ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বদরুল হায়দার

পাঠকের কবি দিলওয়ার

প্রকাশিত: ২১:৩১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

পাঠকের কবি দিলওয়ার

‘পৃথিবী স্বদেশ আর আমি তার সঙ্গী চিরদিন, কবি দিলওয়ার হচ্ছেন- ৫০ দশকের একজন নিভৃতচারী মগ্নচৈতন্যের চিরায়ত কবিসত্তা। জন্মগতভাবে স্বভাবজাত কবি প্রতিভার অধিকারী মানসপুত্র। যিনি আমৃত্যু আপসহীন অসাম্প্রদায়িক, কুসংস্কারমুক্ত মানুষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ছিল তার কাছে সমান। সাম্য ও স্বাধীনতার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস মাটি মানুষের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করে তিনি হয়েছেন গণমানুষের কবি। স্বদেশ স্বজাতির বাইরে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ছিল তার প্রেম ও মানবতার আজীবন আত্মবিশ্বাসী। এ কবি মনে করতেন- নিজের বিশ্বাস যে হারায় সে কবি নয়। কবিতাকে জীবনের সঙ্গী করেছেন অবলীলায়। ৫০-এর দশকের স্বতন্ত্র কবিসত্তার কবি দিলওয়ার সমকালীনদের মধ্যে ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। লেখালেখির শুরু থেকে গণমানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, জয় পরাজয়ের প্রকৃত স্বরূপসন্ধানী হয়েছেন। সাম্য ও প্রেমের প্রতি আত্মবিশ্বাস তাকে দিয়েছে অকুতোভয় জীবনসত্তা। কবি দিলওয়ার মনে করতেন- ‘কবিতার অন্য নাম রক্ত-মাংসের গঠিত মানুষ,। মানুষই ছিল তার কবিতার আরাধ্য বিষয়। মানুষের প্রতি প্রেম, মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা, সাম্য ও সম্প্রীতির প্রতি তার ভাবাবেগ তাকে করেছে মানুষের কবি। বস্তু ও ভাবের মিলন ঘটাতে গিয়ে তিনি সত্য ও মহাপ্রকৃতির কাছে নিজেকে নিয়ে গেছেন। মানুষের বিবেক, আবেগ ও মূল্যবোধের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। যুক্তি ও উক্তির মধ্যে তিনি তার চেতনাকে প্রকাশ করতে গিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যেখানে মানুষের সত্যকার সংজ্ঞা পাওয়া যায়। নির্দ্বিধায় তিনি সত্য, সুন্দর, সাম্য, ন্যায়ের কথা বলতে চেয়েছেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে। সর্বক্ষণিক কবি ও কবিতার সঙ্গে থেকেছেন সারা জীবনই। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৭ সালের বইমেলায়। আমরা তখন তরুণ কবি। ছোট কাগজের স্টল নিয়েছি মেলায়। তার পুত্র কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার আমাদের সমসাময়িক কবিবন্ধু। তার সুবাদে বাংলা একাডেমি বইমেলায় ছোট কাগজ চর্যাপদ স্টলে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। দেখেই মনে হয়েছে তিনি কবি। স্নেহসুলভ আদর দিয়ে আমাদের গ্রহণ করে নিলেন নিমিষে। চর্যাপদ সম্পাদক আযাদ নোমান, কবিবন্ধু বাহার রহমান, আসাদুল্লাহ শেখর শোয়েব শাদাব, সাজ্জাদ শরিফ, সৈয়দ তারিক, শান্তনু চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে কবি ও কবিতা বিষয়ে কথা হয়। আমি তো হতবাক। সেই স্কুল জীবনের শুরু থেকে কবিতার প্রতি আগ্রহের কারণে দিলওয়ারের কবিতা পড়ার সুযোগ ঘটে। হঠাৎ সামনে পেয়ে তাকে বরণ করে নিলাম। তারুণ্যের আবেগে ছোটকাগজ চর্যাপদ তার হাতে তুলে দিই। স্বল্প সময়ে তিনি আমাদের প্রকাশিত কবিতাগুলো চোখ বুলিয়ে নিলেন। যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, বহুকাল পর কিছু কবিতা পড়েছি। আজকাল তো কবিতার করুণ দশা। প্রচলিত ধারার পুনরাবৃত্তি ছাড়া