ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বালু চোর মাদকসেবী দলে কিভাবে

প্রকাশিত: ২১:০৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০

বালু চোর মাদকসেবী দলে কিভাবে

ওই চোরেরা ভাল করেই জানে যে, একজন ইউএনও বা সরকারী কর্মকর্তা যখন মফস্বলের প্রায় গ্রামীণ কোন উপজেলায় প্রশাসক বা কর্মকর্তা হয়ে চাকরি করতে যান, তখন আর যাই করুক স্বর্ণালঙ্কার সঙ্গে নিয়ে ওই গ্রামীণ অঞ্চলে সরকারী বাসায় বাস করতে যাবেন না। সাধারণ নিয়মে মেয়েরা তাদের বিয়ের অলঙ্কার মা বা শাশুড়ির কাছে রেখে চাকরি স্থলে যায়। চুরি শব্দটা যে ঘোড়াঘাটের ইউএনওকে নির্মম হত্যা চেষ্টার প্রেক্ষিতে হাস্যকর হয়ে ওঠে, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন প্রশাসকের কতটা অর্থবিত্ত থাকতে পারে, তাও ওই নদীর বালু চোর বা জমি দখলের কাজ করা গুণ্ডা দুর্বৃত্তদের না জানা থাকার কথা নয়। সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা তো তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা হয়- এটাও সবার জানা। বাড়িতে এমন কিছু বেশি অর্থ থাকার কথাও নয়। আমরা যখন ’৭২ সালে পিএসসি দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেছিলাম, তখনও শুরুতে আমার বিয়ের গহনার বেশিরভাগ মায়ের কাছে ছিল। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে নিরাপদ স্থান হিসেবে গহনাগুলো নিজের কাছে রাখি। বলা বাহুল্য, বিয়েতে ইউসুফ মামার উপহার স্টিলের আলমারিটির ভরসাতেই সেসব নিজের বাসায় এনেছিলাম। সে যুগে তো শিক্ষকদের গরিবী অবস্থা ছিল। সরকারী কর্মকর্তাদেরও একই অবস্থা। চোর-ডাকাতের উৎপাত বিশেষ ছিল না। তবে রাজনৈতিক অরাজকতা, সহিংসতা, বিভক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দ্বারা বেশ কিছু হত্যাকা-, তুলার গুদাম, পাটের গুদাম, কল-কারখানায় অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বঙ্গবন্ধুর প্রথম সরকারকে বড় বড় সমস্যার মুখে ফেলেছিল। এখন, এই ২০২০ সালে দেশে যখন নদী দখলকারী, ভূমি দখলকারী, এমনকি নদীর বুক থেকে, পাড় থেকে বালু উত্তোলন করে নদীভাঙ্গন বৃদ্ধি করে নদী তীরবর্তী জনবসতি ধ্বংসের দস্যুতা চলছে, চলছে ‘ক্রসফায়ারে’র ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি, ব্যবসা করতে গেলে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়া, অপহৃত হওয়া অসহায় মানুষের অশ্রু ও কান্নার চিহ্নের মধ্যে সরকারী, বেসরকারী খাতে নারী-পুরুষ কর্মকর্তাদের অনেক বিপদাশঙ্কার মধ্যেই কাজ করতে হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন প্রশাসক, একজন ম্যাজিস্ট্রেট, নারী বা পুরুষ, যেই হোক তার এলাকার সব রকম অনিয়ম, দখল, অন্যায়, হত্যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এলাকায় সংঘটিত প্রতিটি অন্যায়ের অভিযোগ তাদের গ্রহণ করতে হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে সরকারের সেবা অন্যায়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত, অন্যায়ের শিকার মানুষকে পৌঁছে দিতে কাজ করতে হয় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। এখানেই যুক্ত হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের অসম্ভব লোভী মানুষের ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিরপেক্ষ সরকারী কর্মকর্তাদের প্রাণের ওপর হামলার হুমকি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এসব বালুগ্রাসী, ভূমিগ্রাসীদের গু-া-পা-ারা, মাদকসেবী হিসেবে এলাকায় পরিচিতরা আওয়ামী লীগে বা এ দলের অঙ্গসংগঠনের