ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ

ক্যাসিনো সম্রাট নেই আছে সাম্রাজ্য, চলছে চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ২২:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

ক্যাসিনো সম্রাট নেই আছে সাম্রাজ্য, চলছে চাঁদাবাজি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ক্যাসিনো সম্রাট নেই, তবে সাম্রাজ্য আছে। যদিও সেসব সাম্রাজে এখন আর ক্যাসিনো চলছে না। চলছে চাঁদাবাজি। যেসব এলাকাকে টার্গেট করে ক্যাসিনো চালু করা হয়েছিল, চাঁদাবাজি চলছে মূলত সেসব এলাকাতেই। ঢাকায় আবারও ক্যাসিনো সা¤্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালরা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের সহযোগীদের একটি অংশ ঢাকার নতুন নতুন এলাকায় অনলাইন ক্যাসিনো চালুর চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই চারজন গ্রেফতারও হয়েছে। বাকি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চাঁবাবাজি করছে। যাদের অধিকাংশই ক্যাসিনোর সম্রাটের লোকজন। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই এক সময় ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপি করতো। হালে ক্ষমতাসীন দলে নাম লিখিয়ে তারা অপকর্ম করে যাচ্ছে। যার দায় বর্তাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ ও ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্র থেকে এমনটাই জানা গেছে। চাঁদাবাজির শিকার হওয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই অভিযোগপত্রে জানানো হয়েছে, ক্যাসিনো সম্রাট ও কয়েক সহযোগী গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের সহযোগীরা চাঁদাবাজি করছে। যার মূল কারিগর সাবেক বিএনপি নেতা ও ক্যাসিনো সম্রাটের সহযোগী মোঃ শাহাবুদ্দিন। তিনি এক সময় ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএনপির গুলিস্তান এলাকার সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হক মঞ্জুরের সহযোগিতায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেন তিনি। ক্ষমতার পালাবদলে সরকারী দলে নাম লেখান তিনি ও তার সহযোগীরা। সখ্য গড়ে তুলেন ক্যাসিনো সম্রাটের সঙ্গে। তার মাধ্যমেই ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হন। এরপর তারা প্রথমেই গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন। গুলিস্তানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রের পরিচালক আলী আহম্মেদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে প্রতি রাতে ৩০ হাজার করে ভাগও পেতেন। শাহাবুদ্দিন ও ক্যাসিনো সম্রাটের সহযোগীদের নিয়ে গুলিস্তানের পাঁচটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেন। মার্কেট কমিটির সভাপতি হয়ে বসেন তিনি। তাকে সহযোগিতা করেন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা শাহ মোহাম্মদ বাদল, বিএনপি নেতা শাহ আলম চৌধুরী ও জামায়াত নেতা ফিরোজ আলম। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে লোকমান, দুলাল, সাজু, মনির, আব্দুর রহিম ও উজ্জ্বল। তারা সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানকার জেনারেটর, আটটি এস্কেলেটর সিঁড়ি বিক্রি করে দেন। মার্কেটের ওপর অবৈধ দোকান নির্মাণ করে। বেআইনী কর্মকান্ডের জন্য সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা শাহবাগ মডেল থানায় জিডি করেন। মার্কেটের বৈধ মালিকরা অবৈধ দোকান নির্মাণের কারণে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত অবৈধ দোকান নির্মাণে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তারপরেও তারা অবৈধ কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। সেখানে ৬৫৭টি দোকান নির্মাণ করে প্রায় ৮০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। দোকানের রেজিস্ট্রেশন দেয়ার কথা বলে প্রতি দোকান থেকে ৬ লাখ টাকা করে আরও প্রায় সাড়ে ৩৯ কোটি টাকা নেয়। এভাবে তারা বঙ্গবাজার মার্কেট ক ও খ দখল করে। মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় ৩শ’ দোকান তুলে ৩০ কোটি টাকা বিক্রি করে। গুলিস্তানের বিভিন্ন ফুটপাথে দেড়শ’ দোকান তুলে ৬ কোটি টাকা বিক্রি করে। তাকে সহযোগিতা করছেন কমিশনার রতন ও হাসান। এসব বিষয়ে পুলিশ যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, তার জন্য অনুরোধ করা হয় অভিযোগপত্রে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরারপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে অস্ত্রসহ যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া র্যা বের হাতে গ্রেফতার হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মোতাবেক, খালেদ ফ্রিডম পার্টির নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই কমিশনার খোকনের হাত ধরে যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করলে যুবলীগের ক্ষমতাধর নেতা হয়ে উঠেন। বাগিয়ে নেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। এরপরই শুরু হয় তার ক্যাসিনো কারবার, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি। খালেদের সূত্র ধরে একে একে গ্রেফতার হয় ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো স¤্রাট, ক্যাসিনো বাদ্রার্স এনু-রূপন, জি কে শামীমের মত বড় বড় রাঘব বোয়ালরা। গ্রেফতারকৃতরা ঢাকার মতিঝিল, শাজাহানপুর, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন, মেরাদিয়া থেকে শুরু করে ঢাকা দক্ষিণের এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে তারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হিউম্যান হলারের স্ট্যান্ড স্থাপন করে চাঁদা আদায়, ক্যাসিনো ব্যবসা, সরকারী জমি দখল করে হাট বসানো, ক্লাব বানিয়ে জুয়ার আসর বসানো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও মার্কেটগুলোতে চাঁদাবাজি করেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ নাজমুল হক জানান, আগে যারা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ছিল, তাদের যোগসাজশে আবার নতুন করে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা শুরুর চেষ্টা চলছে। এমন তথ্য মোতাবেক গত ২৪ আগস্ট গুলশানের কালাচাঁদপুর এলাকা থেকে অনলাইনে ক্যাসিনো বা জুয়া হিসেবে পরিচিত শিলং তীর জুয়ার এজেন্ট শামিম ও আব্দুল আলীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর এজেন্ট এরশাদ ও সোহাগকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছে অনলাইন ক্যাসিনো চালানোর রেজিস্টার খাতা, ১-৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিশিষ্ট ৪টি চার্ট সম্বলিত ব্যবহৃত শীট ও ৫টি অব্যবহৃত চার্ট সম্বলিত শীট পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মোতাবেক, ১৯৯০ সালে সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গৌহাটি এলাকা থেকে চালু হয় এই জুয়া খেলাটি। এরপর তা সিলেট ও নেত্রকোনা হয়ে ঢাকায় আসে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক, ভারতের শিলংয়ের জুয়াড়িরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশী এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেলসম্যান নিয়োগ করেন। সেলসম্যানরা ১ থেকে ৯৯ নম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন গুটি বা নম্বর জুয়াড়িদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় বিক্রি করতেন। ক্রেতাদের বলা হতো, যদি এসব নম্বর জুয়ার বোর্ডে ওঠে তাহলে, গুটি বা নম্বরের ক্রেতা যে পরিমাণ টাকা দিয়ে নম্বরটি কিনেছে তার পাঁচ গুণ টাকা পাবে। শিলংয়ে রবিবার ব্যতীত সপ্তাহের ৬ দিন বাংলাদেশ সময় সোয়া চারটায় জুয়া খেলার ড্র অনুষ্ঠিত হতো। বিক্রি করা নম্বরের মধ্যে একটি নম্বর বিজয়ী হবে এটিই স্বাভাবিক। তাকে কথা মোতাবেক পাঁচগুণ টাকাও দেয়া হতো। বাকি গুটি বা নম্বর বিক্রির বিপুল টাকা তাদের কাছে থেকে যেত। দেশের এজেন্ট ও সেলসম্যানরা কমিশন নেয়ার পর বাকি টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হতো শিলংয়ে। এ ব্যাপারে গুলশান মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
×