অন্য কিছু হচ্ছে না। তিনি আমাদের সিলেটে যাওয়ার আমন্ত্রণ করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে তার কবি মানসসত্তা আমাদের অনুপ্রাণিত করল। মনে হলো একজন প্রকৃত কবির স্নেহসান্নিধ্যে প্রীত হলাম। কবি দিলওয়ার ছিলেন বহুমুখী কবি প্রতিভা। কবিতার বাইরে তিনি ছড়ায় বরাবরই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পেশায় সাংবাদিক হলেও আজীবনই তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক চিন্তাশীল সক্রিয় মানুষ। যখনই মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হয়েছে তখনই তিনি জ্বলে উঠেছেন মানুষের পক্ষে। বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের দুঃখে দুঃখী ও দুঃখে সুখী হয়েছেন প্রকৃতির ভালবাসায়। খ্যাতি বা সুখ্যাতি তিনি চিরকালই উদাসীন ছিলেন। জীবনের অধিক সময় তিনি ঢাকার কাব্যজগতে ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জানজটমুক্ত কোলাহল থেকে প্রকৃতির কাছে ফিরে এসেছেন নিজ বাসভূমে। হজরত শাহজালাল ও ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেটের সুরমা পাড়ে ভার্থ খোলার খান মঞ্জিলে আমৃত্যু কাটিয়েছেন কবিতার বাইরে তিনি ছিলেন মুক্তগদ্য লেখক। তার চেতনার ভূগোল ছিল বিশ্বব্যাপী উদার মানবিক। তার আধুনিকতা ছিল সময় বিশ্লেষকের সচেতনতায়। তিনি সারা জীবনই আত্মকেন্দ্রিকতা, বিচ্ছিন্নতা ও বানানো সঙ্কটের বিপক্ষে ছিলেন অনড়, সাহসী। তার কবিতায় নাগরিক জীবনের গ্লানি ও পরনির্ভরতার বিপক্ষে ঐক্যের সপক্ষে কলম জাগ্রত রেখেছেন। বিভেদ, বৈষম্য, নকল, মিথ্যার বিরুদ্ধে বিপ্লবী হয়েছেন মানুষের হয়ে। মানুষ ও প্রকৃতির বিপর্যয়ে তিনি দুঃখ অনুভব করেছেন তেমনি কবিতায় তিনি আবেগ রোপণ করেন মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায়। তার লেখা কবিতা ও মৌলিক গদ্যগুলোয় কখনো মানুষের বিচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হয়নি। মানুষ নিয়েই তার মৌলিক বিষয়াশয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে নদীর আত্মীয়তাকে সফলভাবে তুলে এনেছেন। বিচিত্র সব দুঃখ, শোক, সমস্যা ও সংগ্রামের মধ্যে কবি জীবনের কখনো অন্তরায় হয়নি। সর্বক্ষণই তিনি কবি। দেশে-বিদেশে তিনি সমানভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সর্বস্তরের মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুখ-দুঃখের বৈপরীত্য ও মানুষের সাম্য, স্বাধীনতাকে কবিতায় জীবন্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। বিপদসঙ্কুল অবহেলিত অনগ্রসরমান জাতির এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন কবিতায়। মুক্তি যদি কাম্য হয় কাম্য যদি সাম্য হয় ভুবন যদি গ্রাম্য হয় সাম্যের স্বরূপ যদি হয় অকুতোভয় তবে নৃ-তত্ত্বের মিত্র হতে হবে ডিনএনএকে কে মান দিতে হবে নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে, Victory shofts from Hand to hand ধ্বনি ভাসে হোমারিক আকাশে আকাশে কবির মনোজগৎ একটুকরো আলোময় বিশ্বপরিম-ল। আর মানুষের চৈতন্যজগত কবি ও কবিতার আদি প্রতিষ্ঠান। দিলওয়ারের কবিতায় আন্তরিক ভাবাবেগের সঙ্গে প্রজ্ঞা ও আত্মোপলব্ধি যোগ হয়েছে সংজ্ঞায়। কবি দিলওয়ার বরাবরই ছিলেন প্রকৃত কাব্যপ্রেমিক ও পাঠক। তেমন তার কবিতারও রয়েছে অসংখ্য পাঠক। যারা তাকে প্রিয় কবি হিসেবে মান্য করে। লোককবির পাশাপাশি সমকালীন আধুনিক কবিদের খোঁজ খবর তাদের কাব্যভাবনা, আদর্শ সম্পর্কে জানার কৌতূহল ছিল তার মধ্যে প্রবল। ফলে সবসময়ই