ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

২১ আগস্ট ২০০৪- ফিরে দেখা

প্রকাশিত: ২২:১২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

২১ আগস্ট ২০০৪- ফিরে দেখা

(গতকালের পর) শেখ হাসিনার যাওয়ার পর আমি মাথা তুলে ও সামনে পাশে চেয়ে দেখলাম, ট্রাকের দক্ষিণে, পশ্চিমে ও উত্তরে রক্তমাখা অনেক লাশ, আহত লোকজন এবং দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আছে। আমি লক্ষ্য করেছি পূর্ব দিক থেকে একটি পুলিশ ভ্যান এসে ট্রাকটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থামল, ৫-৬ জন পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে নেমে ছড়ানো লাশ, কয়েকজন আহত মানুষ ও বিচ্ছিন্ন হাত পা ট্রাকে উঠিয়ে ঘুরে দ্রুত গতিতে পূর্বদিকে চলে গেল। এই পিকআপ ভ্যানটি ট্রাকের পশ্চিমে বা উত্তর দিকে যায়নি। ট্রাকের উত্তর ও পশ্চিম দিকে ছড়ানো লাশ ও আহত মানুষ জনকে আমাদের দলীয় কর্মীরা তুলে এ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, গাড়ি ও রিক্সাভ্যানে করে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা নিরাপদ স্থানে পাঠাতে থাকেন। কর্মীরা যখন মৃত ও আহতদের নিয়ে ব্যস্ত এবং অন্যরা দলের কেন্দ্রীয় অফিস ও আশপাশের দোকানগুলো ও রাস্তার পূর্ব প্রান্তের দিকে নিরাপত্তার জন্য দৌড়ে যাচ্ছিলেন তখন পুলিশ তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস শেল ছোড়ে। গোলাপ শাহ্ মাজারের দিক থেকেও টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়। শৃঙ্খলা রক্ষার মোড়কে এর চেয়ে অধিকতর নিন্দনীয় অন্য কোন কাজ পুলিশ এ সময়ে করতে পারে বলে ভাবতে পারিনি। এভাবে লাঠিচার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে পুলিশ অপরাধীদের অকুস্থল থেকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। যে সংখ্যক পুলিশ তখন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে মোতায়েন ছিল সে সংখ্যক পুলিশ ইচ্ছা করলে বা নির্দেশ পেলে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে সব ব্যক্তিকে তালাশ করে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারত। কিন্ত তা তারা করেনি বা তাদের করতে দেয়া হয়নি। প্রাথমিক শক কাটিয়ে উঠে ট্রাকে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম আমার গায়ের কুর্তা পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। আমি ভেবেছি গ্রেনেডের স্পিন্টার বা গুলি আমার শরীরে লেগেছে, ঘটনার সময় স্নায়ু কাজ করেনি বলে শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করছি না। চার বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রথম দিকে এমনি আমি শরীরে কোন ব্যথা অনুভব করিনি। দেখলাম রক্তমাখা শরীর নিয়ে শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু, হানিফ, সাহারা খাতুন হামাগুঁড়ি দিয়ে কিংবা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ট্রাক থেকে নেমে যাচ্ছেন। তাদের পেছনে সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, ট্রাক থেকে পা টানতে টানতে নেমে গেলেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য জিল্লুর রহমান ঘটনার শকে নিশ্চুপ নিথরভাবে ট্রাক-ডেকে শুয়ে পড়েছিলেন। তাকে কয়েক দলীয় কর্মীসহ ট্রাক থেকে তুলে নামিয়ে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ঠিক পেছনে সারা শরীরে রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য, কাজী জাফরুল্লাহ্। তিনি আমাকে বললেন, আমি আহত, আমাকে ছেড়ে যাবেন না। কয়েক দলীয় কর্মীর সহায়তায় তাকে আমি ট্রাক থেকে নামিয়ে তাকে নিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে ঢুকলাম। ঢোকার পথে জনতার প্রচন্ড চাপে আমরা প্রায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। জনতার এই চাপ এসেছিল পুলিশ বাইরে লাঠিচার্জ করছিল ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ছিল বলে। টিয়ারগ্যাস শেল ছোড়ার শব্দের মাঝে