ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর সাত্তার

মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনী

প্রকাশিত: ২০:২৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনী

আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য আগরতলায় পৌঁছাই একাত্তর সালের মে মাসের ৯ তারিখে। ওখানে পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কোন্ সেক্টরে আমার যোগ দেয়া উচিত? মে মাসের ২০-২৫ তারিখ জানতে পারলাম, নৌকমান্ডো তৈরির জন্য পশ্চিম বাংলার পলাশীতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আমার জন্ম বরিশালের স্বরূপকাঠি উপজেলায় মামাবাড়িতে। বড় হয়েছি ওখানে। তাই সাঁতারে আমার সহজাত দক্ষতা আছে। ইন্টার স্কুল জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। তাই আমি দু’নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করলাম, নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ দাতাদের প্রধানের কাছে আমার একখানা পরিচয়পত্র লিখে দেন এবং কলকাতায় যাওয়ার জন্য আমার একটা ব্যবস্থা করে দেন। খালেদ মোশাররফ বললেন, শুনেছি, গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লালের কাছে মুক্তিবাহিনীর জন্য ছোট একটি এয়ারফোর্স গঠনের প্রস্তাব করেছেন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান ওই প্রস্তাব অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্স গঠনের জন্য ভারত সরকারের কাছে সুপারিশও করেছেন। এখন ভারত সরকার অনুমোদন করলে মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্স গঠিত হবে। তাই যদি হয়, তবে মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্সে তুমি বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। তোমার এখন অপেক্ষা করাই উচিত! একাত্তর সালের ১২ জুন ভারতীয় সোনাবাহিনীর একজন মেজর এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং বললেন ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিনকে নিয়ে তিনি পরের দিন দুপুর দুটোর সময় আমাদের আগরতলা বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবেন। এরপর আমরা আগরতলা থেকে কলকাতায় যাই। ওখানে তিন/চার দিন থাকার পর আমাদের যেতে হলো দিল্লী। আমাদের কলকাতা এবং দিল্লী যাওয়ার সবকিছু কড়াকড়িভাবে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল। দিল্লীতে বিএন কাপুর নামের ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি নিত্যদিন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। খুব মেধাবী এবং পাণ্ডিত্যের অধিকারী মানুষটি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। এর মাধ্যমে তিনি অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের আনুগত্য, আমাদের চারিত্রিক সততা, বিশ্বস্ততা বুঝতে চেষ্টা করতেন বলেই মনে করি। প্রায় পনেরো দিন পর ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর তেওয়ারি বিএন কাপুরের সঙ্গে এলেন। তিনিও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। দু’-এক দিন পর কমোডর তেওয়ারির সঙ্গে আরও দু’-তিন উর্ধতন অফিসার এলেন। চা-কফি পান করতে করতে অনেক বিষয়ে আলাপ হলো। মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের কমিটমেন্ট (COMMITMENT), চারিত্রক সততা-বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় আমরা উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছি। কয়েক দিন পর বিএন কাপুর, এয়ার কমোডর তেওয়ারি, অন্য একজন এয়ার কমোডর এবং একজন বেসামরিক উচ্চপদস্থ অফিসার আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তারা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী হলে ক’জন বাঙালী পাইলট পাওয়া যাবে। বললাম, আট থেকে দশজন পাওয়া যাবে। কি ধরনের এ্যারোপ্লেন হলে আমাদের