এক-দুজন কবি তার ঘরে কাব্য অতিথি দেখা যেত। কবি নাম শুনলেই তিনি গুণী মানুষের মতো তাকে বরণ করে নিতেন আনন্দে। কবি দিলওয়ার জীবিতকালে ও মৃত্যুর পরও আলোচিত কবি। রাজধানী থেকে স্বেচ্ছায় জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার পরেও কখনও মনে হয়নি তিনি সিলেটে আছেন। মনে হয়েছে তিনি লন্ডনে না হয় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সংবর্ধিত হচ্ছেন। মানবদরদি, প্রেমিক কবি হিসেবে দিলওয়ার সহজে সবাইকে আপন করে নিতেন। কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে ৭৬ বছরের জীবনের পরিভ্রমণ সত্যিই সময়, সমাজ, স্বদেশ এর জন্য আশাবাদী সংবাদ। তার মানবিক গুণাবলি প্রকৃত মৌলিক কবিতার ধারাবাহিক চিন্তনে ফুটে ওঠে। কবিতাসমগ্র বের হওয়ার পর ‘পৃথিবী রইলো সজীব’ আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ঢাকায় উৎস প্রকাশন থেকে। কবি দিলওয়ারের কাব্যে মিথ্যার নানামুখী ব্যবহার রয়েছে। সচেতনভাবে তিনি ঐতিহ্য, ইতিহাস, পুরাণ ও মিথ্যকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। নগরজীবনে ক্লেদ-গ্লানির প্রতি তার অনুযোগ রয়েছে প্রেমের প্রত্যাশায়। বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক সনেট রচনা করে দিলওয়ার স্বকীয় মহীয়ানতাকে প্রাণবন্ত করেছেন। তার সনেটে দেশ-কাল, সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সচেতনতা লক্ষণীয়ভাবে দেখা যায়। সামাজিক দৈন্যতা ও অক্ষমতার ইঙ্গিত করতে গিয়ে কবি বিশ্বমানবতার প্রতি অগাধ বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। লিখেছেন নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সংবাদপত্রের কলাম। ছোটগল্পও মাঝেমধ্যে লিখতেন। সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে দেখেছেন প্রেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। প্রেম ও পূর্ণতাকে একাকার করেছেন সমান্তরালভাবে আনন্দ ও দুঃখে। গণমানুষের কবিকণ্ঠ হিসেবে রাষ্ট্র ও জনগণ তাকে দিয়েছে বিরল সম্মান। কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, ভারত ও বাংলাদেশে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। ৫০-এর দশকের নাগরিক কবিতা ও লোকঐতিহ্যের কবিতার মধ্যে কবি দিলওয়ারের কবিতাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। স্বদেশে স্বজাতির মুক্তির সপক্ষে ক্ষোভ ও মানবতা দিয়ে আলাদা কবিতা ভাষার সৃষ্টি করতে প্রয়াসী ছিলেন তিনি। প্রেম প্রকৃতির মতো মানবিক বিপর্যয়ে মুক্তির কবিতা লিখে মানুষকে প্রগতির পথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সত্য, সুন্দর ও পরম সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে আত্মবিশ্বাসগুলো তুলে আনেন পৃথিবীতে। আন্তর্জাতিকতা রয়েছে আবেগের পঙ্ক্তিমালায়। সদা-জাগ্রত মনে অবলোকন করেছেন সময়ের অন্তর্দৃষ্টিকে। আত্ম-বিশ্লেষণ নিষ্ঠা ও মনবতাকে দিয়েছে অসীমতা।গৌরবময় ৭৬ বছর সোনালি অতীত মাড়িয়ে কবি রেখে গেছেন মানুষের জন্য কবিতা। তার কবিতা গবেষণাধর্মী চিন্তাশীল রচনা, প্রগতিরপক্ষে অনড় অবস্থান সাম্য, মুক্তি, স্বাধীনতার নিঃস্বার্থ স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা। কাব্য পরিম-লে তিনি প্রতিদিনই নতুনভাবে পাঠক, লেখক, সমালোচকের কাছে আবিষ্কৃত হবেন। তার রচনাবলি প্রকাশ করতে দ্রুত উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলে অবশ্য বাংলা কবিতা সম্ভারে তিনি বহুকাল পাঠকের কাছে বেঁচে থাকবেন।
×