ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ চক্র

প্রকাশিত: ২১:৩১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ চক্র

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে চাকরির জন্য ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে সাড়ে তিন শতাধিক বেকার তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে প্রায় চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। র‌্যাব ও সিআইডি গত দুদিনের সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ১৩ জনকে হাতেনাতে ধরেছে। এ বিষয়ে সোমবার সিআইডি বাদী হয়ে বনানী থানায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। র‌্যাব ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানিয়েছেন, গত দুদিনব্যাপী এ অভিযানে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ভুয়া নিয়োগ বাণিজ্য করে শত শত বেকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে নিয়েছে। থার্ড টার্মিনালে নিয়োগের কথা বলে স্যামসাং কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ‘ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট’ দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ওই প্রতারকচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বনানী ২৭নং রোডের এ ব্লকের হাউস নং-৪৫-এর ৬ষ্ঠ তলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন-এশিয়াান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরসের কর্মচারী গোলাম মাজেদ, অফিস সহকারী নারায়ণ সরকার, মোঃ মেহেদী, ইমতিয়াজ ও এনায়েত উল্লাহ। সে চেকটি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়। এক অফিস থেকে আল ফাইহান মেডিক্যাল সেন্টারের চেক, রিক্যুইজিশন স্লিপ ১২০টি, তাদের মনোনীত আল ফাইহান মেডিক্যাল সেন্টারের ভুয়া এবং স্বাক্ষরবিহীন মেডিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট ২৪টি, ভুয়া ডাক্তার ও বিভিন্ন নামের সিলমোহর ১০টি, পাসপোর্ট ৩৭টি, বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বায়োডাটা ৫৮টি, বিভিন্ন লেনদেন সংক্রান্ত রেজিস্টার ৪টি, মানি রিসিট বই দুটি, সোনালি চাকমার নামে ট্রেড লাইসেন্স একটি এবং ৫টি ভুয়া চাকরির কনফারমেশন লেটার জব্দ করা হয়। র‌্যাব ম্যাজিস্ট্র্রেট সারোয়ার আলম তাাদের ১৩ জনকে ঘটনাস্থলেই বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান করেন। র‌্যাব জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণার মাধ্যমে সাড়ে ৩০০ চাকরি প্রত্যাশীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে তিন কোটিরও বেশি টাকা। চাকরি দেয়ার নাম করে ক্ষেত্র বিশেষে একজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে চক্রটি। পলাতক রয়েছেন প্রতারণার মূলহোতা প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আশরাফ খান ওরফে সুলতান মাহমুদ। জানা গেছে, এ ঘটনায় সোমবার বনানী থানায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। মামলাটি করেছেন সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। মামলা নং-৮। গ্রেফতারকৃতদের পাঠানো হয়েছে আদালতে। এ বিষয়ে সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক বলেন, বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের কাজের জন্য লোক নিয়োগের বিষয়ে স্যামসাং কোম্পানির ‘ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি দেখিয়ে নিরীহ অসহায় মানুষকে লোভনীয় চাকরির কথা বলে অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাত করেছে। এ বিষয়ে মামলার বাদী ও অভিযানে অংশগ্রহণকারী সিআইডি ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের এসআই জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ৫/৬ জন ভুক্তভোগী সিআইডিকে অভিযোগ করেন যে, বনানী ২৭নং রোডের এ ব্লকের হাউস নং-৪৫ এর ৬ষ্ঠ তলায় অবস্থিত এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরস নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক আশরাফ খান এবং তার সহযোগীরা চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে নগদ টাকা গ্রহণ করে ভুয়া চাকরির নিয়োগপত্র প্রদান করেছেন। চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে তারা জানতে পারেন ভুয়া নিয়োগপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অফিসে কথা বলতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আশরাফ খান ও তার লোকজন তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দেয়। এ অভিযোগ পেয়ে উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়ে সিআইডির একটি দল আরও অনেক লোকজনের সমাগম দেখতে পায়। তাদের সবাই অভিযোগকারীদের মতোই প্রতারণার শিকার। সবার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করার পর ভুয়া নিয়োগপত্র দেয়া হয়। কিন্তু তারা যখন রবিবার ও সোমবার চাকরিতে যোগদান করতে আসে তখন চাকরি মেলেনি। তখন তারা হতাশ হয়ে পড়েন। এমনই এক প্রতারিত ভিকটিম গোপালগঞ্জের রাজিব বিশ্বাস যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে। করোনায় চাকরির সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করতে থাকেন। এ সময় ফেসবুকে পেয়ে যান চমকপ্রদ চাকরির বিজ্ঞপ্তিও। দেশের অন্যতম মেগাপ্রকল্প বিমানবন্দরে নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনালের সাইট ইঞ্জিনিয়ার পদে, উল্লেখিত পদে বেতনও আকর্ষণীয়। মাসিক ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। আবেদনও করেন চাকরির সন্ধানে থাকা রাজিব। এতেই পা দেন প্রতারণার ফাঁদে। চাকরিটি পেতে রাজিব যোগাযোগ করেন এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরস নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। চাকরি দেয়ার নামে প্রতিষ্ঠানটি তার বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৭০ হাজার টাকা। আরও ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে চাকরিতে যোগদানের পর। এ জন্য নিয়োগপত্রও দেয়া হয়। তারপর যোগ দিতে গিয়ে দেখেন সবই ভুয়া। তোর মতো অপর ভিকটিম রাজিব বিশ্বাসও বিমানবন্দরে চাকরিতে যোগদান করতে যান। সেখানে গিয়ে তার মতো শুভাংশু বিশ্বাস, নাহিদ ম-ল ও মধু নামে আরও চারজন জানতে পারেন প্রতারণার বিষয়টি। এ বিষয়ে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পাওয়া কোরিয়ান কোম্পানি জানায়, ‘ভুয়া নিয়োগপত্রের’ মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরস নামক কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোন চুক্তি বা যোগাযোগ নেই। এরপর তারা ‘ভুয়া নিয়োগদাতা’ প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরসের বনানী কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন পুলিশি অভিযানের কথা। সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা জানতে পারেন- ওই প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এ বিষয়ে সিআইডি জানিয়েছে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কুমিল্লার নোমান হোসেন (২০) নামে এক ভুক্তভোগী অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরসের মালিক আশরাফ খানের মায়ের এ্যাকাউন্টে ৮০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এ এম মেরাজ আল মাহমুদ বলেন, আমরা বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান স্যামসাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছে, এশিয়ান ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরস নামক কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোন চুক্তি বা যোগাযোগ নেই। মূলত, স্যামসাংকে সামনে রেখে সুপারভাইজার, সাইট ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযানকালে আমরা একটি তালিকা পেয়েছি।
×