সুবিধা হবে- সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বায়াফ্রার যুদ্ধের বা বলা যায় বায়াফ্রান এয়ারফোর্সের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে হলো। বায়াফ্রার এয়ারফোর্সের নামও ছিল বিএএফ (বায়াফ্রান এয়ারফোর্স)। ওই বিমানবাহিনীতে তিনজন ছিলেন বায়াফ্রার অধিবাসী। আরও পাঁচ বা ছয়জন ছিলেন ইউরোপীয় ভল্যান্টিয়ার পাইলট। তাদের মধ্যে সুইডিস পাইলট কার্ল গুস্তাভ কাউন্টভন রজেন ছোট একখানা প্লেনের দুই ডানায় রকেট সংযোজন করে একাকী রাতেরবেলায় অভিযানে গিয়ে নাইজিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে অবস্থানরত ৯ খানা মিগ-১৭ ফাইটার প্লেন ধ্বংস করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। টাইমস এবং নিউজ উইক পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের ক্যাপ্টেন শাহাব এবং আমি ওই দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করে বললাম, আমাদের অমন ছোট প্লেনের চেয়ে সামান্য বড়, সে প্লেনে শুধু রকেট নয়, একটি হেভি মেশিনগানও বহন করা যায়, এমন প্লেনের ব্যবস্থা করলেই ভাল হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশে কত বিমানবন্দর ও পরিত্যক্ত রানওয়ে আছে? বললাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছয় হাজার ফুট দৈর্ঘ্যরে রানওয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এখন ব্যবহারযোগ্য রানওয়ের সংখ্যা হবে ১৫ থেকে ২০টি। এয়ার কমোডর তেওয়ারি, বিএন কাপুর আমাদের কথাগুলো লিখে নিলেন। এক সপ্তাহ পর বিএন কাপুর, এয়ার কমোডর তেওয়ারি এবং তার সহযোগী এয়ার কমোডর আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম, অবশ্যই সুসংবাদ আছে। তারা বললেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি নৈশভোজের পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন। এ কথাও বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু কথাটা তারা মুখে স্পষ্ট করে বললেন না। ওই পার্টির দু’তিন দিন পর আমাদের কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। কলকাতায়ও আমাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। আমাদের তিনজনের পরিচয়পত্র তৈরি করে দেয়া হলোÑ ক্যাপ্টেন খালেক হলেন স্কো.লি., অরুণ কুমার চৌধুরী, শাহাব হলেন ফ্লা. লে. এবং মণ্ডল, আমি হলাম, ফ্লা. লে.। কলকাতায় এক মাসের কিছু বেশি সময় অবস্থান করার পর আমাদের যেতে হলো নাগাল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ডিমাপুর। ওখানে আমাদের আগেই ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন মুকিত, ফ্লা. লে. শামসুল আলম, ফ্লা. লে. বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন পৌঁছেছিল। সবাই আগে থেকেই আমাদের বন্ধু। ডিমাপুর পৌঁছানোর পর তিন থেকে চারদিনের মধ্যে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেল। প্রত্যেকটি এ্যারোপ্লেন চালানোর জন্য প্রয়োজন ছিল তিনজন করে পাইলটের। দু’জন পাইলট যাবেন যুদ্ধাভিযানে এবং একজন থাকবেন স্ট্যান্ডবাই। যে দু’জনের যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার কথা, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে যাবেন স্ট্যান্ডবাই পাইলট। এই হিসেবে ডাকোটা প্লেনে আমরা ছিলাম চারজন পাইলট : ক্যা. খালেক, ক্যা. মুকিত, ক্যা. শাহাব এবং আমি। অর্থাৎ, একজন বেশি। অটার প্লেনে ছিল ফ্লা.লে. শামসুল আলম, ক্যা. সরফুদ্দিন, ক্যা. আকরাম। হেলিকপ্টারে স্কো.লি. সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লা.লে. বদরুল আলম। এই হিসেবে ডাকোটায় ছিল একজন বেশি পাইলট এবং হেলিকপ্টারে একজন কম। তখন ক্যা. শাহাবকে স্থানান্তর করা হলো হেলিকপ্টারে। ক্যাপ্টেন শাহাব ইতোমধ্যে ডাকোটা প্লেনের ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ক্যাপ্টেন শাহাবকে হেলিকপ্টারে স্থানান্তর করার বিশেষ কারণ হলো, ইন্সট্রাক্টরদের অভিমতে ফ্লাইং দক্ষতায় শাহাব ছিল ডাকোটা প্লেনের চার পাইলটের মধ্যে সবচেয়ে ভাল। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণেই সে হেলিকপ্টার ফ্লাইংয়ের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। ফল হলো-শাহাব ডাকোটা এবং হেলিকপ্টার প্লেন দুটোর ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করল। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির একটি ধারায় ছিল- দুটি দেশের যে কোন একটি দেশ তৃতীয় কোন দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ধারাটি কার্যকর করতে অর্থাৎ, পাকিস্তান যেন ভারত আক্রমণ করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করাটাই ছিল ভারতীয় সমরবিদদের পরিকল্পনা। একটি নির্দিষ্ট সময় পাকিস্তানকে প্ররোচিত করার জন্য আমাদের ডাকোটা প্লেন দিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়। ওই আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে পাক বাহিনীর গুলিতে ডাকোটা প্লেনখানা ভূপাতিত হলেও ভারতকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত বা প্রমাণিত করা যাবে না। এর কারণ প্লেনখানার পেছনের দিকটায় ভার্টিক্যাল ফিনের উভয়পাশে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা ছিল। আমরা ডাকোটা প্লেনের ক্রুরা জীবিত অথবা মৃত ধরা পড়লেও দেখতে পেত আমরা বাংলাদেশের পাইলট। অভিযানে যেতে হবে রাতের বেলায়। তাই আমাদের নেভিগেশনের প্রশিক্ষণ ফ্লাইটগুলোও করতে হতো রাতেরবেলায়। আমরা রাতেরবেলায় ডিমাপুর থেকে গোয়াহাটি, কুম্ভিগ্রাস, আগরতলা এসব জায়গায় ফ্লাই করতাম। ফ্লাই করতাম শুধু দিকদর্শন যন্ত্র, উচ্চতা মাপার যন্ত্র এবং গতিবেগ মাপার যন্ত্রকে নির্ভর করে। আক্রমণকালে পাকিস্তানী রাডারকে ফাঁকি দেয়ার জন্য খুব নিচের উচ্চতা দিয়ে আমাদের ফ্লাই করতে হতো। দু’শ’ ফুটের বেশি উচ্চতা দিয়ে যেন আমরা ফ্লাই না করি এমন নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইন্সট্রাক্টর সঞ্জয় কুমার বসে থাকতেন আমাদের পেছনের আসনে। জৈন্তিয়া পাহাড়ের গিরিপথ ধরে অমন নিচের উচ্চতা দিয়ে ফ্লাই করা ছিল খুব বিপজ্জনক ব্যাপার। ডিমাপুর, গোয়াহাটি এবং পার্বত্য ত্রিপুরা অঞ্চলে এমন গভীর জঙ্গল যে, দিকদর্শন যন্ত্রকে ঠিকমতো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলে গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারত। পাহাড়ী অঞ্চলে ব্যারোমেটিক অল্টিমিটার এবং রেডিও অল্টিমিটার কোনটাই তেমন নির্ভরশীল নয়। এর ওপর ছিল আরও এক সমস্যা। যাত্রাপথ সবসময় মেঘমুক্ত থাকত না। ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার ডিমাপুর এলেন। তিনি জানালেন, পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হবে। ২৮ সেপ্টেম্বর একে খন্দকারসহ আমরা নয়জন পাইলট (সুলতান মাহমুদ তখনও ডিমাপুর এসে পৌঁছাননি, রানওয়ের পাশে টারমাক এরিয়ায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লালের আগমনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের সঙ্গে পাকিস্তান বিমান বাহিনী পরিত্যাগ করে আসা ৪৭ বাঙালী টেকনিশিয়ানও ছিলেন। বেলা এগারোটায় এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লাল একখানা ডাকোটা প্লেনে করে এসে ডিমাপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ এয়ার মার্শাল ধেওয়ান ও জোরহাট বিমান ঘাঁটির বেজ কমান্ডার গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। পিসি লাল আমাদের আটজন পাইলটের সঙ্গে এক এক করে পরিচিত হলেন। একে খন্দকারের সঙ্গে তো তিনি আগেই পরিচিত ছিলেন। পিসি লাল আমাদের সঙ্গে বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিলেন। তার মা ছিলেন বাঙালী এবং কুমিল্লার অধিবাসী। তার স্ত্রীও বাঙালী। তার পুত্রবধূও বাঙালী। তার