পিস্তলের গুলির আওয়াজও শুনেছি মনে হল। দেখলাম কেন্দ্রীয় অফিসের নিচ তলায় রক্তে ভেজা জামা-কাপড় গায়ে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, হানিফ ও আরও অনেকে। তিল ধারণের জায়গা নেই। আমি কাজী জাফরুল্লাহ্কে কয়েক কর্মীর সহায়তায় টেনে ধরে তৃতীয় তলায় উঠালাম। দ্বিতীয় তলার কামরাগুলো তালাবদ্ধ ছিল। এসব কামরাগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত আওয়ামী লীগের কর্মচারী শাহ্জাহানকে কোথাও পেলাম না। পরে শাহ্জাহানকে মিরপুরের সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে স্পিন্টারে আহত অবস্থায় দেখতে পাই। তিন তলায় আমি কাজী জাফরুল্লাহ্কে একটি বেঞ্চির ওপর শুইয়ে দিয়ে দেখি তার পালস দুর্বল। তার শরীরের বাঁ দিক রক্তে ভেজা। তিনি তার বাঁ হাতে প্রচ- ব্যথা হচ্ছে বললেন। বললেন, তার চোখের দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে যাচেছ। আমি এ্যাম্বুুলেন্স জোগাড় করার জন্য নিচে দৌড়ে নেমে আসি। এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে আমি তিন তলার ওপর ছাদে দৌড়ে উঠলাম চারদিক দেখব বলে। দেখলাম উত্তর দিকে জিপিওর বরাবর কুন্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। তারপর পূর্বদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম : রাজ্জাক’স নামে দোকান সংবলিত ইমারতের ছাদের উপরে পুলিশের নীল শার্ট গায়ে ও নিচে লঙ্গি পরিহিত ৩ জন রাইফেলধারী লোক দাঁড়িয়ে। একজন দলীয় কর্মী চিৎকার করে আমাকে তখনই সরে যেতে বললেন। আমি দৌড়ে তিন তলায় কাজী জাফরুল্লাহ্র পাশে চলে এলাম। এই সময়, প্রায় ৬টা ২০ মি. তখন, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী দৌড়ে উপরে উঠে আসলেন। সাবের হোসেন ও মতিয়া চৌধুরী শেখ হাসিনা যে মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন বলে এসেছিলেন, তার আগের দিকে সমাবেশকে নূর হেসেন চত্বরের কাছে সংগঠিত করছিলেন। সে জন্য গ্রেনেড হামলায় তারা আঘাত পাননি বা আহত হননি। তিনি বললেন, গ্রেনেড হামলা থামার পর তিনি কেন্দ্রীয় অফিসে ছুটে এসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও অন্যান্য নেতাদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নেয়ার ব্যবস্থা করছেন। মোবাইল ফোন ও লোক মারফত আমরা কাজী জাফরুল্লাহ্র জন্য এ্যাম্বুলেন্স আনতে চেষ্টা করলাম। বিফল হয়ে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কিছু না কিছু একটা জোগাড় করা যাবে বলে আমরা তাকে নিচে নামিয়ে আনলাম। এদিক ওদিক দৌড়ে একটি রিক্সাভ্যান জোগাড় করে তাকে মাঝখানে বসিয়ে একদিকে আমি আর এক দিকে সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে সচিবালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বাংলাদেশ রাইফেলের একটি চৌকস দলকে মোতায়েন দেখলাম। বাংলাদেশ রাইফেলের ওই দলকে সচিবালয়ের মোড়ে মোতায়েন দেখে আমাদের বড় বেখাপ্পা লাগল। আগে থেকে বিজ্ঞপ্ত ও তৈরি না রাখলে গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এত অল্প সময়ে বিডিআর দল সেখানে মোতায়েন হতে পারত না। মনে হলো একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত কর্মসূচীর আওতায় এই ধরনের ঘটনার আগ থেকেই বিডিআরের দল নিয়োজিত করার ব্যবস্থা ছিল। আব্দুল গনি সড়ক ধরে এগিয়ে ওসমানী মিলনায়তনের কাছে একটি গাড়ি পেয়ে কাজী জাফরুল্লাহ্কে তাতে উঠিয়ে আমি আর সাবের ঢাকা মেডিক্যাল কালেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দিকে ছুটলাম। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের জরুরী বিভাগের প্রবেশ মুখে এসে দেখলাম ওই বিভাগের দরজা-তালাবদ্ধ। বলা হলো ভেতরে ইতোমধ্যে এত বেশি আহত ব্যক্তি এসেছেন যে কর্তব্যরত ডাক্তাররা আর কারও চিকিৎসা করতে পারবেন না। পরে আমি জেনেছি যে বিকেল ৪টার দিকে তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এই হাসপাতালের জরুরী বিভাগের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা/ডাক্তারদের এহেন আচরন দেখে আমরা হতবিহ্বল হয়ে ইস্কাটনের একটি বেসরকারী ক্লিনিকে কাজী জাফরুল্লাহ্কে নিয়ে যাই। এই ক্লিনিকের ডাক্তার ও সার্জনরা কাজীর সঙ্গে আগ থেকেই পরিচিত ছিলেন। চেনা ডাক্তার ও সার্জনদের কাছে কাজীকে হস্তান্তর করে আমরা সুধা সদনের দিকে ছুটে যাই। সুধা সদনে আমরা সন্ধ্যা ৮.