ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুইশ’ বছরেরও প্রাচীন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, নষ্ট হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

দুইশ’ বছরেরও প্রাচীন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, নষ্ট হচ্ছে

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। সেখানে আছে সোনার নৌকা! শুনলেই চমকে ওঠার কথা। কুয়াকাটা সৈকতে জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন আমলের পালতোলা জাহাজটিকে স্থানীয়রা এ নামেই চেনেন। স্থায়ীভাবে এ জাহাজটি মূল আদলে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এজন্য অত্যাধুনিক দর্শনীয় স্থাপনা তৈরি করার কথা ছিল। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর বিভাগ জাহাজটি সংরক্ষণে এমন উদ্যোগ নেয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাজটি শুরুর কথা বলেছিলেন তারা। বৈজ্ঞানিকভাবে জাহাজটি সংরক্ষণের এমন উদ্যোগ নেয়ায় পর্যটক-দর্শনার্থীসহ কুয়াকাটাবাসী উদ্বেলিত হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি কিছুই করা হয়নি। ফলে এখন শত বছরের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাচীন পালতোলা জাহাজটির কাঠগুলো নষ্ট হয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। শ্রীহীন হয়ে গেছে। উপরের টিনের চালটিও নেই। এখন রোদে পুড়ছে, আর বৃষ্টিতে ভিজছে। জাহাজটির আদল ঠিক রেখে সংরক্ষণের জন্য চারদিকে কোমর সমান উঁচু দেয়ালের পরে পর্যটক দর্শনার্থীরা যাতে সহজে দেখতে পারে এজন্য দেয়ালের উপরে ফাইবার জাতীয় স্বচ্ছ বাউন্ডারি করার পরিকল্পনা ছিল। উপরে একটি দর্শনীয় ছাউনি থাকার কথা ছিল। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের কাছেই থাকবে প্রাচীণ আমলের পাল তোলা জাহাজটি সংরক্ষণ যাদুঘর। জাহাজটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার সুযোগ থাকবে। আকর্ষণীয় এ স্থাপনার মধ্যে প্রাচীন এ নিদর্শণটি কুয়াকাটার সৌন্দর্যের আরেক দর্শনীয় দিগন্তের সূচনা ঘটবে বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর তখন বলেছিল। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। পর্যটকরা বলেছেন, এটিকে বেড়িবাঁধের ভিতরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করে পর্যটকের দর্শনের সুযোগ করে দেয়া হোক। সিদ্দিক নামের একজন কেয়ারটেকার জানান, তিনি নিজেও কিছুই জানেন না এর পরিকল্পনা সম্পর্কে। এক কথায় প্রাচীন এ জাহাজটি অরক্ষিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ জাহাজটি ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কুয়াকাটা বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রতœতাত্ত্বিক এই প্রাচীন নিদর্শনটি রক্ষার জন্য আধুনিক স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম কুয়াকাটায় জাহাজটি পরিদর্শন করে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। প্রাচীন এ জাহাজটি দর্শনে প্রতিদিন পর্যটক-দর্শনার্থী ভিড় করে। কিন্তু যথাযথ সংস্কারের অভাবে জাহাজটি অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। অবকাঠামো ক্ষয়ে গেছে। গুঁড়া, তলার কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে অনেকটা। এখন এটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সূত্রমতে, পাল তোলা জাহাজটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতœসম্পদ। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে এ ধরনের জাহাজ আগে কখনও দেখা যায়নি। এটি কমপক্ষে দুশ বছরের পুরনো। জাহাজটি জারুল কাঠের তৈরি। কাঠের পূরুত্ব সাড়ে ছয় সেন্টিমিটার। কাঠ, লোহা ও তামার পাত দিয়ে তৈরি। জাহাজটি অবিকলভাবে সংরক্ষণ করে কুয়াকাটায় আধুনিক স্থাপনার মধ্যে স্থাপন করলে পর্যটকের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় হতো। ৭২ ফুট লম্বা ২৪ ফুট প্রস্থ এবং ১০ দশমিক ৬ ফুট উঁচু জাহাজটি। এটি বালুর নিচ থেকে তোলার কাজে নগরবাড়ি থেকে ১০ জন দক্ষ শ্রমিক ছাড়াও ৪২ জনের একটি শ্রমিকদল কাজ করেছে। পাঁচ সদস্যের কপিকল দল ছিল সার্বক্ষণিক। সাতটি কপিকল ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয় স্থানীয় ২০ জন শ্রমিক। এটি উদ্ধার কালে পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন মেলে। পাটখড়ি, মাদুরের অবশেষ, শিকল ও তামার অসংখ্য পাত পাওয়া যায়। ভাঙ্গা মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহা দস্তার তৈরি ব্যালাস্ট পাওয়া যায়। দুটি মাস্তুলের সদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে এ জাহাজটিকে সোনার নৌকা বলা হয়। কারণ এর বাইরের আবরণ তামার পাতে মোড়ানো ছিল বলে মানুষ এমন নামকরণ করে। রাখাইনদের দাবি এ জাহাজটি তারা ২০০ বছর আগে ব্যবহার করেছেন। মতান্তরে সাধু সওদাগরে ধান-চালের সওদার কাজে ব্যবহৃত নৌকা। কেউ কেউ পর্তুগীজদের ব্যবহৃত পাল তোলা ছোট্ট জাহাজ বলেও ধারণা করছেন। ২০১২ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান সংলগ্ন বেলাভূমের নিচ থেকে স্থানীয় জেলেরা প্রথমে প্রাচীন এ জাহাজটি দেখতে পায়। সৈকতে জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন আমলের জাহাজটি বেরিয়ে আসে। পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজন জাহাজটির বাইরের পিতলের প্রলেপ কেটে নিয়ে যায়। জাহাজটি নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন তখন প্রকাশ হয়। তখন সরকারী ব্যবস্থাপনায় এটি সংরক্ষণে পুলিশি পাহারা বসানো হয়। একই বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে জাহাজটি পরিদর্শন করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ইভাস মারে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের তাড়াতাড়ি শিপিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইভাস মারে জাহাজটির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। সি প্লেনযোগে তিনি ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসেন। নৌকা বিষয়ে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ এই বিশেষজ্ঞ তার জন্মস্থান ফ্রান্স থেকে তার নিজের তৈরি নৌকায় চড়ে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আসেন। স্বচক্ষে এটির বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ শেষে ইভাস মারে তখন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই নৌকাটি অসাধারণ এবং প্রাচীনকালের স্মৃতিবিজড়িত। নৌকাটির বয়স সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারেননি তিনি। তবে তার ধারণা এটি শত বছরের বেশি পুরনো। নৌকাটি গরান কাঠ দিয়ে তৈরি বলেও তিনি অনুমানের উপরে বলেছিলেন। নৌকাটি বালুর নিচ থেকে পুরোটা উত্তোলন করে কুয়াকাটায় জাদুঘর করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন; যাতে এটি হারিয়ে না যায়। নৌকাটির সঙ্গে এখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের সম্পর্ক রয়েছে মন্তব্য করে একারণে অন্য কোথাও না নেয়ার পরামর্শ ছিল মারের। তার মতে প্রাচীন এই নৌকাটি যে অবস্থায় রয়েছে এভাবেই সংরক্ষণ করলে দেশী-বিদেশী পর্যটক কুয়াকাটার প্রতি ভ্রমণে আকৃষ্ট হবে।’
×