পিতা রবিঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তার পিতা ছিলেন পাঞ্জাবের মানুষ। এরপর একে খন্দকার আনুুষ্ঠানিক বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের ঘোষণা দেন। এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লাল এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। আমাদের প্লেন তিনখানা অস্ত্রসজ্জিত করার কাজ শুরু হলো। কাজগুলো করলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রকৌশলীরা। ডাকোটা প্লেনখানা এক হাজার পাউন্ডের পাঁচটি বোমা বহনের উপযুক্ত করা হলো। সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ একে খন্দকার আবার ডিমাপুর এলেন। অক্টোবর মাসের ৩০ বা ৩১ তারিখ সন্ধ্যার পর তিনি ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত এবং আমাকে আলাদা আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে ঢাকায় অভিযান করতে হবে বলে ব্রিফ করলেন। ব্রিফিংয়ের সময় খন্দকার সাহেব আমাকে বললেন ২ অক্টোবর সকাল দশটায় আমরা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডাকোটা প্লেনখানা নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে কৈলাস শহর বিমানবন্দরে যাব। দুই তারিখ ভোর তিনটায় সেখান থেকে গিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরের ওপর পাঁচ হাজার পাউন্ড বোমাবর্ষণ করে ফিরে আসব। তিনি বার বার বলছিলেন, এই অপারেশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আমরা পাকিস্তানীদের এ্যাকশনের গোলাবর্ষণের সম্মুুখীন হতে পারি। তোমরা এই অভিযানে যেতে ভয় পেলে এখনই বলে দাও। কাউকে জোর করে পাঠানো হবে না। আমি বললাম, আমি যাব। আমার মনে হয় মুকিতও একই কথা বলেছিল। ১ সেপ্টেম্বর জোরহাটে আমাদের ডেকে নিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং (মহাধার চক্র) আবার ঢাকা অভিযানের বিষয়ে ব্রিফ করলেন। ২ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত এবং আমি কৈলাস শহর যাত্রা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষমাণ ছিলাম। খন্দকার সাহেব এবং অন্যরা আমাদের বিদায় জানাবার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। বেলা সাড়ে দশটায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডাকোটা প্লেনখানা নিয়ে চন্দন সিং এবং সঞ্জয় কুমার এলেন। চন্দন সিং খন্দকার সাহেবের কাছে দিল্লী থেকে পাঠানো একটি টেলেক্স বার্তা দিলেন। ওই বার্তায় লেখা ছিল-ডাকোটা প্লেন দিয়ে ঢাকায় অভিযান ক্যান্সেল করা হয়েছে। ডাকোটা প্লেনখানা নিয়ে আমরা যেন কলকাতার কাছে ভারতীয় বিমান ঘঁটি ব্যারাকপুরে যাই। লেখাটা শেষ করার আগে ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন বীরউত্তমকে একটু হাইলাইট করতে চাই- ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন ছিলেন একহারা শরীরের ছয়ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার সুদর্শন পুরুষ। আগরতলায় থাকাকালে একদিন প্রবাসী সরকারের প্রধান রকিব সাহেবের অফিসে সরফুদ্দিন, শাহাব এবং আমি একত্রে গেলাম। ওই অফিসে মাহবুব আলম চাষী উপস্থিত ছিলেন। চাষী এক সময় অহঙ্কার করে বললেন, তিনি তখনকার সময় মাসিক ১৮০০ টাকা বেতন পেতেন। এত বেতন পাওয়া কেউ বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করতে ভারতে এসেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি আমার পাশে বসে থাকা ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিনকে দেখিয়ে বললাম, সে সাড়ে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতন পেত। তা ছেড়ে দিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে। সরফুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিল, তার কোন তুলনা নেই। তাই সে বীরউত্তম উপাধি লাভ করেছিল। লেখক : বীরপ্রতীক, সাবেক বৈমানিক ও মুক্তিযোদ্ধা
×