস পরও ফুসফুসে জটিলতা রয়ে গেছে রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁনপুরবাসী মোঃ ইলিয়াস হোসেনের (৫২)। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, মাঝে মধ্যেই শ্বাস নিতে কষ্ট লাগে। চিকিৎসক দেখিয়েছি। ফুসফুসে সমস্যা থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছি বলে জানান ইলিয়াস হোসেন। এভাবে সুস্থ হওয়ার পরও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন অনেক করোনা রোগী। দেড় মাস হয়েছে করোনামুক্ত হয়েছেন রাজধানীর মগবাজার এলাকার মধুবাগবাসী সৈয়দ আহমদ (৫৬)। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, আমি এমনিতেই ডায়াবেটিস রোগী। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই ডায়াবেটিসে ভুগছি। পাশাপাশি সামান্য কিডনি জটিলতাও রয়েছে। এমন অবস্থায় করোনায় পজিটিভ আসার পর মানসিকভাবে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালে ছিলাম ১৭ দিন। সুস্থ হওয়ার পরও দুশ্চিন্তা কাটছে না। কিডনি জটিলতা বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে শারীরিক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি বলে জানান সৈয়দ আহমদ। ২৯ বছর বয়স্ক সুলতানা বেগম শ্বাসকষ্ট নিয়ে গুরুতর অবস্থায় গত জুলাই মাসে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ঢাকায় কুর্মিটোলা হাসপাতালে। তিনি রাজশাহীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে নার্স হিসাবে কাজ করেন। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে হাসপাতালের কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসে প্রভাবে তার শরীরে জটিলতা বেড়েছে এবং মনে তৈরি হয়েছে ভয়। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, আগে থেকে আমার ডায়াবেটিস ছিল। এখন ডায়াবেটিস খুব আপডাউন করছে। আবার ইদানীং ব্লাড প্রেসারটাও ধরা পড়েছে। এখনও আবহাওয়াও একটু অন্যরকম, কখনও রোদ এবং কখনও বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময়ে একটু গলাব্যথা হলেই ভয় লাগে, এই বুঝি আবার কিছু হচ্ছে। বয়স লাগে, মনে একটা শঙ্কা চলে এসেছে। মানে স্বাভাবিক জীবনযাপন অনুভব করতে পারি না বলে জানান সুলতানা বেগম। নগরীতে কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দুই মাস আগে বাসায় ফিরেছেন ফার্মগেটের মনিপুরীপাড়ার মোঃ কামরুল (৬৩)। কিন্তু তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, একটা জটিলতা দুর্বলতা ছিল, এটা সাধারণত সবারই থাকে শুনেছি। কিন্তু আমার এই দুর্বলতা দীর্ঘ সময় ধরে চলে। এরপরে দেখা যাচ্ছে যে মাথা ঘোরে। এখনও শোয়া বা বসা থেকে উঠলে এবং হাঁটলে মাথা ঘোরে। এটা কিন্তু দু’মাস হওয়ার পরও রয়ে গেছে। যদিও বিশ্রামে আছি এবং যথেষ্ট প্রোটিন খাচ্ছি, তারপরও এই জিনিসটা যাচ্ছে না। সেজন্য আমি স্বাভাবিক কাজকর্ম করার জন্য এখনও ফিট নই বলে জানান মোঃ কামরুল। চালু হয়েছে পোস্ট করোনা ক্লিনিক ॥ করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও যারা নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, তাদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছে দুটি বড় সরকারী হাসপাতাল। গত সপ্তাহে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চালু হয়েছে ‘পোস্ট কোভিড ক্লিনিক’। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ চালু করেছে ‘পোস্ট করোনা ক্লিনিক’। পোস্ট করোনা ক্লিনিক চালু করার বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, গত মে মাস থেকে আমরা করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরও রোগীদের নানান ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আমাদের হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে যাঁরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকে মুঠোফোনসহ নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানাচ্ছেন, তাঁরা নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এসব ব্যক্তির চিকিৎসার কথা মাথায় রেখে আমরা পোস্ট কোভিড ক্লিনিক চালু করেছি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, গত ৩ জুলাই আমাদের হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা ও রিসার্চ বলছে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ হওয়ার পরও তাঁর ফুসফুসের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা পুরোপুরি সেরে ওঠে না। ফুসফুসের কিছু অংশ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত থেকে যায়। করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও কিছু জটিলতা থেকে যায়। যিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তিনি করোনামুক্ত হলেও কিন্তু নানান জটিলতা রয়ে যায়, এমন লোকদের কথা মাথায় রেখে পোস্ট করোনা ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। আমাদের হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকেরাই চিকিৎসাসেবা দেবেন। বিবিসির প্রতিবেদন ॥ এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারী করোনার থাবায় বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। ভাইরাসজনিত এ রোগ মূলত মানুষের শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে। ফুসফুস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আক্রান্তের বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রায় ৯৯ শতাংশই সুস্থ হন। তবে গত প্রায় চার মাসের অভিজ্ঞতা থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক রোগীর পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। সুস্থ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই মাত্রার ওপর। কিছু আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুতই উপশম হয় আবার কারো বেশ দীর্ঘসময় নানা ধরনের সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থা কোভিড-১৯ রোগীর অসুস্থতার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বিবিসির প্রতিবেদন বলা হয়েছে, যাদের সংক্রমণ কম হয়, তারা মাত্র এক সপ্তাহের কম সময়েও সুস্থ হয়ে ওঠেন অনেকে। বিশ্রাম, বেশি করে তরল পান এবং খুব সাধারণ কিছু ওষুধ দিয়ে বাড়িতেই আলাদা রেখে চিকিৎসার মাধ্যমে এদের সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু সংক্রমণ যদি গুরুতর হয়, শরীরের ভেতরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শ্বাসকষ্ট খুব বেশি হতে পারে তখন অক্সিজেন সহায়তা দিতে হয় বা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আর এমন অবস্থা হলে সুস্থ হয়ে উঠতে দুই থেকে আট সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। আর এর পরও ক্লান্তি ভাব থেকে থাকতে পারে আরও কিছু দিন। করোনা হলে চিকিৎসার পাশাপাশি আতঙ্কিত না হয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তারও দরকার। কার্ডিফ এ্যান্ড ভেল ইউনিভার্সিটি হেলথ বোর্ডের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ফিজিওথেরাপিস্ট পল টুজ বলছেন, আমরা জানি, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে রোগীরা অনেক সময় নেন, অনেক সময় সেটা কয়েক মাস হয়ে যায়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে এটা বলাও কঠিন। অনেক মানুষ ক্রিটিক্যাল কেয়ারে তুলনামূলকভাবে অল্প সময় থাকেন’। করোনা আক্রান্ত শিশুদের মাঝে এমআইএস নামক জটিলতা ॥ বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত শিশুদের মাঝে মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেশন সিন্ড্রোম (এমআইএস) নামক জটিলতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা আশঙ্কাজনক এবং তা শিশুমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৭ থেকে ৮ ভাগ স্কুলগামী বয়সের। আর মোট আক্রান্তের শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ শিশু । আর মৃদু সংক্রমণের কারণেও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যা শিশুদের জন্যও প্রযোজ্য। সম্প্রতি কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল্লাহ এমন তথ্য জানান। দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখনও গবেষণা হয়নি। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক মানুষ তাদের শরীরে নানা জটিলতা নিয়ে আবার হাসপাতালে যাচ্ছেন। ঢাকায় মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ টিটো মিয়া তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, মানসিক অবসাদ থেকে শুরু করে স্মৃতিভ্রমের মতো জটিল নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে সুস্থ হওয়া মানুষের শরীরে। প্রথমে দেখা যায় তারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন। রোগীরা অভিযোগ করে, আনডিউ টায়ার্ডনেস। রোগীরা বলে, তাদের কিছু ভাল লাগছে না, কিছু করতে ইচ্ছা করছে না। এরকম একটা অবস্থা থাকে। কারও কারও দেখা যায়, প্যানিক ভাবটা থাকে। হঠাৎ করে মনে হয় যে, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা দম বন্ধ হয় যাচ্ছে। মোঃ টিটো মিয়া আরও জানান, আর কিছু সমস্যা দেখা যায়, যার প্রভাবে আমাদের তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। যেমন কারও কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটা আরও জটিল হয়। কোভিড ভাল হয়ে যায়, জ্বর আর থাকে না। কিন্তু কারও কারও ফুসফুসে পরিবর্তন হয় এবং জটিলতা দেখা দেয়। আবার কেউ হার্ডের সমস্যায় পড়েন। হার্ড ফেইলোরও হয়। অনেক সময় হঠাৎ কার্ডিয়াক ডেথও হয়ে যায়। হার্ডের রিদমেরও সমস্যা হয়, হার্ড বিট কখনও স্লো হয়ে যায় বা খুব বেড়ে যায়। এছাড়া অনেকের ভুলে যাওয়ার বিষয়টা বেড়ে যায় বলে জানান ডাঃ মোঃ টিটো মিয়া।
×