ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী সহায়তা পেতে চায়

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের চেষ্টা বিএনপির

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের চেষ্টা বিএনপির

শরীফুল ইসলাম ॥ রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার চেষ্টা করছে। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই তারা বৈদেশিক সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে চায়। এ জন্য ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে শীঘ্রই একটি ভার্চুয়াল মতবিনিময় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যেই কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শেষ করা হয়েছে। সূত্র মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর থেকে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথে বৈদেশিক সহায়তা পাচ্ছে না। ওই নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি পরবর্তীতে লাগাতার জ্বালাও পোড়াও নাশকতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিদেশে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে দলটি। মৌলবাদী ক’টি দেশ ছাড়া আর কোন দেশই বিএনপিকে আগের মতো আর সহযোগিতা করে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ যাত্রায় চেষ্টা সফল না হলে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। কূটনীতিক তৎপরতা জোরদারের বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বিএনপি দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভার আয়োজন করবে জানিয়ে সেখানে ব্রিটিশ হাইকমিশনকে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উল্লেখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকেই বিএনপি বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দৌড়ঝাপ শুরু করে। কিন্তু তাতে তেমন সফল হতে পারেনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে আবারও নতুন উদ্যমে জোরেশোরে কূটনীতিক তৎপরতা শুরু করে বিএনপি। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে লিখিত চিঠি দেয়া হয় দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু ওই যাত্রায় কূটনীতিক তৎপরতায় সফলতা অর্জন করতে পারেনি বিএনপি। অতীতে রাজপথে নেতিবাচক কর্মসূচী পালন করে বিদেশী কূটনীতিকদের সমর্থন না পাওয়ায় এবার খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও তাকে মুক্ত করতে রাজপথের কঠোর কর্মসূচীতে যায়নি বিএনপি। দফায় দফায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আইনী লড়াই চালিয়ে যায় দলটি। পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্তির দাবি জানাতে থাকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদেরও সহযোগিতা চায় তারা। এদিকে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের সকল চেষ্টা বিফল হওয়ার পর ভিন্ন কৌশল নেয়া হয়। এক পর্যায়ে স্বজনরা দৌড়ঝাপ শুরু করে। এরইমধ্যে এ বছর ৮ মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং বিদেশে যাওয়া যাবে না এই দুই শর্তে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় অবস্থান করেন খালেদা জিয়া। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার স্বজনরা তাকে লন্ডনে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। খালেদা জিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমান খালেদা জিয়ার লন্ডনে থাকা ও চিকিৎসার বিষয়ে যাবতীয় প্রস্তুতি নেন। তবে সরকার যাতে তাকে মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয় সেজন্য বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার স্বজনরা আবারও দৌড়ঝাপ বাড়িয়ে দেন। এ বিষয়ে বিদেশী কূটনীতিকদেরও সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু কূটনীতিকরা এ বিষয়ে বিএনপিকে কোন সহযোগিতা করেনি। এক পর্যায়ে স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার আবারও খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আগের মতো দুই শর্তে ৬ মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে আরও ৬ মাস খালেদা জিয়া মুক্ত থেকে গুলশানের বাসায় অবস্থান করতে পারবেন। তবে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্তসহ চিঠি দিয়ে দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পেতে জোরালো চেষ্টা চালায় বিএনপি। কিন্তু বিএনপির অতীত কর্মকা- ও ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলেও আশানুরুপ পরিবর্তন আসবে এমন আস্থা না পেয়ে বিএনপির তৎপরতায় সাড়া দেয়নি আন্তর্জাতিক অঙ্গন। জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা বড় বড় দেশগুলো খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে নীরবতা পালন করে। আগে বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও এখন আবার নতুন করে কূটনীতিক তৎপরতা জোরদারের চেষ্টা করে বিএনপি। কৌশলগত কারণে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানসহ ক’জন সিনিয়র নেতা এবং ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী কূটনীতিক তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন। তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। তবে এ যাত্রায়ও বিএনপি কূটনীতিক তৎপরতায় সফল হবে কি না তা অনিশ্চিত। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাপক কূটনীতিক তৎপরতা চালিয়েও বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে তেমন কোন সহযোগিতা পায়নি। এর ফলে তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন বর্জনের এক বছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের ভবিষ্যত করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় তারা দলের জন্য সুবিধা আদায় করতে আন্দোলনের পরিবর্তে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকেই বিএনপির কিছু নেতা দেশে বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে অধিক সক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু বিদেশী কূটনীতিকরা নেতিবাচক কর্মসূচীর পরিবর্তে ইতিবাচক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালে বিএনপি কৌশল পরিবর্তন করে। এরপর ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর সহায়তায় ইতিবাচক কি কর্মসূচী পালন করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে দলীয় ক’জন নেতাকে কূটনীতিক তৎপরতা চালিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে দাবি জোরদার করার নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার অংশ হিসেবে বিএনপি ভারতের সঙ্গেও দফায় দফায় সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি বিএনপি। সর্বশেষ খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরও ভারতের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রতিবেশী দেশের কোন সহযোগিতা পায়নি বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দলের নাজুক অবস্থা কাটিয়ে তুলতে দলীয় হাইকমান্ড বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে কূটনীতিক তৎপরতাও জোরদার করা হচ্ছে। এখন থেকে আবার নিয়মিত কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে বিএনপি। শীঘ্রই ঢাকায় কর্মরত সবদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা করা হবে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে আমরা প্রায়ই মতবিনিময় করে থাকি। শীঘ্রই আবারও আমরা মতবিনিময় করব।
×