ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর - ভালোই তো শান্তিদা। ভালোবাসেন যখন... - কিন্তু অনেক জটিলতা আছে ভাই। - কীরকম জটিলতা? - বিয়ে করলেও আমি সোভিয়েত রাশিয়ায় থাকতে পারবো না। আবার লিলিয়াকে যে বাংলাদেশে নিয়ে যাবো, সেটাও সহজ না। - কেন? আমি অবাক হলাম। - একবার এই দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে ও আর ফিরতে পারবে না। - বলেন কী! - হ্যাঁ, এটাই ওদের আইন। - এ তো বিরাট ক্যাচালের আইন শান্তিদা! শান্তিময় সায় দিয়ে চিন্তিত মুখে মাথা নাড়তে থাকে। আলাউদ্দিনের লন্ডন যাত্রা আলাউদ্দিনের ইচ্ছা ছিল পরীক্ষার পর শীতের ছুটিতে লন্ডন যাবে। পরীক্ষা শেষ হলো, শীতের ছুটিও শুরু হলো, কিন্তু তার লন্ডন যাওয়া হলো না। যথেষ্ট টাকাপয়সা জোগাড় হয়নি। টিকিটের টাকা, থাকা-খাওয়ার টাকা, সব মিলিয়ে অন্তত তিন-চারশ ডলার তো দরকার। এত কৃচ্ছ্বতা আর কারখানায় কাজ-টাজ করে কিছু রুবল সে জমিয়েছে। যা দিয়ে শ’খানেক ডলার কেনা যাবে। এখানে ব্যাংকে ডলার কেনাবেচা হয় না। রাশিয়ান নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি নাই- ডলার বেচাকেনা হবে কেন! কিন্তু আলাউদ্দিনের মতো বিদেশী ছাত্র যাদের সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে, তাদের ডলার দরকার। লন্ডনে তো রুবল চলে না, ডলার চলে। কিন্তু এই ডলার পাওয়া যাবে কোথায়? পাওয়ার উপায় ব্ল্যাকমার্কেট। কালোবাজারিরা ডলার নিয়ে বসে আছে বিক্রির জন্য, চার রুবল দিলে এক ডলার পাওয়া যায়। তবে এই কেনাবেচার কাজটা বেআইনি এবং বিপজ্জনক। ধরা পড়লে জেল হতে পারে, তাই লেনদেন হয় খুব গোপনে। যেখানে ডিমান্ড, সেখানেই সাপ্লাই। সাপ্লাই দেওয়ার লোক আলাউদ্দিন পেয়ে গেল হোস্টেলের ভিতরেই। গতবছর নিয়াজ খান সুইডেন গিয়েছিল সামার জব করতে। সেখানে সামার জবে প্রচুর ক্রোনার রোজগার করা যায়, লন্ডনের চার-পাঁচগুণ। অনেক ক্রোনার রোজগার করে নিয়ে এসেছে নিয়াজ সুইডেন থেকে। তবে প্রথমবার যাওয়ার সময় তাকে ডলার সাপ্লাই দিয়েছিল তাদেরই এক ক্লাসমেট ইয়ান। তবে সে সরাসরি দেয়নি, কালোবাজারিদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল। নিয়াজ খান পোড় খাওয়া মানুষ। সে সারগোদায় পাকিস্তান এয়ার ফোর্স কলেজে লেখাপড়া করেছে। পাইলট হতে তার মাত্র ছয়মাস বাকি ছিল। এমন সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, লেখাপড়া শেষ না করেই তাকে চলে আসতে হয় বাংলাদেশে। পাইলট হতে না পারলেও তার চলায় বলায় একটা পাইলট পাইলট ভাব আছে। নিয়াজ খানের সাহায্যে গোপনে আলাউদ্দিন ঐ চক্রের কাছ থেকে একশো ডলার কিনে নিল। ডলারের পরিমাণটা সামান্য। কিন্তু অপরাধটা সামান্য নয় সোভিয়েত রাষ্ট্রের চোখে। পরে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি হাতেনাতে। তবে সে গল্প অনেক পরের। এখন সবকিছু বেশ চমৎকার চলতে লাগলো। ডলার কেনাবেচার সূত্রে সিনিয়ার ভাই নিয়াজ খানের সঙ্গে জুনিয়ার ছাত্র আলাউদ্দিন খানের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তারা দু’জনেই ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, সেটাও বন্ধুত্বকে মজবুত করলো এবং তাদের বন্ধুত্বকে অন্যরকম একটা ফ্লেভার দিলো, মিলিটারি মিলিটারি ফ্লেভার। দুজনের দেখা হলেই আলাউদ্দিন খান স্যালুট দেয় নিয়াজ খানকে, চিৎকার করে বলে ‘হাইল হিটলার!’ নিয়াজ খানও হিটলারি কায়দায় হাত তুলে জবাব দেয় ‘হাইল হিটলার!’ এটা চলতে থাকে হোস্টেলের করিডোরে, ভার্সিটির সামনে, রাস্তায় সব জায়গায়। সবটাই ঠাট্টা অবশ্য, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর নির্মল মস্করা। তবে নির্মল মস্করার জন্যও অনেক সময় বড় মাসুল দিতে হয়, সেটাও আমরা জেনেছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই। শীতকালের ছুটি কাটাতে সপ্তাহ খানেকের জন্য সব বিদেশি ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হলো লেনিনগ্রাদের কাছেই এক অবসর কেন্দ্রে। এখানে খাওয়া দাওয়া ফ্রি এবং উন্নত মানের। সিনেমা থেকে শুরু করে নানারকম বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। জানতে পারলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের সব শ্রমিক এবং কর্মজীবিরা বছরে একবার দু’তিন সপ্তাহের ছুটি পায়, তাদের জন্যও এরকম বিশ্রাম আর বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, ফ্রি অফ কষ্ট। সোভিয়েত ব্যবস্থায় আরও অনেক কিছুই ফ্রি। চিকিৎসা ফ্রি, শিক্ষা ফ্রি। লেখাপড়ার জন্য আমাদের একটা টাকাও খরচ হয় না। রাশান ছেলেমেয়েরাও বিনা খরচে লেখাপড়া করছে। তারাও আশি রুবল স্টাইপেন্ড পায়, আমরাও তাই। যদি কোনো শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পাঁচে পাঁচ পায়, তাহলে তার স্টাইপেন্ড বেড়ে হয় নব্বই রুবল। তাকে বলা হয় ‘আতলিচনিক’- এক্সিলেন্ট স্টুডেন্ট। তবে সবকিছুই যে একেবারে বেহেশতের মতো নয় এখানে, সেটাও মাঝে মাঝে টের পাই আমরা। অবসর কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে আমি আর আলাউদ্দিন রুমে রান্নাবান্নার কিছু আয়োজন করলাম। হাড়িপাতিল, সসপেন ইত্যাদি কিনে নিয়ে এলাম। ইচ্ছে হলে যাতে মাঝে মাঝে রুমে ভাত আর মাংস খেতে পারি। কাফেটেরিয়ায় খেতে খেতে আমাদের বিরক্তি ধরে গেছে। আমি অবশ্য সর্বভূক মানুষ, কাফেটেরিয়ার খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। লাল বিট দিয়ে বানায় বোর্স নামে একরকম স্যুপ, তাতে ছড়িয়ে দেয় একটুখানি টক দই, সেটা আমার প্রিয় স্যুপ হয়ে গেছে এখন। অন্য দু’একটা আইটেমও ভালো লাগে, কিন্তু তারপরও সবসময় মিস করি মাংসের ঝাল ঝাল ঝোল- মেড ইন বাংলাদেশ স্টাইল! সেটার ব্যবস্থা হলো এখন। আমাদের হোস্টেলটা এতদিন ছিল পুরোনো কালের একটা দালানে। দেখে মনে হতো যেন পাথর দিয়ে তৈরি, বয়স কত দালানটার কে জানে! নিশ্চয়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, লেনিনের