ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নব্য জেএমবির সিঙ্গেল এ্যাটাক গ্রুপ এফ জেড ফোর্স

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

নব্য জেএমবির সিঙ্গেল এ্যাটাক গ্রুপ এফ জেড ফোর্স

শংকর কুমার দে ॥ ভয়ঙ্কর জঙ্গী গ্রুপ এফ জেড ফোর্স। জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির এটা সিঙ্গেল এ্যাটাক গ্রুপ। স্লিপার সেল পদ্ধতিতে টার্গেট করে তারা। এই গ্রুপের টার্গেট রাজনীতিবিদ ও বিত্তশালীরা। সংগঠনটির রয়েছে বিশেষ বাহিনী, গুপ্তচর বাহিনী, গুপ্ত ঘাতক ইউনিট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ফোর্স, ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট। বিশেষ বাহিনীর কাজ হত্যা, গুম ও কমান্ডো হামলা চালানো। গুপ্তচর ইউনিটের কাজ শত্রুপক্ষের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ এবং স্নাইপার ইউনিটের কাজ নিরাপদ দূরত্বে থেকে শত্রুকে শেষ করে দেয়ার মিশন। নব্য জেএমবির ‘এফজেড’ ফোর্স নামে স্লিপার সেলের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সিটিটিসি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সম্প্রতি নব্য জেএমবির এফজেড ফোর্সের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এফজেড ফোর্সের দুই সদস্যকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৬ আগস্ট ঢাকার সদরঘাট থেকে গ্রেফতার হয় সদ্য কৈশোর পার হওয়া দুই যুবক -সাফফাত ইসলাম ওরফে আবদুল্লাহ ওরফে উইলিয়াম ওরফে আল আরসালান ওরফে মেহেমেদ চাগরি বেগ (১৮) ও ইয়াসির আরাফাত ওরফে শান্ত (২০)। সাফফাত ও ইয়াসিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, দু’জনই অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে। ২০১৬ সালে নব্য জেএমবির অন্যতম সমন্বয়ক তানভীর কাদেরী তার কিশোর দুই ছেলেকেও জঙ্গীবাদে জড়িয়েছিল। এক ছেলে পুলিশী অভিযানে মারা গেলেও অপরজনকে গ্রেফতারে সক্ষম হন নিরাপত্তা রক্ষীরা। সেই ঘটনার চার বছর পর ফের কিশোরদের জঙ্গীবাদে জড়ানোর ঘটনা সামনে এলো। নব্য জেএমবির কথিত এফজেড ফোর্স স্লিপার সেলের সবার বয়সই কম। সিটিটিসি জানতে পেরেছে, অনলাইনে যুদ্ধ যুদ্ধ ফাঁদ পেতে কিশোরদের আকৃষ্ট করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয় শিশুদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য। খেলার ছলে তাদের উত্তেজিত করে বিভিন্ন ধর্মীয় পোস্ট প্রচার করে তাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে উগ্রবাদে। অনলাইনের ফ্যান্টাসি তাদের টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। সিলেটে সম্প্রতি ৫ নব্য জেএমবি গ্রেফতারের ঘটনা প্রমাণ করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নামে শিক্ষার্থীদের মনে সন্ত্রাসবাদের সর্বনাশা নেশা ঢুকিয়ে দেয়ার পাঠ চলছে। সম্প্রতি পল্টনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সিলেট থেকে গ্রেফতার জেএমবি সদস্য শেখ সুলতান মোহাম্মদ নাইমুজ্জামান দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। গত ২২ জুলাই ঢাকায় নাসিমুল ইশান চৌধুরী ওরফে নাসিম ইশান গ্রেফতার হয়। ২৫ বছর বয়সী এই যুবকের বাড়ি বরিশাল। তিনিও নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট রাজধানী ঢাকার সদরঘাট থেকে দুই সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা বলেছে, আইএসপন্থী জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য তারা। জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, হত্যার জন্য তারা রাজনীতিবিদ ও বিত্তশালীদের বেছে নেয়। তারা অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন ও বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। বিভিন্ন এ্যাপের মাধ্যমে তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, ৭/৮ জনের একটি স্লিপার সেল তারা গঠন করেছে। এটির নাম দেয়া হয়েছে এফজেড ফোর্স। কৈশোর উত্তীর্ণ দুই তরুণ সাফফাত