বড় বড় পদ লাভ করে কিভাবে? এই গুণ্ডারা স্থানীয় প্রশাসনকে দরিদ্র ও অন্যায়ের শিকার জনমানুষের কাছে তাদের প্রাপ্য বিচারটি, সেবাটি পৌঁছানোতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী হিসেবে কাজ করে। জনগণ স্তম্ভিত, যে কারা এই গুণ্ডা-পাণ্ডাদের যুবলীগের নেতা বানাল? ও এরা তো এলাকাতে গুণ্ডা-মাদকসেবী হিসেবে পরিচিত ছিল! এমন কি, স্থানীয় সংসদ সদস্য বলছেন- তিনি এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ করেছিলেন আগেই! দেখা যাচ্ছে, বার বার যুবলীগের নেতারা নানা রকম অন্যায় কাজে যুক্ত হিসেবে আলোচনা-সমালোচনায় আসছে। এবারে উত্তরের জনপদটি এক অনুন্নত উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের ওপর সংঘটিত সহিংস হামলাটি একদিকে যেমন চরম বর্বরোচিত, তেমনি এই হামলার হাতুড়ির আঘাতটি লক্ষ্য করলেও বোঝা যায় এটি ছিল হত্যা প্রচেষ্টা। নতুবা ‘চুরি’ করতে না পেরে তারা আর যাই হোক ইউএনওর মাথায় সুনির্দিষ্টভাবে হাতুড়ির আঘাত করত না! হত্যা চেষ্টা সফল করতেই মাথায় এমনভাবে আঘাত করেছে যে, মাথার খুলি ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে, যা প্রমাণ করে আঘাতটি মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য যেমন মাথায় করা হয়েছে, তেমনি সজোরে আঘাতটিও করা হয়েছে। তাহলে, বঙ্গবন্ধুর দলে খুনী, লুটেরা, দুর্বৃত্ত, ভূমি-বালু-নদীগ্রাসী, জুয়াড়িরা বড় বড় পদ দখল করে আর স্থানীয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নীরব অনুসারী যারা কোন ‘পদ’ দখল দূরে থাক, দাবিও করতে পারে না, তারা গু-াদের কনুইয়ের আঘাতে পিছু হটে যাবে- এমন চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে ভিন্ন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যে এ দলের চালিকাশক্তি, তা বোঝার উপায় থাকবে না। এমন হলে জাতির মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-সব ভূলুণ্ঠিত হবে, হচ্ছে। শোনা গেছে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় জেলাভিত্তিক কমিটি গঠনে দলের নেতাদের যেমন মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি গোয়েন্দা রিপোর্টও বিবেচনা করা হয়েছে! তাহলে, ওইসব সুপারিশও কি অর্থের বা অন্য কোন সুবিধার বিনিময়ে গু-া-সন্ত্রাসীদের পদায়ন সম্ভব করেছে? সত্যি কথা বলতে গেলে, ঘোড়াঘাটের যুবলীগের কমিটির নেতৃত্বের চেহারা-ছবি দেখে তাদের কোন মতেই সুশিক্ষিত, ভদ্র তরুণ গণ্য করে না, বরং গু-া-মাদকসেবী, কাউকে পরোয়া না করার বেপরোয়া মনোভাবই দেখা যায়। উপরন্তু, এরা বঙ্গবন্ধুর রচনা দূরে থাক, সাধারণ দু’চারটি গল্প-উপন্যাস পড়েছে বলেও মনে হয় না। জানি না, আওয়ামী লীগ এসব দুর্বৃত্তকে খুঁজে বের করে কি করে? পাঠকেরা নিশ্চয় ভুলে যাননি- কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে কয়েকটি ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছিল, যে বরাদ্দ তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমাই পড়েনি! যা হোক, ওয়াহিদা হয়ত তার বাবার হৈচৈয়ের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন। আশা করছি, শীঘ্রই পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে এবং সততার সঙ্গে তার দায়িত্ব একই রকম দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করে যাবে। সরকার ও দল শুধুমাত্র দোষীদের দল থেকে বহিষ্কার করা, তারপর বিচারে সোপর্দ করে দ-িত করার ব্যবস্থায় কাজ শেষ করতে পারে না। আন্তরিকভাবে খুঁজে বের করতে হবে, কেন দুর্বৃত্ত, গু-া, খুনী, দুর্নীতিপ্রেমীরা, গরীবের