ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রণব মুখার্জী ॥ বাংলাদেশের সুহৃদ

প্রকাশিত: ২১:০২, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

প্রণব মুখার্জী ॥ বাংলাদেশের সুহৃদ

প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। ছিল না পরিচয় থাকার কোন কারণও। তার যে বিশালতা আর ব্যাপ্তি, আমার সঙ্গে সেটার তুলনা চলে না। অতএব সঙ্গত কারণেই জীবদ্দশায় তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু তার ব্যাপ্তিটা এতই বিস্তৃত যে তার মৃত্যুতে একাধিক ভার্চুয়াল আলোচনায় তাকে নিয়ে কথা বলার সম্মান আমার কপালেও জুটেছে। এসব আলোচনায় প্রণব বাবুকে নিয়ে নানামুখী যে আলোচনা এবং তা থেকে বহুমাত্রিক প্রণব বাবুর সঙ্গে আমার যে পরিচয়, তার সারমর্ম এই যে তাকে ভাবসম্প্রসারণ থেকে সারমর্মে নামিয়ে আনাটা যে কতটা দুরূহ তার মর্মটা আমি মর্মে মর্মে টের পেয়েছি। বাংলাদেশের এমন অকৃত্রিম সুহৃদ আর দ্বিতীয়জন নেই এমনটি বলব না। নিশ্চয়ই ছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আলোচনায় আসতেই পারে নরেন্দ্র মোদির নামও। তবে প্রণব বাবুর নাম বাংলাদেশের সুহৃদদের তালিকাটিতে একেবারে উপরের দিকে জ্বলজ্বল করবে। একাত্তরের জুনে ভারতের রাজ্যসভার বাজেট অধিবেশনে দাঁড়িয়ে তিনি ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। পাশাপাশি বলিষ্ঠ কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন বাঙালীর রক্তে লাল যাদের হাত সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার। প্রণব বাবু কিন্তু তখনও শ্রীমতী গান্ধীর ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন না। ভারতীয় কংগ্রেস তার যোগদান আরও পরে ১৯৭৩-এ। পঁচাত্তরে বিপর্যয়ে যখন বাংলাদেশ, পিতা হারিয়ে দিশেহারা যখন বাঙালী জাতি আর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আমাদের পরম প্রিয় দুই আপা, তখন তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন এই প্রণব বাবুই। কঠিন সে সময়টায় আপাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে এসেছিলেন শ্রীমতী গান্ধী। তিনি প্রণব বাবুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দেখভাল করার। আর আপাদের ‘মিস্টার ও মিসেস এবং মিস তালুকদারের’ সেই জীবনে তাদের পিতার শূন্যস্থান পূরণের কঠিন দায়িত্বটি পালন করার চেষ্টা করেছিলেন এই প্রণব বাবুই। শুধু তাই-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর যে সশস্ত্র প্রতিরোধ, সেসব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বটিও পালন করতেন তিনি। বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন প্রণব বাবু এর পরও নানা সময়। বিএনপির রাহুমুক্ত বাংলাদেশ যখন আবারও মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের করাল গ্রাসে, মাইনাস টুর নামে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে রাজনীতি থেকে মাইনাসের ‘অনলি ওয়ান ফর্মুলা’ বাস্তবায়নে যখন তাদের শত উদ্যোগ, সেসব উদ্যোগও থামিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী এই প্রণব বাবুই। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাত ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে আজ আমাদের যে দুর্বার যাত্রা, তার অন্যতম অনুঘটক প্রণব মুখার্জী। প্রণব বাবুর মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দিনগুলোতে তিনি প্রণব বাবুর উপদেশ এবং পরামর্শে সমৃদ্ধ হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদিকে প্রণব বাবু যে উপদেশগুলো দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম সম্ভবত ছিল বাংলাদেশকে ভালভাবে বোঝার আর বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর। বাংলাদেশ-ভারতের যে সম্পর্ক আজ সম্পর্কের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজমান আর সহযোগিতার বহুমাত্রিকতায় যা সদা বিকাশমান তার পেছনে প্রণব বাবুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজ আমাদের চারপাশে মাঝেমাঝেই যে হালুয়া রুটির উৎসব, আর আমাদের কেউ কেউ সেই উৎসবে মেতে যখন নিজ শেকড় বিস্মৃতপ্রায়, তখন ঠিক সেই সময়ে প্রণব বাবুর মৃত্যুতে ভারতের পাশাপাশি অর্ধনমিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাও। কেন যেন মনে হয়, মৃত্যুও প্রণব বাবুকে তার দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অনন্ত যাত্রায় প্রণব বাবু আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন, কত গভীরে প্রথিত বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের শেকড়টা। লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×