ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রলার ডুবে ১০ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০

ট্রলার ডুবে ১০ জনের প্রাণহানি

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা ॥ নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার রাজনগর এলাকার গুমাই নদীতে দু’টি ইঞ্জিনচালিত নৌকার সংঘর্ষে একটি যাত্রীবাহী নৌকা ডুবে গেছে। বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঘটেছে এ দুর্ঘটনা। বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১০ নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে একটি পরিবারের মা ও দুই ছেলে-মেয়ে এবং অপর একটি পরিবারের মা-ছেলে রয়েছেন। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আরও বেশকিছু যাত্রী। নিখোঁজ যাত্রীর সংখ্যা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী বলেছেন, অন্তত ৭-৮ জন বা তারচেয়ে কম-বেশি হতে পারে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাজনগর গ্রামের নূরজামাল ও জাহাঙ্গীর আলম জানান, পাশ্ববর্তী সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর এলাকা থেকে একটি যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা (ট্রলার) বুধবার সকালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা বাজারের দিকে যাচ্ছিল। ওই ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঠিক আগে দিয়ে যাচ্ছিল অপর একটি বালুবাহী বাল্কহেড (পণ্যবাহী বড় নৌকা)। পৌনে ১০টার দিকে কলমাকান্দা উপজেলার বড়খাপন ইউনিয়নের রাজনগর এলাকার গুমাই নদীতে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি বাল্কহেডটিকে অতিক্রম করে ডানদিকের একটি ঘাটে ভিড়ানোর সময় নৌকা দু’টির সংঘর্ষ ঘটে। এতে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি উল্টে গিয়ে ডুবে যায়। ঘটনা দেখতে পেয়ে প্রথমে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। পরে পুলিশ ও দমকল বাহিনীর কর্মীরা উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। তবে প্রচ- ¯্র্েরাতে ডুবে যাওয়া নৌকাটি ঘটনাস্থল থেকে অনেকটা দূরে সরে যাওয়ায় উদ্ধার তৎপরতা চালাতে দেরি হয়। বিকেল পর্যন্ত একই পরিবারের তিনজনসহ ১০ জন নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলো- সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার কামাউড়া গ্রামের আলমগীর হোসেনের ছেলে অনিক (৭), একই গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী লাকি আক্তার (৩০), তার ছেলে জাহিদ (৩), মেয়ে টুম্পা আক্তার (৪), ছায়েদ আলীর স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৫০), ইনাতনগর গ্রামের আব্দুল ওয়াহাবের স্ত্রী লুৎফুন্নাহার (২৫), তাদের ছেলে রাকিবুর হাসান (২), ধর্মপাশা উপজেলার জামালপুর গ্রামের জোবায়ের হোসেনের ছেলে মোজাহিদ (৪), কবির হোসেনের স্ত্রী সুলতানা (৪৫) ও নেত্রকোনা সদর উপজেলার মেদনী গ্রামের আবু চানের স্ত্রী হামিদা খাতুন (৩৫)। এদিকে নিখোঁজদের মধ্যে কামাউড়া গ্রামের মনিরা, রতন মিয়া, ফাতেমা ও মোফাজ্জলের নাম জানা গেছে। নিহত এবং নিখোঁজদের স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সূচনা হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজী মোঃ আব্দুর রহমান, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, নেত্রকোনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী, কলমাকান্দা উপজেলার নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তবে ঘটনাস্থল দুর্গম হাওড়াঞ্চল হওয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সেখানে পৌঁছতে দু’ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। নেত্রকোনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত নৌকাটিতে ৩০ জনেরও বেশি যাত্রী ছিল। এদের মধ্যে কিছু যাত্রীকে স্থানীয়রা জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন। বাকি কতজন নিখোঁজ রয়েছে- তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও তা অন্তত ৭-৮ জন বা তারচেয়ে কমবেশি হতে পারে। তাদের উদ্ধারের জন্য ময়মনসিংহের ডুবুরি দলকে খবর দেয়া হয়েছে। বড়খাপন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাদিছুজ্জামান তালুকদার বিকেল ৬টার সময় জানান, ‘ডুবুরিদল ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করবে।’ এদিকে উদ্ধার করা লাশগুলো ঘটনাস্থল থেকেই তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কাজী মোঃ আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, নিহতদের লাশ পরিবহন এবং দাফনের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। জানা গেছে, এর আগে গত ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর হাওড়ে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে ১৮ জন মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রের প্রাণহানি ঘটে। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরসিরতা ইউনিয়ন থেকে তারা হাওড় ভ্রমণে গিয়েছিল। ওই দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত প্রতিবেদনে নৌ-দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বৈরী আবহাওয়া এবং হাওড়ের উত্তাল অবস্থার ঢেউকে দায়ী করা হলেও নৌ-দুর্ঘটনা রোধে কয়েক দফা সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ সমূহের মধ্যে ছিল ঃ ইঞ্জিন নৌকার নিবন্ধন, চালকদের প্রশিক্ষণ, বেপরোয়া চলাচল রোধ, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন রোধ, নৌকায় পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম রাখা, দুর্যোগপূর্ণ সময়ে নৌ-চলাচল বন্ধ রাখা, নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন প্রভৃতি। এসব সুপারিশের কোনটিই আজও কার্যকর করা হয়নি। হাওড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, উচিতপুরের দুর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন ইঞ্জিনচালিত নৌ-চলাচলের ওপর কিছুটা নজরদারি বাড়িয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বুধবার কলমাকান্দার রাজনগরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এরই একটি উদাহরণ। তদন্ত দাবি জাপার ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, হাওড় অধ্যুষিত জেলা নেত্রকোনার কমলাকান্দা উপজেলার গুমাই নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি বলেন, নৌকাডুবিতে একসঙ্গে এতগুলো মানুষের প্রাণহানি মেনে নেয়া যায় না। তাই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরী। তদন্তে কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’ বুধবার এক শোকবার্তায় এসব কথা বলেন তিনি। দুর্ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসা এবং স্থিতদের পরিবারকে যুক্তিযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান জাপা চেয়ারম্যান। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপেজেলার বরখাপন ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসক কাজী মোঃ আবদুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত দশজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও অন্তত ১২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
×