ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিসের ঐতিহ্য? ‘সিম্পল অডিটরিয়াম’ বলে ভাঙ্গার তোড়জোড়

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

কিসের ঐতিহ্য? ‘সিম্পল অডিটরিয়াম’ বলে ভাঙ্গার তোড়জোড়

মোরসালিন মিজান ॥ দুই বা দেড় দশকের নয়, ১৩৫ বছর আগের স্মৃতিচিহ্ন। একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। কুমিল্লায় অবস্থিত ভবনটি বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন নামে পরিচিত। প্রাচীন স্থাপত্য চিন্তা, রুচির এটি অনন্য নিদর্শন। কুমিল্লার আঞ্চলিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হয়ে আছে। শহরের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র বলতে যা বোঝায়, ভবনটি ঠিক তা-ই। রাজধানী ঢাকার বিদগ্ধ জনেরাও স্থাপনাটির হেরিটেজ মূল্য উপেক্ষা করতে পারেন না। তবে এতক্ষণ যা বলা হলো তার ঠিক বিপরীত কারণে ভবনটি এখন আলোচনায়। জানা যাচ্ছে, গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন ভেঙ্গে সেখানে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। অবশ্য দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা একে ‘অপতৎপরতা’ বৈ অন্য কিছু বলতে নারাজ। ঐতিহ্য বিনাস করে সেখানে আধুনিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। ভেতরে ভেতরে অনেক দিন ধরেই চলছিল প্রস্তুতি। তবে নতুন সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ্যে আসে অতি সম্প্রতি। আর তখন থেকেই প্রতিবাদে সোচ্চার স্থানীয় সচেতন মানুষ। উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছেন রাজধানী শহরে বসবাসরত দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা। ইতিহাসবিদ ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষ ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা কয়েকদিন ধরে টানাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। এভাবে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। স্থাপনাটিকে ইতিহাস ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মানছে জেলা প্রশাসনও। সরকারী ওয়েবসাইট পরিদর্শন করে ভবনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন ত্রিপুরা জেলার চাকলা রোশনাবাদের জমিদার নরেশ মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের কাছে পাঠাগার নির্মাণের জন্য জমি প্রদানের অনুরোধ জানান। মহারাজ কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির ওপর একটি ভবন নিজস্ব অর্থায়নে করে দেন। ১৮৮৫ সালের ৬ মে প্রতিষ্ঠিত ওই ভবনই কুমিল্লার গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করে বলছে, টাউন হল মাঠ ও মিলনয়তন অসংখ্য রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সভা সামবেশের সাক্ষী। এ অঞ্চলের রাজনীতি ঘন ঘন পট পরিবর্তন করেছে। পট পরিবর্তনের নানা পর্যায়ে বড় বড় নেতারা টাউন হলে পা রেখেছেন। ভাষণে বক্তৃতায় তারা নিজেদের ধ্যান-ধারণা তুলে ধরেছেন। টাউন হলে পদধূলি দিয়েছেন অবিভক্ত ভারতের শান্তিকামী নেতা মহাত্মা গান্ধী, বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানীর মতো নেতারা। শিল্প সাহিত্য অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উজ্জ্বল উপস্থিতির কথাও মুগ্ধতা নিয়ে বলে থাকেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামহ কিংবদন্তিদের আগমনের স্মৃতি সযতেœ লালন করেন স্থানীয়রা। পাঠাগারটি কত সমৃদ্ধ তাও কারও অজানা নয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র এখানে রয়েছে। বাংলা ভাষার আছে ২৪ হাজার বই। ইংরেজী ভাষার আছে ছয় হাজার। ৬৩টি আলমারিতে মোট ৩০ হাজার বই। পাঠাগারে বসে বই পড়ার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। টাউন হল ভবনের দ্বিতীয় তলায় যে কেউ যত সময় খুশি বই পড়তে পারেন। রাখা হয় পত্রিকাও। নিচতলায় সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ৪৪টি জাতীয় আঞ্চলিক, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী। যে কেউ চাইলে পুরোনো পত্রিকার কপি দেখতে পারেন। তবে বর্তমানে সব বাদ দিয়ে নতুন কমপ্লেক্স ডিজাইন করা হয়েছে। ডিজাইনের থ্রিডি উপস্থাপনাও দেখার বাকি নেই কারও। সেখানে মূল ভবনের কোন অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ, ঐতিহ্যবাহী ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে তার ওপরে নির্মিত হবে নতুন কমপ্লেক্স। হঠাৎ এ উদ্যোগ মেনে নিতে নারাজ বিশিষ্টজনেরা। এ কাজের তীব্র সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন তারা। মঙ্গলবার দেশের ৫০ বিশিষ্ট নাগরিক ঐতিহ্য রক্ষার দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন। তারও আগে থেকে ফেসবুকে চলছে প্রতিবাদ। সমালোচনার তীব্রতা কত বোঝা যায় কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কবি সেখানে যারপরনাই ক্ষিপ্ত। লিখেছেন, ‘স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন ভবনটি যারা ভাঙতে আসবে, তাদের হাত ও কোমর ভেঙ্গে দেয়ার জন্য একটা শক্তশালী স্কোয়াড গঠন করা হোক। আমি সেই ঐতিহ্যরক্ষক স্কোয়াডের সদস্য হতে রাজি আছি।’ সব কিছু শেষতক প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হয়। এমন উপলব্ধি থেকে সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। লিখেছেন, শেখ হাসিনার সরকার এরকম একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিশ্চয়ই তিনি প্রতœতত্ত্ব বিভাগকে এরকম দুষ্ট চিন্তা থেকে সরে আসার জন্য নির্দেশ দিবেন।’ কুমিল্লায় কিছুকাল বসবাস করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। মিলনায়তনটিতে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকে অভিনয়ও করেছেন তিনি। বিশিষ্ট নাট্যজনের বক্তব্যÑ আমরা ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে এখনও অনেক উদাসীন। কুমিল্লায় একই ব্যাপারে দেখছি। এটা হেরিটেজ বিল্ডিং। কুমিল্লাকে এটি দ্বারা চেনা যায়। স্থাপনাটি অবশ্যই অক্ষত রাখতে হবে। তাহলেই কেবল সংস্কারের কাজ হতে পারে। কিন্তু উন্নয়নের নামে নষ্ট করা যাবে না। ঐতিহাসিক স্থাপনা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না নেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দেন তিনি। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে আগে থেকেই সরব হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ফেসবুকে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তিনি বলছিলেন, আমরা উন্নয়ন চাই। তবে এমন ঐতিহ্য বিনাশী উন্নয়ন চাই না। কুমিল্লার স্থাপনাটি যে কোন বিবেচনায় সংরক্ষণের দাবি রাখে। সেটি না করে কমপ্লেক্সের প্রতি এত ঝোঁক কেন? ভবন রক্ষার জোর দাবি জানান তিনি। সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী হাসান আরিফ ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনে টাউন হলের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এদিকে, নতুন উদ্যোগ এগিয়ে নেয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে নামটি উচ্চারিত হচ্ছে তিনি কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহা উদ্দিন বাহার। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি পরিষ্কার বলেন, কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ কোনভাবেই বন্ধ হবে না। এখানে ঐতিহ্যের কিছু নেই। কিসের ঐতিহ্য? সিম্পল একটা অডিটরিয়াম। ১৩৫ বছরের বলা হচ্ছে, আসলে এটি মাত্র ৮৫ বছর আগের বিল্ডিং। ওপরে টিনের চাল। বিভিন্ন সময় এর সংস্কার হয়েছে। কিন্তু এখন এভাবে আর চলে না। যুগের কথা ভাবতে হবে। কুমিল্লার জনসংখ্যাও তো বেড়েছে। তাই পুরনো ভবন ভেঙ্গে নতুন কমপ্লেক্স করা হবে। একে উন্নয়ন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরও অনেকে এমপি মন্ত্রী ছিলেন। কেউ এত উন্নয়ন করেননি। আমি করছি। যারা ঐতিহ্য রক্ষার দাবিতে সোচ্চার তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এখানে রাজনৈতিক এলিম্যান্ট আছে। এ ক্ষেত্রে কুমিল্লা নামের সঙ্গে যে ‘কু’ আছে, এটি একটি কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিবৃতিদাতারা কুমিল্লার নন বলেও মন্তব্য করেন স্থানীয় সাংসদ। তাহলে কি শেষ রক্ষা হবে না? জানতে কথা হয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সঙ্গে। তার মন্ত্রণালয় থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। এত সমালোচনা হচ্ছে। কী বলবেন এ সম্পর্কে? প্রশ্ন করা হলে কিছুটা আশ্বস্ত করেন প্রতিমন্ত্রী। বলেন, আসলে স্থাপনাটি এত পুরনো প্রাথমিকভাবে আমার জানা ছিল না। এখন জেনেছি। আমি বলতে পারি, ঐতিহ্য বিনষ্ট করে কিছু করা হবে না। কিন্তু নক্সায় মূল ভবনের কোন অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি তাকে জানানো হলে প্রতিমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, নক্সা কোথায় দেখেছেন? কে করল? আমি তো দেখিনি। নক্সা যাই হোক, ঐতিহ্য ধরে রেখেই নতুন কাজ হবে বলে আশ্বস্ত করেন প্রতিমন্ত্রী।
×