২৫ মিনিটের দিকে পৌঁছি। শ’য়ে শ’য়ে বিক্ষোভে ফেটেপড়া জনতা তখন সুধাসদনের সামনে। শেখ হাসিনা নিরাপদে আছেন দেখে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। দেখলাম নেত্রী খানিকটা বিমর্ষ অথচ দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ। তিনি স্বভাব সুলভ আত্ম-প্রত্যয়ের সঙ্গে সমবেত সবাইকে সাহস নিয়ে ক্রাইসিস মোকাবেলা করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে আহতদের নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। খানিক পরে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ অন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছুটে এসে জননেত্রীকে তাদের দুঃখ, সহানুভূতি, বিক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা জানান। সেদিন রাতে ও পরদিন আমি বুলেট ও স্পিন্টারে অন্য আহতদের মধ্যে দেখি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও কাজী জাফরুল্লাহ্কে শমরিতা হাসাতালে, আবদুর রাজ্জাক ও ওবায়দুল কাদেরকে শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, মোহাম্মদ নাসিম, বাহাউদ্দীন (নাছিম) ও বজলুর রহমানকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে, শাহ্জাহান ও দীপ্তিকে সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে এবং আরও প্রায় ৩০ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসে ড. মোস্তফা জালাল মহীউদ্দীনসহ হামলায় নিহত ১৮ জনের লাশ ময়নাতদন্তের পর নেয়ার জন্য অপেক্ষা করি। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টার পর রাত ৮.৩০ মিনিটের দিকে পুলিশ এদের লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। ২২ আগস্ট বিকেলে ইতোমধ্যে ঘোষিত শোক মিছিলে যাতে আমরা লাশ নিয়ে যোগ না দিতে পারি তার জন্য উপরের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ লাশ হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটিয়েছিল। এই সময় জানা যায় যে বঙ্গীয় পুলিশ প্রবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ না করে দায়সারাভাবে এসব লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করা হয়েছিল। এই নারকীয় অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের লক্ষ্যে এই দু’দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা করা বা জবানবন্দী নেয়া হয়নি। ঐ ২২ শে অগাষ্ট তারিখেই এ ঘটনার ওপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুদল জলিলের সইকৃত এজাহার রমনা পুলিশ গ্রহণ করেনি। গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে রমনা থানার পুলিশ বলেছে যে অকুস্থল বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ রমনা থানা নয়, মতিঝিল থানার আওতাভুক্ত। অথচ ময়নাতদন্ত করার জন্য নিহতদের লাশ নিয়ে এসে তদন্ত শেষে লাশগুলো হস্তান্তর করতে রমনা থানার পুলিশই উপরস্থ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছে। একই এজাহার ওইদিন মতিঝিল থানায়ও গ্রহণ করা হয়নি। মতিঝিল থানার তরফ হতে এজাহার গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তারা এর আগে একই ঘটনার বিষয়ে একজন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে এজাহার গ্রহণ করেছে। একই ঘটনার বিষয়ে, তাদের মতে দ্বিতীয়বার এজাহার গ্রহণ করা যায় না। এই ঘটনার বিষয়ে পুলিশের দেয়া এজাহারে ওইদিন ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে ভাংচুর ও পুলিশকে কর্তব্য কাজে বাঁধা দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ২১ আগস্ট ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর