ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সেলিম

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ২১:০১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুদক্ষ চিন্তাভাবনা ও দেশপ্রেমের মহান চেতনা ও আদর্শের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ রেখেছেন বাংলাদেশের পানি সম্পদকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে বাংলাদেশ ও তার জনগণকে রক্ষাকল্পে ‘ডেল্টা প্রকল্প-২১০০’-এর পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই ডেল্টা প্রকল্পের ন্যায় বাংলাদেশকে আগামীর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনের লক্ষণ হিসেবে বিশ্বব্যাপী চলছে প্রচণ্ড গরম, খরা এবং হঠাৎ ঠাণ্ডা ও মাত্রাতিরিক্ত ঝড়-বৃষ্টি, বন্যার অদম্য এক প্রতিকূল লীলাখেলা। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ অতিরিক্ত গরম, ঠাণ্ডার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, প্রাণী প্রাকৃতিক দাবানল অথবা ঠাণ্ডায় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়ে রোগ-ব্যাধিতে ভোগান্তি শেষে অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। অতিবৃষ্টি অথবা অনাবৃষ্টির ফলে বিভিন্ন মহাদেশে, বিশেষ করে আফ্রিকার অনেক দেশেই চলে চরম খাদ্যাভাব ও মহামারী। অতিবৃষ্টিতে ডুবে যায় শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম, লোকালয়। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ভবিষ্যতে তলিয়ে যাবে সাগরতীরের ঘরবাড়ী, শহর, নগর, জনবসতি। ইতোমধ্যেই সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে তার ভয়াবহ আগ্রাসী ধ্বংসলীলার আগাম শিকার হয়ে বিলীন হওয়া শুরু করেছে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর বিশাল লোকালয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ। ভবিষ্যতের এবং চলমান বিশ্ব আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় এখনই ‘ডেল্টা প্রকল্প ২১০০’-এর ন্যায় বাস্তবসম্মত প্রকল্প বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিদ্যুত, গ্যাস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ও কৃষি ও পশুপালন খাদ্য মন্ত্রণালয়, রিলিফ ও ত্রাণ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সামরিক-বেসামরিকসহ বিভিন্ন গ্রাম, উপজেলা পর্যায়ের সামাজিক সংস্থার সমন্বিত অংশগ্রহণ ও তাদের কর্মপরিধির ওপর ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিশ্লেষণ করে সকল বিভাগ ও সংস্থাকে স্ব স্ব জনবল, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, তথ্য এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে দুর্যোগ মোকাবেলার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ এখনই শুরু করা উচিত। কারণ মাঝে-মধ্যে আচমকা সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনই আগাম বার্তা দিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের ভয়াবহতার। ভবিষ্যতে হয়তোবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অংশ হিসেবে খরা, অতি বা অনাবৃষ্টিতে যেমনি অধিক হারে প্রাণ ঘটাতে পারে, তেমনি প্রাণ ও সম্পদের উভয়ের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ঘটাতে পারে। অতএব, বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে দেশের গ্রাম পর্যায়ের জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, সমাজসেবক, মহিলা সংস্থা, সরকারী-বেসরকারী সকল সংস্থা, দফতর ও প্রতিষ্ঠানকে উপর্যুক্তভাবে সুসজ্জিত করে, প্রশিক্ষিত ও তথ্য-উপাত্তের দ্বারা অবহিত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ওচঈঈ বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত জাতিসংঘের ওহঃবৎ বহারৎড়হসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব সংস্থাটি প্রকাশিত রিপোর্টে বলে যে, ২০৩০ সালে আমাদের এই গ্রহের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি হলে তার কবল থেকে রেহাই পাওয়া খুবই দুষ্কর ও বেদনাদায়ক হবে। তাই কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ ক্ষমতা বা শক্তিকে ২০৩০ সলের মধ্যে অর্ধেক পর্যায়ে আনয়নের ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে রিপোর্টে। জবহবধিনষব ঊহবৎমু ব্যবস্থার মাধ্যমে ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ বিশ্বের বিদ্যুত চাহিদার বৃদ্ধিকরণের প্রয়োজন হবে জরুরী ভিত্তিতে ২০৫০ সালের মধ্যে। উক্ত রিপোর্টে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ যতদূর সম্ভব জরুরী ভিত্তিতে হ্রাসকরণের ওপর বিশেষভাবে বিশ্বব্যাপী প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদ প্রদান করে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন বা এষড়নধষ ডধৎসরহম হ্রাসকরণ সংক্রান্ত ২০১৫ প্যারিস চুক্তির ধারাসমূহ যদি কোন কোন ধনী শিল্পোন্নত দেশ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করে থাকে, তার পরও বর্তমান শতাব্দীর শেষের দিকে গ্রহের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে গোটা বিশ্বকে শুধু উষ্ণ থেকে উষ্ণতর করে তুলবে। ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার ফলে বিশ্বব্যাপী ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে, পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে, নদনদী সমুদ্রের ওপরের স্তরের পানির চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। মৎস্য, তরিতরকারি, ফল-ফলাদির ফলন কমে গিয়ে চাল, গম, ভুট্টাসহ প্রধান অর্থকরী ফসল ফলন কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হবে বিশ্বব্যাপী। সম্ভাব্য মাত্রাতিরিক্ত বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বিশ্ব জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে বাধ্য করবে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানচ্যুতিতে। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচীর আঘাতকে জলপ্রপাতের ন্যায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতার এক ভয়াবহ পরিণতির আগাম সতর্কমূলক বার্তা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে ওচঈঈ-এর ঐ রিপোর্টে। পুরান ঢাকাকে বসবাস উপযোগী নিরাপদ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত এখনই। নিমতলী ও চকবাজার, সদরঘাট, ওয়াইজঘাটসহ সকল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিপদকালীন দুর্ঘটনার সময় এলাকার বসবাসকারী জনগণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জনসম্পত্তি রক্ষার লক্ষ্যে বর্তমান সরু রাস্তাঘাটকে তার সঙ্কীর্ণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে রাস্তাসমূহকে চওড়া ও প্রশস্ত করার দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প প্রণয়ন করে তার ত্বরিত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। পুরান ঢাকার ওয়াসা পানি সরবরাহকারী লাইনসমূহের উন্নয়ন সাধন করে, প্রতিটি ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রের দফতর, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, উচ্চতর দালানকোঠার সম্মুখে এবং রাস্তার প্রতি আধা কিলোমিটার অন্তর অন্তর বা দূরত্বে অগ্নিনির্বাপণের স্বার্থে ফায়ার হাইড্রেন্ট (ঋরৎব ঐুফৎধহঃ) স্থাপন করা উচিত। প্রতিটি ফায়ার হাইড্রেন্ট যেন চিহ্নিতকরণ হয় এবং কখন কি কাজে ব্যবহার করা হবে জনস্বার্থে যেন বর্ণনা করা হয়। পুরান ঢাকায় বিগত শতাব্দীতে নির্মিত জীর্ণ-শীর্ণ, নড়বড়ে আবাসিক ঘরবাড়ি, দালানকোঠা যুগ যুগ ধরে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামত না করায় উক্ত ঘরবাড়িতে বসবাসকারীগণ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এখানকার বহু ঘরবাড়ির মালিক সরকার। প্রতি বছর ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিজের টাকা জমা দিয়ে বছর বছর শুধু নবায়ন করে জনগণ বসবাস অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছেন, পুরান ঢাকায় উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পনের সৃষ্টি হলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। একটি সম্ভাব্য ধ্বংস, প্রাণহানি রোধকল্পে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কোন বিস্তারিত পরিকল্পনা কর্মসূচী অদ্যাবধি গৃহীত হয়নি। নিমতলী ও চকবাজারের ন্যায় ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের অগ্নিকা- বা ভূমিকম্প সংঘটিত হলে, ঘরবাড়ির উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজ পরিচালনায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব প্রভৃতি বিভাগের উদ্ধার তৎপরতার কাজে মারাত্মক বিঘœ ঘটাবে। এই জরুরী বিষয়সমূহ বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, নগর পরিকল্পনাবিদ বিশেষজ্ঞ, রাজউক, সোনবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিশেষ ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করে তাদের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে কালবিলম্ব না করে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বর্তমান সরকারকে। একই সঙ্গে যে সকল সরকারী ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরকার প্রদত্ত লিজের অধীনে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারীদের নিকট স্বল্প দামে বিক্রি করে তাদের নিজ খরচে ঐ সকল ঘরবাড়ির প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরিবর্ধন সাধন করে স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজেদের নিরাপদে থাকা ও বসবাসের উপযোগী করে তোলার সুযোগ প্রদান করা উচিত। অন্যথায়, যে কোন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে মারাত্মক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলে তখন শুধু আমাদের শোক প্রকাশ করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় থাকবে না। দেশের সর্বত্র গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহনের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী বা দায়িত্ব পালনের নির্দেশিকাসম্পন্ন প্রজ্ঞাপন বা আদেশ-নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিএমপি, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্সের জারিকৃত নির্দেশাবলী, দেশের সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে জারি করে তা কঠোরভাবে নজরদারি, পর্যাবেক্ষণ ও নিয়ম-নির্দেশ ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকারের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে গ্যাস সিলিন্ডারের চালানসমূহ কোথায় যাচ্ছে, কার নিকট, কোথা থেকে জঙ্গী মতলববাজ গোষ্ঠী, গ্যাস সিলিন্ডার ও প্রেসার কুকারকে নিরপরাধ মানুষ হত্যাকা-ে তাদের গণবিরোধী জঙ্গী কাজে অনেক সময় ব্যবহার করছে তা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে গ্যাস সিলিন্ডারের মজুদ, পরিবহন, ব্যবসার ওপর কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ের ওপর সদাসর্বদা, নিয়মিত নজরদারি ও অনুসন্ধান কাজে তৎপর থাকা উচিত। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক
×