বিপ্লবও দেখেছে এই দালান। অনেকদিন ধরে শুনছিলাম নতুন একটা হোস্টেল হচ্ছে সমুদ্রের ধারে। এবার আধুনিক আর্কিটেকচারে তৈরি নতুন হোস্টেলে উঠে এলাম আমরা। এগারো তলায় রুম পেলাম আমি আর আলাউদ্দিন। রুমের একটা ছোট বারান্দাও আছে। সেখান থেকে দেখা যায় দূরে বাল্টিক সাগর। সামনেই একতলা ছোট একটা মার্কেট। সেখানে শব্জি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফলমূল সবই পাওয়া যায়। তবে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লম্বা লাইন দেখি। কখনো মাংসের জন্য, কখনো অন্য কিছুর জন্য। তখন মনে হয় বেহেশতেও কিছু সমস্যা আছে। লাইনে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বেশিরভাগই দাদা-দাদি-নানা-নানি বয়সের মানুষ। ঠান্ডার মধ্যে দীর্ঘ সময় তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মায়া লাগে। আমরা দরিদ্র দেশের সুবিধা পাওয়া ছেলেমেয়ে, রাশিয়ায় পড়তে এসেছি। দেশে আমরা এরকম দৃশ্য দেখি না যে একটা জিনিসের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লম্বা লাইন দিয়েছে লোকে। তার কারণ বোধহয় এই যে আমাদের দেশে খুব অল্প কিছু সৌভাগ্যবান মানুষই ইচ্ছেমতো জিনিস কিনতে পারে। বিশাল একটা অংশের সে ক্ষমতাই নেই, তারা লাইনের ধারে কাছেও যেতে পারে না- যেয়ে কী করবে, কিনবার টাকাই তো নেই তাদের। এরকম মানুষের সংখ্যাই বেশি। এখানে পরিস্থতি ঠিক উল্টো। কিনবার ক্ষমতা আছে অনেকের, প্রায় সবারই। কিন্তু সেই অনুপাতে সাপ্লাই কম। হয় উৎপাদন কম হয়েছে, তাই এই ঘাটতি, অথবা সরবরাহে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। আমার এরকমই মনে হতো। এছাড়া আরেকটা জিনিস দেখে আমি অবাক হতাম- যে কোনো জিনিসের একই দাম সব জায়গায়। বাকুতে যে দামে রুটি, মাংস, দুধ কিনেছি, ভিওস্কি গ্রামের দোকানেও সেই দাম, লেনিনগ্রাদেও একই দাম। আমাদের দেশে একই জিনিসের এই বাজারে যে দাম, অন্য বাজাওে হয়তো তার দেড় গুণ! প্রথমবার বিদেশে এসেছি, যা-ই দেখি তার সঙ্গে দেশের তূলণা করি আর মনটা খারাপ হয়ে যায়। উইক এন্ডে মাংস রান্না করি আমি আর আলাউদ্দিন, কিন্তু মসলা ধার করে আনতে হয়। রাশিয়ায় মসলা পাওয়া যায় না। কখনো থ্রি-কমরেডদের থেকে আনতে হয়, তারা অবশ্য সংখ্যায় কমে এখন টু-কমরেডস হয়েছে। শান্তিদা মাইনাস। সে এখন লিলিয়ার সঙ্গে যুগলবন্দি- ভার্সিটি থেকে রান্নাঘর, সব জায়গায় তারা এখন একসঙ্গে। তবে টু-কমরেডদের না পেলে আমরা হানা দিই আনোয়ার ভাইয়ের রুমে। আনোয়ার ভাই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার কাছে পাওয়া যাবেই। সে নিজেও নিয়মিত রান্না করে। সুইডেন-লন্ডন থেকে এরা সবাই গাদা গাদা হলুদ-মরিচ-জিরা এবং কারি পাউডার নিয়ে এসেছে। আলাউদ্দিন বলে, ‘এবার মসলার যুদ্ধ শুরু করবো। মসলা আনার জন্য হলেও লন্ডন যেতেই হবে।’ কারি পাউডার আর মরিচের গুঁড়া দিয়ে রান্না করা ঝাল মাংসের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেতে খেতে আমার মনে হয় মনের মতো একটা কথা বলেছে আলাউদ্দিন। মসলার যুদ্ধে আমিও আছি। সামার সেমিস্টার শুরু হওয়ার কয়েকটা দিন বাকি। আলাউদ্দিনের প্ল্যান একটু চেঞ্জ হয়েছে। নিয়াজ ভাইয়ের সাথে কয়েকদিন কথা বলার পর ওর মনে হয়েছে- লন্ডনের চেয়ে সুইডেন যাওয়া ভালো হবে। সুইডেনে যেতে ভিসাও লাগে না। পোর্টে হাজির হলেই হলো। আলাউদ্দিন সুইডিশ ভাষা শেখার প্ল্যান করছে ভাষা ইন্সটিটিউটের এক ছেলের কাছে। একা কোনো কাজ করতে কারো ভালো লাগে না, তাই সে আমাকেও টানে। লন্ডন-সুইডেন কোথাও যাওয়ার মতো যথেষ্ট টাকা আমার নাই, ঐসব দেশে যাওয়া হবে কিনা জানি না, তবে ভাষা শিখতে আমার ভালো লাগে- তাই আমিও সুইডিশ শিখতে থাকলাম। কিছুদিন সুইডিশ শেখার পর জানা গেল সুইডেনে ভিসা সিস্টেম শুরু হয়েছে। ভিসা ছাড়া পোর্টে হাজির হলে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। এখন থেকে সুইডেনে যেতে হলে আগে ভিসা জোগাড় করে তারপর যেতে হবে। সেটা অনেক কঠিন কাজ- ভিসা পাওয়া যায় না। আমাদের সুইডিশ শেখায় ভাটা পড়ে গেল। তার জায়গায় জোয়ার এলো ফ্রেঞ্চ শেখার। উদ্দেশ্য ফ্রান্স ভ্রমণ। আলাউদ্দিন এক ফ্রেঞ্চ স্টুডেন্টের সঙ্গে ভাব পাতিয়েছে। আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিল তার সঙ্গে। সে ব্যাটা নিজের নামটা খুব স্টাইল করে উচ্চারণ করলো লৌহঅঁ। আমি তাকে বললাম তোমাদের এক লেখকের লেখা নাটক আমার ভালো লাগে। - কোন্ লেখক? নাটকের নাম কী? - নাটকের নাম ‘মেন উইদাউট শ্যাডোস’, আরেকটা আছে ‘নো এক্সিট’।। লেখকের নাম জাাঁ পল সার্ত্র। ব্যাটা এমন ভাব করতে লাগলো আমার ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ ভুল হচ্ছে, তাই সে লেখকের নামটা চিনতে পারছে না। আমি নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। একসময় টের পেলাম ব্যাটা বুঝেও ভাব নিচ্ছে। মনে মনে একটা গালি দিলাম তাকে- শালা! আমি তোমার দেশের লেখকের লেখা তবু পড়েছি, আর তুমি ভাব নিচ্ছো? দেখি, আমার দেশের একজন লেখকের নাম করো তো? আমি জানতে চাইলাম, বাঙালি কোনো লেখকের লেখা পড়েছ তুমি? - হ্যাঁ পড়েছি। - কার লেখা পড়েছো? - টেগোর। - ‘তাঁর নাম টেগোর না, ঠাকুর। পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ মনে মনে বললাম, ‘দেখি এইবার উচ্চারণ র্ক ব্যাটা!’ লৌহঅঁ চুপ মেরে গেল। আমিও ফ্রেঞ্চ শেখায় ইতি দিলাম। এদিকে সামার সেমিস্টার শুরু হয়ে গেছে। লেখাপড়ার চাপও বেড়ে গেছে। এইসব উল্টাপাল্টা কাজ বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দিলাম। আলাউদ্দিন টাকা রোজগারে নেমে পড়লো জোরেশোরে। সেমিস্টার শেষে ইংল্যান্ডের ভিসা জোগাড় করে আমরা লন্ডনের দিকে রওনা দিলাম। বিদেশে যেতে হলে ডিন অফিসের অনুমতি লাগে। দু’জন রাশান মেয়ে কাজ করে ডিন অফিসে। একজন ভেরা, অন্যজন তামারা। তামারা একটু বেশি বয়সি, ভেরা অল্পবয়সি এবং সুন্দরী। ভেরার সঙ্গেও আলাউদ্দিনের বেশ ভাব। মানুষের সঙ্গে দ্রুত