গ্রেনেড হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমানসহ আরও ১৩ জন কর্মী একই হামলায় আহত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। যারা মৃত্যু বরণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দীন, শিকদার, আতিক সরকার, আবুল কাশেম, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। পাঁচ শ’র বেশি নেতাকর্মী এই নারকীয় হামলায় আহত হন। এদের মধ্যে অনেকেই এত গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন যে এদের জন্য দেশের বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আহতদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক কর্মী পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার বা হেনস্তা হওয়ার আশঙ্কায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাননি। পুলিশ যে সব লাশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে সময়, সেগুলো শোনা যায়, ২২ আগস্টের রাতে শাহ্জাহানপুর গোরস্তানে লোকচক্ষুর আড়ালে মাটি চাপা দেয়া হয়। সে রাতে দু’শতাধিক পুলিশ গোরস্তান ঘিরে তাদের যা করতে বলা হয়েছিল তাই করেছে বলে শোনা গেছে। ২১ তারিখে রাতেই আহতদের চিকিৎসা এবং নিহতদের অসহায় পরিবার পরিজনকে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ তহবিল খোলেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বে¡ও সরকার আহতদের চিকিৎসা বা সহায়তা দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ২২ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যেয়ে দেখি তারা তাদের পরিজন ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দিয়ে স্যালাইন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনে আনছেন। তাদের বলা হয়েছে যে, এসব জরুরী ওষুধ ও চিকিৎসার উপকরণ হাসপাতালে নেই। এই হাসপাতালে তাদের চিকিৎসায় মনোযোগ তুলনামূলক কম দেয়া হয়েছে বা একেবারেই দেয়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র সচিব, তাদের অফিস থেকে এই নারকীয় ঘটনার স্থান ৩০০ গজের বেশি দূরে না হওয়া সত্ত্বে¡ও, তা সরেজমিনে দেখতে যাওয়ার সময় পাননি। পুলিশের মহাপরির্দশক, মহানগরের পুলিশ কমিশনার ও তার ডেপুটিগণ ঘটনাস্থল দেখতে গিয়েছিলেন কিনা জানা বা দেখা যায়নি। আমার বিবেচনায় এই নারকীয় অপরাধের ঘটনা অতি উঁচু পর্যায়ে কর্মরত কিংবা যোগসূত্র সংবলিত কতিপয় ব্যক্তি ঘটানোর জন্য অতীব যত্নের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছিল। তাদের নির্দেশে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমরাস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী একটি ভাড়াটে দল। আর এতে সহযোগিতা করেছিল পুলিশ ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ভাড়াটিয়া পেশাদার সন্ত্রাসীরা, যাদের ছত্রছায়ায় হামলাকারীরা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। পরে আমি জানতে পেরেছি যে এর আগে ১৬ ও ১৮ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনার টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থানের সময় তাকে লোকবল ও অস্ত্রের মানে পুলিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আগের চেয়ে অনেক বিস্তৃত স্কেলে প্রতিরক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ২১ আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সভায় তার নিরাপত্তা সম্পর্কে আমাদের উদ্বিগ্নতার মাত্রা কমিয়ে আমাদের দল থেকে সাধারণত দেয়া নিরাপত্তার বেষ্টনী টেনে ধরার অসৎ উদেশ্যে এ করা হয়েছিল। সুপরিকল্পিতভাবে এসব লোক দেখানো ব্যবস্থার মোড়কে দৃশ্যত ফুল ছড়ানো পথ ধরে টেনে নিয়ে প্রকৃত পক্ষে এরা বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউকে সেদিন মৃত্যু উপত্যকায় ঠেলে নামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। স্পটত এরূপ সুপরিকল্পনার মূল দায় সেই সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী প্রধানমন্ত্রী খালেদার ওপর বর্তায় এবং এই প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের বিচারকের নেতৃত্বে খালেদার দায় বিষয়ে যথার্থ তদন্তের জন্য একটি কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া সঙ্গত হবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বছরে ২২ আগস্ট খালেদা জিয়াকে ২০০৪ এর ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য সুস্পষ্টভাবে দায়ী করেছেন। ২১ আগস্টের সেই শোকাবহ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বঁাঁচানোর জন্য তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার দুটি ন্যক্কারজনক কাহিনী ও বিচার বিভাগীয় প্রত্যয়নের আশ্রয় নেয়। এক, ঢাকার বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমীনকে দিয়ে নোয়াখালীর সেনবাগ থানার বীরকোট গ্রামবাসী জজ মিয়া নামক এক নিরীহ ব্যক্তিকে পুলিশের ফৌজদারী কার্যালয়ে (সিআইডি) নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কুশীলবদের বানানো জবানবন্দী মুখস্থ করিয়ে গ্রেনেড ছোড়ার দায় উল্লেখ করে মিথ্যা আত্ম-অপরাধের স্বীকারোক্তি নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরূপ স্বীকারোক্তি দেয়ার বিনিময়ে তার স্ত্রীকে আজীবন মাসিক ৩ হাজার টাকা মাসোয়ারা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে এবং ৫ বছর কারাবাসের পর নিরাপরাধ জজ মিয়া মুক্তি পান এবং গ্রেনেড হামলার দায় অন্যদের ওপর চাপানোর জন্য বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর অনৈতিক কারসাজি জনসম্মুখে বেরিয়ে আসে। দুই, একজন উচ্চ আদালতের বিচারক, নামত জয়নাল আবেদীনকে দিয়ে ১টি ১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করে মাত্র ২ দিনের মধ্যে তাকে দিয়ে অবিশ্বাস্য ও লজ্জাজনকভাবে বিদিত করে যে ২১ আগস্টের ওই নারকীয় ঘটনা ও হত্যাকান্ড মূলত দেশের বাইরে থেকে পরিকল্পিত ও প্রযুক্ত হয়েছিল। শোনা যায়, এই অনুগত কাজের বিপরীতে ওই বিচারককে চাকরির মই ধরে আরও উপরে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিযুক্তি দিয়েছিল। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারিতে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ার সরকারের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। আরও জানা যায় যে খালেদার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উঁচু পর্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি, ঢাকার মহানগর পুলিশ এই ঘৃণ্য অপরাধের কর্মকারক হিসেবে কাজ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক শুরু করা তদন্তের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী ২০০৮ সালে হত্যা ও হামলাকারীদের বিচার শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আদালতের অনুমতি নিয়ে অধিকতর তদন্ত সম্পন্ন করে সে সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র বিচারকের সামনে উপস্থাপিত করে। প্রথম অভিযোগ পত্র অনুযায়ী এই অপরাধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল ২২ জনকে। বিস্তারিত তদন্তের পর তৈরি সম্পূরক অভিযোগ অনুযায়ী আরও ৩০ জন অভিযুক্ত হয়। সম্পূরক অভিযোগ পত্রে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির তারেক রহমান, লুৎফজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী ও জামায়াতের আলী আহসান মুজাহিদ এবং শীর্ষ পর্যায়ের ২ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এই বিচার ক্রমে সরকার পক্ষে আইনজীবী হিসাবে নিরলস ও অভিজ্ঞ ভূমিকা পালন করেন এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। ২০১৩ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন ওই নারকীয় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষ দর্শক হিসাবে বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম আমিও। (চলবে) লেখক : এমপি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
×