ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহা. ইকবাল আজাদ

টিএসসিতে এখন নীরবেই কাটে দিন

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

টিএসসিতে এখন নীরবেই কাটে দিন

বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলনায়তন কেন্দ্র আছে। যা টিএসসি নামে পরিচিত। টিএসসি বলতেই সাধারণ মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকে চিনেন। পাবলিক প্লেস বলে অনেকেই অবসরে টিএসসিতে বেড়াতে আসেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ফিরেন প্রাণের ক্যাম্পাসের খোঁজ-খবর নিতে কিংবা প্রিয়জনকে নিজের বিদ্যাপীঠ দেখাতে। কেউ বা আসেন আড্ডা দিতে। গিটার কাঁধে করিডরে বসে গলা ছেড়ে গান ধরেন ছোট্ট দলের শখের শিল্পীরা। সন্ধ্যা বেলায় চায়ের কাপের ঝনঝনানিতে টিএসসি যেন এক ভিন্ন পরিবেশ! কাস্টমার সামলাতে হিমশিম খান স্বপন মামা। মুখ বন্ধ করে হাত চালাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভাসমান চা বিক্রেতারা। বাদামওয়ালাকে ‘বাদাম, বাদাম’ বলে চিৎকার করতে হয় না। গ্রাহকই এদিক সেদিক থেকে ডেকে নেন। মানুষের কলরব আর যান্ত্রিক কোলাহলে প্রতিনিয়ত মুখর হয়ে উঠে টিএসসির পরিবেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলার দিন কিংবা কোন গানের আসরে টিএসসিতে বসে উল্লাসের কলরব। শেষ কবে টিএসসিতে একত্রে মানুষ হেসেছিল, আনন্দ-উল্লাসে করেছিল? মনে পড়ে সেসময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের উত্তরের বাতাস তখনও পুরোপুরি কাটেনি। বাতাসের শাঁই-শাঁই শব্দের মতো করে সেদিন যেন মানুষ বাড়ছিল টিএসসি চত্বরে। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরাও এসেছিল টিএসসিতে। রিক্সাওয়ালা মামা নিজের আয়ের বাহন থামিয়ে দাঁড়িয়েছিল পায়রা চত্বরে। ভাসমান চা বিক্রেতা পা থামিয়ে জড়ো হয়েছিল লোকের লোকারণ্যে। সবার চোখ আলাদা করে সাজানো সামনের বড় পর্দায়। বাংলাদেশ বনাম ভারতের বিশ্বকাপের ম্যাচ চলছে। দেশের খেলা হলে টিএসসিতে প্রায়ই বড় পর্দায় খেলা প্রদর্শন করা হয়। তবে খেলাটা ফাইনাল ম্যাচ বলেই হয়তো লোকের এত আগ্রহ, এত আগমন। বাংলাদেশ কখনোই কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে পারেনি। এবার যুবারা সেটা করে দেখিয়েছে। পায়রা চত্বরে মানুষ গিজগিজ করছে। দাঁড়ানোর মতো উপযুক্ত জায়গা নেই। মাঠে ব্যাট চালানোরও উপযুক্ত জায়াগা পাচ্ছেন না ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। শরিফুলের প্রথম ওভারে জাশওয়ালের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে হাসির ঝিলিকের দেখা মেলে দর্শকদের অবয়বে। দ্বিতীয় ওভারে ক্ষ্যাপাটে সাকিবের ব্যাটসম্যানের দিকে বল থ্রোতে চিৎকার করে উঠে কয়েকজন। শেষ কয়েক বছর ভারতের সঙ্গে বার বার পরাস্ত হয়ে বাংলাদেশীদের যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। হাসতে গিয়েও কয়েকবার মুখ বুঁজেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তাই ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দিতে পেরে দর্শকরাও আনন্দ কুড়ায়। আনন্দের ভাগ নিতে পথশিশুরা সবার সামনে জায়গা নেয়। ভাসমান দোকানদার লোকারণ্যে আশ্রয় নেয়। রিক্সাওয়ালা মামারা যাত্রী না খুঁজে জয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। গামছা দিয়ে মুখটা মুছে তারাও গলা মিলিয়ে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে উঠে। বাংলাদেশী বোলারদের তোপে একে একে সব উইকেট হারায় ভারত। হাততালি আর চিৎকারে মুখরিত হয় টিএসসি। খেলায় বিরতি আসে। লোকের ভিড় ভাঙতে শুরু করে। স্বপন মামা সরব হয়ে উঠে। চায়ের ক্রেতা বাড়ে। মুখে মুখে ক্রিকেটের আলোচনা হয়। আকবরদের প্রশংসা হয়। চায়ের কাপে চামচের টুং টাং শব্দে কখন যেন বিরতির সময় মিলিয়ে যায়, বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। পথশিশুদের কেউ যেন চিৎকার করে উঠে, খেলা শুরু হয়েছে। পায়রা চত্বরে আবার ভিড় বাড়ে। কাজকর্ম বন্ধ করে লোকেরা থমকে দাঁড়ায়। কেউ সামনের চেয়ারে আরাম করে বসে। কেউ বা জায়গা খুঁজে দাঁড়িয়ে যায়। বাদাম বিক্রেতা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। খেলাতে মনোযোগ দিতে গিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছে তার অবয়ব। সবার মুখে আর অন্তরে এক কথা বাজে, ‘আজকে ভারতকে হারাতেই হবে।’ খোলা জায়গায় সাঁটানো বড় পর্দায় খেলোয়াড়দের বাস্তব মনে হয়। তামিম-ইমনরা যেন পায়রা চত্বরেই খেলছেন। চার-ছক্কা মারছেন। বিনা উইকেটে দলের এক চতুর্থাংশ রান চলে আসে। লোকেরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। রিক্সাওয়ালা মামা দলের জয়ে ফ্রি তে ক্যাম্পাস ঘুরানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। ফুল বিক্রেতা সস্তায় ফুল বিক্রির ঘোষণা শোনায়। কিন্তু হঠাৎ যেন সব এলোমেলো হয়ে উঠে। খেলার মাঠে যেন এক দেত্যের আবির্ভাব ঘটে। ৫০ রানে বিনা উইকেটের বাংলাদেশ ৬৫ রানে চার ব্যাটসম্যান হারিয়ে বসে। ওপেনার ইমন পায়ের ব্যথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে যায়। দলের ব্যর্থতায় মলিন হয়ে উঠে রিক্সাওয়ালার মুখ। ভারতের সঙ্গে পুনরায় হেরে যাওয়ার ভয় জেগে ওঠে দর্শকমনে। মৌসুমী দর্শক এলোপাতাড়ি বকতে থাকে ক্রিকেটারদের। সরব টিএসসি হুট করে নীরব হয়ে উঠে। ক্রিকেটপ্রেমীদের অন্তরে কালো মেঘ জমতে শুরু করে। চায়ের কাপের চা জুড়িয়ে যায়। সবাই খেলার শেষ নাটক দেখার অপেক্ষায়। দেশের ক্রিকেটাররা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দৈত্যরাজ বিঞ্চুকে অধিনায়ক আকবর দেখে শুনেই খেলছেন। এক, দুই করে রান নিচ্ছেন। ধৈর্যশীল খেলোয়াড়ের পরিচয় দিচ্ছেন। সহসা কমেন্টারের উচ্চ শব্দে প্রকম্পিত হয় স্পীকার বক্স। আকবরের ব্যাটে বল আছড়ে পড়ে বাউন্ডারির ওপারে। দর্শকরা আকবরের খেলায় ভরসা পায়। কিন্তু বিপরীত ব্যাটসম্যানদের খামখেয়ালিতে আশা হারায়। ওপেনার ইমন যখন আবার পা খুঁড়িয়ে মাঠে নামেন তখনও বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের ৭৬ রান প্রয়োজন। সময়ের ব্যবধানে ইমনও হারিয়ে যান। দর্শকেরা দ্বিধায় ভুগেন। হতাশায় মাথা হেঁট করে বসেন। আআত্মবিশ্বাসকে উজ্জীবিত করতে কে যেন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে উঠেন। মাঠে দায়িত্ব নেন অধিনায়ক আকবর আলী। বুক চিতিয়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায়। সোহরাওয়ার্দী থেকে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ভেসে আসে। শব্দের প্রতিধ্বনি যেন পৌঁছায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। আকবরের সঙ্গে যোগ দেয় রাকিবুল। মাঝে বৃষ্টি আসে। সমীকরণ সহজ হয়ে উঠে। বিশ্বকে বাংলা চেনাতে আর সাত রানের প্রয়োজন। ‘ভাইয়া, পারবে তো বাংলাদেশ?’ পথশিশুর এই প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে উঠে এক শিক্ষার্থীর কণ্ঠ। অতীতের পরাজয়ের ভীতি হানা দেয় সুখের দরজায়। দুশ্চিন্তায় রিক্সাওয়ালা গামছা দিয়ে বারংবার কপাল মুছে। কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন প্রার্থনা করে। বাদামওয়ালা দু-হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার ভরসা কামনা করে। সোহরাওয়ার্দী থেকে আবার যেন হুংকার আসে। কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। টিএসসি পুনরায় সরব হয়। আকবর সিঙ্গেল নেয়, রাকিবুল বাউন্ডারি মারে, ম্যাচ সমতায় আনে। দর্শকরা যেন প্রাণ ফিরে পায়। রিক্সাওয়ালা মিটমিট করে হাসে। বাদামওয়ালা মুখে মেঘ কেটে আলো ছড়ায়। অন্যদের দেখে পথশিশুরা আড়মোড়া ভাঙে, উৎসবের প্রস্তুতি নেয়। চার ওভারে প্রয়োজন মাত্র এক রান। বোলার বল ছুড়ে, রাকিবুল পুল করে রান নিতে দৌড়ায়। সম্পন্ন হতেই যেন টাইগারদের মাঝে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। দর্শকদের চিৎকারে টিএসসি কেঁপে ওঠে। উৎসব মিছিলে সবাই রাজু ভাস্কর্যে দৌড়ায়। রিক্সাওয়ালার কণ্ঠ আনন্দে ধরে আসে। যাত্রী নিয়ে ফ্রি রাইডে বের হয়ে যায়। ফুল বিক্রেতা বিনামূল্যে ফুল বিলায়। গ্রহীতা বিজয়ের আনন্দে দ্বিগুণ দাম দেয়। টিএসসি তার লালিত সন্তানদের আনন্দ চিৎকারে যেন মুচকি হাসে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেন আরেকটি বিজয়ের সাক্ষী হয়। তারপর থেকে হঠাৎ করে টিএসসি যেন একা হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সন্তানদের অভাবে নীরব, নিরুপায়। এখন আর তেমন লোকের সমাগম হয় না। শিক্ষার্থীরা মিছিলের বজ্রকণ্ঠে টিএসসিকে মাতিয়ে রাখে না। নিত্যকার সরব টিএসসি এখন নীরবেই দিন কাটায়।
×