ভাব করতে আলাউদ্দিনের জুড়ি নাই। ভেরার সহযোগিতায় আমরা ডিন অফিসের অনুমতি পেয়ে গেলাম সহজেই। টেমস নদীর ধারে লেনিনগ্রাদ থেকে লন্ডন লম্বা জার্নি। প্লেনের টিকিট কাটবো অত টাকা নাই, ট্রেনই ভরসা। ট্রেনে রওনা দিলাম আমরা, লম্বা জার্নি আরও লম্বা হয়ে গেল- কারণ বড় শহরগুলোতে নেমে পড়তে লাগলাম আমরা ট্রেন থেকে। এতে দেশ দেখার মজা শুরু হলো আর ভ্রমণের মজাও বেড়ে গেল অনেক। প্রথমেই পড়লো পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। তার আগে রাশিয়া আর পোল্যান্ডের বর্ডারে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস এসবও চেক হলো। সবই হলো ট্রেনের ভিতরে, নামতে হলো না। এমনকি ট্রেনের চাকাও এখানে বদল হলো। ওপাশের চাকা এপাশে চলবে না। কারণ দুপাশের ট্রেনলাইন দুই রকম। চাকা বদলও আমরা তেমন টের পেলাম না, শুধু বগিটা একটু উঁচু হয়ে গেল আর মাঝে মাঝে দু’একবার ঘটাং-ঘটাং শব্দ হলো। ওয়ারশতে নেমে শুরু হলো এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি। ট্যুরিস্টরা একটা শহরের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে, আমরা তো ট্যুরিস্ট না, গরীব ছাত্র। একশো-দু’শো ডলার জোগাড় করতেই আমাদের কষ্ট হয়। আমরা শহর দেখি ঘুরে ঘুরে, মানুষ দেখি আর শস্তার খাবার কোথায় আছে খুঁজে বেড়াই। সন্ধ্যা হলে আবার ট্রেনে চড়ে বসি, যাতে রাতের বেলা হোটেলে থাকতে না হয়। এভাবে আসে পূর্ব জার্মানি আর দেয়াল দিয়ে ঘেরা বার্লিন শহর। পশ্চিম বার্লিন শহরটাকে ওয়ারশ, লেনিনগ্রাদ এমনকি মস্কোর চেয়েও উজ্জ্বল আর চকচকে মনে হয় আমার। কারণটা ঠিক ধরতে পারি না। হয়তো এজন্য যে এখানে মানুষের পোশাক-আশাক রঙিন আর বিল্ডিংগুলোর বৈচিত্র বেশি- সবটাই ধূসর আর একরঙা নয়। এছাড়া বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডগুলোও চোখ টানে, সেগুলোও রঙিন আর আকর্ষণীয়। আলাউদ্দিন উচ্ছ্বসিত। বলে, ‘এই হচ্ছে আসল ইউরোপ। দি ওয়েস্ট! ঝকঝকে, চকচকে!’ আমি হাসতে হাসতে বলি ‘চকচক করিলেই সোনা হয় না।’ আলাউদ্দিন বলে ‘তুমি হচ্ছো সিনিক! ভালোকে ভালো বলতে চাও না।’ বার্লিন রেলস্টেশন থেকে বেরোতেই দেখি একটা লোক সসেজ বিক্রি করছে, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে। ফুটন্ত তেলে ভাজা হচ্ছে লম্বা করে কাটা আলু। দেখেই খিদে লেগে গেল। প্রচুর কেচাপ দিয়ে দু’জনে দু’প্লেট খেলাম। মনে হলো খিদে গেল না, আরও এক প্লেট করে খেলাম আমরা। সসেজ বিক্রেতার চালাকিও বোঝা গেল- খাবারের পরিমাণ এমন রেখেছে যে এক প্লেটে হয় না, দ্বিতীয়বার নিতে হয়। তবে খাবারটা সত্যি দারুণ। এবার ঘুরতে শুরু করলাম আমরা। ডানদিক দিয়ে কিছুটা এগোতেই সার সার দোকানপাট। তার মধ্যে একটা দোকানের দরজায় কালো কাপড় টাঙানো। উপরে অ্যাড দেখে বোঝা গেল এখানে পর্নো শো চলছে। লোকে যাচ্ছে আসছে, কারো কোনো বিকার নাই, কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আলাউদ্দিন বললো- ‘এই হচ্ছে পাশ্চাত্যে ব্যক্তির স্বাধীনতা। যা খুশি করো, কারো কিছু বলার নাই।’ আমাকে মানতেই হলো, এই জিনিস এই স্বাধীনতা বাকু, লেনিনগ্রাদ, মস্কো- সোভিয়েত রাশিয়ার কোনো শহরেই আমরা দেখিনি। হুক-ভ্যান-হল্যান্ড শহরে পৌঁছে গেল ট্রেন। নামেই মনে হয় হল্যান্ডের একদম শেষ প্রান্তে এই শহর। আসলেও তাই, ইংলিশ চ্যানেলের ধারে হল্যান্ডের শেষ প্রান্তে এই ছোট্ট বন্দর। এই পর্যন্তই যাবে ট্রেন। এবার ইংলিশ চ্যানেল পার হলেই আলাউদ্দিনের স্বপ্নের লন্ডন। ফেরি ছাড়তে কিছুটা সময় বাকি আছে। আমরা পর্যটনে বের হলাম। বেশিদূর যাওয়া যাবে না, তাই আশেপাশেই ঘোরাঘুরি। কাছেই টিউলিপের একটা বাগান চোখে পড়লো। সবুজ ডাঁটার ডগায় লাল লাল টিউলিপ। দেখেই চোখ জুড়ায়। এপাশে ঘাসের উপরে বসলাম আমরা। মাঝখানে নির্জন সরু রাস্তা। ওপাশে টিউলিপ বাগানের সামনে বেঞ্চে বসে বই পড়ছেন একজন বয়স্ক মহিলা। তার পরনে নীল পোশাক। নীল, সবুজ আর লাল মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য রচিত হয়েছে। শিল্পীর আঁকা ছবির মতো। এই মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে ফেরি এসে গেল। ফেরি এখানে হোভারক্র্যাফট। এর নামও শুনিনি আগে। জাহাজে যা যা থাকে, এতেও তাই আছে, তবে বর্ণনা শুনে মনে হলো এটা অতিকায় টিউবের উপরে বসানো ছোটখাটো একটা জাহাজ। ডেইলি প্যাসেঞ্জার এক ডাচ লোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তিনি বললেন দুলুনি একটু বেশি, কিন্তু হোভারক্র্যাফট কখনো ডুববে না। ঝড়ে কাত হয়ে যাবে, পেন্ডুলামের মতো দুলবে, আবার সোজা হয়ে যাবে- এটা এভাবেই তৈরি। হোভারক্র্যাফটের রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখলাম খাবারের দাম খুব বেশি। আমাদের ব্যাকপ্যাকে ইমার্জেন্সি সাপ্লাই আছে। সেটা বের করা হলো। কিন্তু খাবো কোথায় বসে? সব জায়গায়ই তো গিজগিজ করছে প্যাসেঞ্জার। একটা ব্রেড কিনে নিয়ে হোভারক্র্যাফটের ছাদে চলে গেলাম দুই গরীব বাঙালি। জায়গাটা নিরিবিলি। তার উপর টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এদিকে কারো আসবার সম্ভাবনা এখন কম। সার্র্ডিন মাছের কয়েকটা টিন কিনেছিলাম আমরা লেনিনগ্রাদে। তার থেকে দু’টো কাটা হলো কাটার দিয়ে, চমৎকার ডিনার হয়ে গেলো। ওপারে হারউইচ বন্দর। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে যখন পৌঁছলাম আমরা, তখন টেমস নদীর পাড়ে নতুন এক সকালের শুরু হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া থেকে দুজন দু’দিকে চলে গেলাম। আলাউদ্দিন গেল ওর পথে, আমি গেলাম আমার পথে। ঠিক হলো সাতদিন পরে ঠিক এই সময়ে এখানে আসবো আমরা। তখন দেখা হবে। এর মধ্যে চলবে আমাদের সামার-জব অনুসন্ধান কার্যক্রম। সাতদিন পরে হবে এর সফলতা-বিফলতার হিসাব-নিকাশ। লন্ডনে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। বড় বোনের বান্ধবী বাচ্চু আপা আছে, তার ওখানেই আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চু আপা