চাল চোর, অর্থ চোরেরা দলের নানা স্তরে জায়গা করে নিল? কারা তাদের নাম প্রস্তাব করেছিল এবং কারা তাদের জন্য দেনদরবার করেছে। যারা করেছে, তাদেরও দল থেকে বাদ দিতে হবে। বরং ইউএনওদের কাছ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এবং সরকারী দলের সব রকম সংগঠনের সদস্যদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া যেতে পারে, যা হবে গোপন নথি। স্থানীয় সৎ মানুষের নাম, পরিচয়ও এভাবে জানা যেতে পারে। একটি উপজেলায় এক বছর বাস করলে মোটামুটি ওই এলাকার দুর্বৃত্ত ও ভাল মানুষদের চেনা যায়। এ সঙ্গে উল্লেখ করছি, যেসব জনপ্রতিনিধি গরিবের প্রাপ্য সরকারের মাত্র আড়াই হাজার টাকার লোভ ত্যাগ করে গরিবকে টাকাটি দিতে অন্তর্জালায় ভোগে, তাদের সরকারকে দ্রুত জেলে পাঠাতে হবে। বাজার, হাট, রাস্তা ঘাটে এ পর্যন্ত যতজন রিক্সাচালক, সিএনজি চালক, সাহায্য প্রার্থী নারী-পুরুষ যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি, কেউই দশ কেজি টাকার চাল পেয়েছে বা আড়াই হাজার টাকা পেয়েছে, এমন তথ্য জানতে পারিনি! কন্যাদের শিক্ষা বৃত্তি পাওয়ার তথ্যও জানতে চেয়েছি। একজন মাত্র রিক্সাওয়ালা জানাল, তার এক মেয়ে পেয়েছে, অন্যজন পায়নি। এসব সেফটি নেটের অর্থ সঠিক তালিকার ভিত্তিতে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে সহজসাধ্য হওয়ার কথা। এই তালিকাটি কি স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সহায়তা এবং সৎ হিসেবে পরিচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাহায্যে সুষ্ঠুভাবে প্রকৃত অভাবীদের নাম, পরিচয় যোগ করে তৈরি করা যায় না? এর আগে লিখেছিলাম রাজনৈতিক দল করে না কিন্তু সমাজকল্যাণের কাজ করে এমন তরুণ-তরুণীদের সাহায্যে তালিকা তৈরি হবে সবচাইতে ভালো উপায়। তরুণরাই নিরপেক্ষ হতে পারে অন্যদের চাইতে বেশি। আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করছি। দেশের বেশ কিছু প্রৌঢ়, তরুণ দীর্ঘ দিন যাবত পরিবেশ ও জলবায়ুজনিত ক্ষতি হ্রাসে নানা ক্ষেত্রে কাজ করছে। যেমন, নদীরক্ষা, হাওর, খাল-জলাভূমি রক্ষা, ভূমিরক্ষা, বনরক্ষা, নদীর পানি রক্ষা, বাঘ রক্ষা, শকুন রক্ষা, পাখি রক্ষা করে জীববৈচিত্র্য ধরে রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। তারা সারাদেশ ঘুরে এর কারণ ও প্রতিবিধানও করতে শিখেছেন। প্রায় পরিবেশ ও জলবায়ুর সুরক্ষায় বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে। তাদের অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃতি দিয়ে জলবায়ু বিষয়ে দেশে-বিদেশে লড়াই করার জন্য যোগ্য যোদ্ধা হিসেবে তিনজনের একটি ছোট কমিটি দেশীয় দূত হিসেবে কাজ করার জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। যাতে দু’জন তরুণ ও একজন তরুণী, এমনকি পর্বতারোহীও থাকতে পারেন। তারা ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ বা বিভিন্ন নামে কাজ করে। যারা পরিবেশ ও জলবায়ুর ক্ষতির বিষয়ে যেমন ওয়াকিফহাল, তেমনি বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ ও ফল সম্বন্ধেও জানে। যে ক্ষেত্রে যারা কাজ করে, তাদের সে ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করতে দিতে কোন বাধা নেই, বরং সেটিই করা উচিত। এক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞকে অন্য ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়ার কোন কারণ নেই। যেহেতু দেশে এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তরুণ ও প্রৌঢ়রা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×