তার এলিফ্যান্ট রোড ও ইয়াসির তার কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে কথিত হিজরত করেন ৪ জুলাই। সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে তারা। গ্রেফতার হওয়া সাফফাত এ বছরই বিসিআইসি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। ইয়াসিরের বাড়ি বরিশাল। সে চাঁদপাশা ইউপি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করে। এরপর আজিমপুর কলেজে ভর্তি হন। দুজনের বিরুদ্ধেই কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে আরও যেসব পলাতক সদস্য রয়েছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলাকারীরদের মতোই তরুণ ও যুবক, শিক্ষিত বিত্তশালীর সন্তানদের টার্গেট করে ভয়ঙঙ্কর স্লিপার সেল এফজেড ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করছে নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠনটি। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী ছিল শহুরে শিক্ষিত পরিবার থেকে আসা আর স্বনামধন্য ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল আর বাংলাদেশের নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়া টগবগে তরুণ। তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সবার অজান্তে জঙ্গী হয়ে ওঠে। জঙ্গী সংগঠনগুলো তাদের সদস্যদের নামকরণের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে থাকে। রিক্রুটমেন্টের পর থেকে নতুন সদস্যের নাম ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। আস্তানা পরিবর্তন, নতুন বাসা ভাড়া, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ ও হস্তান্তর, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনাসহ প্রভৃতি ট্রানজিশনাল সময়ে তাদের নতুন নতুন নাম দিয়ে থাকে ইমিডিয়েট লিডাররা। একজন জঙ্গী সদস্য যতবার এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে ততবার তাকে নতুন নাম দেয়া হয়। এমনও দেখা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় অনেক পুরাতন জঙ্গীকে তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে ১২/১৩টি নাম দিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই গুলশানের সেই রেস্টুরেন্টে উল্লিখিত কোড/অস্থায়ী/ভুয়া নামের কয়েক জঙ্গীর (বিকাশ, আকাশ, ডন, বাধন এবং রিপন) শারীরিক অস্তিত্বের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পায় পুলিশ। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির এফজেড ফোর্সের রয়েছে বিশেষ বাহিনী, গুপ্তচর বাহিনী, গুপ্ত ঘাতক ইউনিট, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ফোর্স এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট। বিশেষ বাহিনীর কাজ হত্যা, গুম ও কমান্ডো হামলা চালানো। তাদের ভাষায় গুপ্তচর ইউনিটের কাজ শত্রুপক্ষের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ এবং স্নাইপার ইউনিটের কাজ নিরাপদ দূরত্বে থেকে ‘শত্রুকে শেষ করে দেয়া মতো প্রযুক্তি ও কৌশল। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ফোর্স ইউনিটের কাজ নিরাপত্তা বাহিনীর সব কৌশল আয়ত্ত করা। আর ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট অস্ত্র বানানোর কৌশল আয়ত্ত করা ও বানানো, সরবরাহ করার দায়িত্বে। নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনটি গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার জন্য যেভাবে জঙ্গী সংগ্রহ, নাম-পরিচয় গোপন, জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেই একই কায়দায় আবারও জঙ্গী সংগঠনটি জেডএফ ফোর্স গঠন করেছে। জঙ্গী সংগঠনটির জেডএফ ফোর্স গ্রুপটি খুবই দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। জঙ্গী সংগঠনটির এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা কত এবং কোথায় তারা তৎপর তাদেরকে শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সিটিটিসি কর্মকর্তার দাবি।
×