আদর-যতœ করেই রাখলেন আমাকে। বাচ্চু আপার গেস্টরুমে থাকি, আর সারাদিন জব খুঁজে বেড়াই। তিনদিনের মাথায় একটা টার্কিশ রেস্টুরেন্টে অস্থায়ী ওয়েটারের কাজ পেলাম। এক সপ্তাহ পরে তাদের নিজস্ব লোক এসে গেল। তখন আবার কাজ খুঁজতে থাকলাম। বাচ্চু আপার বর শফিক ভাই খুব অমায়িক লোক। তিনি বললেন শোনো অপু, আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন অড-জব করেছি। সবচেয়ে ভালো হবে যদি তুমি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ খোঁজো। এখানে যেগুলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলে পরিচিত, তা প্রায় সবই আসলে সিলেটিদের রেস্টুরেন্ট। এগুলোতে খোঁজো, পেয়ে যাবে। সত্যি তাই, দুদিন পরেই এজওয়ার রোডে তাজমহল নামে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ পেয়ে গেলাম। তবে ওয়েটারি না, ডিশ ওয়াশিং। কিচেনে ডিশ ওয়াশ করতে হবে, তাইই সই- আমার কাছে সবই সমান। মালিকের নাম সুন্দর মিয়া। দেখতেও তিনি বেশ সুন্দর, লম্বা-চওড়া হ্যান্ডসাম। নিয়ম-কানুন সব বুঝিয়ে দিলেন সুন্দর ভাই। সকাল দশটা থেকে কাজ, তিনটা পর্যন্ত। তিনটা থেকে ছয়টা ছুটি। সপ্তাহে একদিন সাপ্তাহিক ছুটি। রেস্টুরেন্টের উপরেই স্টাফদের থাকবার জায়গা। বেতন সপ্তাহে চল্লিশ পাউন্ড। আমার জন্য অঢেল টাকা। এই টাকা দিয়ে আগামি বছর আবার লন্ডন আসতে পারবো, অথবা অন্য কোনো দেশ ঘুরতে পারবো। এর মধ্যে আলাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলো। ও আইরিশ একটা রেস্টুরেন্টে কাজ পেয়েছে। বেতন আমার ডবলেরও বেশি। দুজন কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, দুপুরে ফিস এন্ড চিপস খেয়ে আবার ঘোরাঘুরি। এবার আলাউদ্দিন বেছে বেছে জিনসের প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট কিনতে লাগলো। মেয়েদের নতুন ফ্যাশানের ফারের ওভারকোটও কিনলো। মনে হলো পুরো মার্কেটই কিনে ফেলবে ও। আমি বললাম এত কিছু নিয়ে যাবে কীভাবে? বর্ডারে দু’তিনটার বেশি তো নিতে দেবে না। আলাউদ্দিন কোনো জবাব দিলো না, মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো। আরও একগাদা জিনিস কিনলো ও, তারপর আমরা চললাম পোস্ট অফিসের দিকে। আলাউদ্দিনের বুদ্ধির শেষ নাই। তার হাতে বিরাট এক লিস্ট। তাতে চেনা-অচেনা অনেক বিদেশী ছাত্রের নাম। তার মধ্যে আফ্রিকা, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান থেকে শুরু করে সব দেশের ছাত্ররাই আছে। দু’একজন আমাদের বন্ধু অথবা ক্লাসমেট, বাকিরা আমার অচেনা। আলাউদ্দিন ওদের নাম, রুম নাম্বার, ডিপার্টমেন্ট লিখে নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের নামে একটা করে পার্সেল পাঠাতে লাগলো ও। পার্সেলের মধ্যে জিনসের প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, সানগ্লাস থেকে শুরু করে আরও বহু আইটেম, যেগুলো রাশিয়ায় চড়া দামে বিক্রি হয়। এরকম প্রায় গোটা বিশেক পার্সেল পাঠালো আলাউদ্দিন। (চলবে)
×