ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্কা নেই খাদ্য নিরাপত্তায় ॥ বন্যার প্রভাব পড়বে না উৎপাদনে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

শঙ্কা নেই খাদ্য নিরাপত্তায় ॥ বন্যার প্রভাব পড়বে না উৎপাদনে

ওয়াজেদ হীরা ॥ করোনার মধ্যেই দেশের খাদ্য উৎপাদনে আঘাত হেনেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা। ভারি বৃষ্টি আর নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম, নষ্ট হয় লাখো কৃষকের ফসল। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন দফা বন্যায় ৩৭ জেলায় ১২ লাখের বেশি কৃষকের ক্ষতি হয় হেক্টরের পর হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। এর মধ্যে আউশ ধান, আমন ধানও রয়েছে। আর এতেই শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে। কিন্তু জনমনের সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যায় কিছুটা ক্ষতি হলেও কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে না উৎপাদনে। আর উৎপাদনে সরকার নির্ধারিত চালের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে বলে মনে করছেন। করোনার শুরু থেকেই বোরোর পর খাদ্য নিরাপত্তা মজবুত করতে আউশ-আমনে ব্যাপক গুরুত্ব দেয় সরকার। সাম্প্রতিক বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ আর প্রণোদনায় অন্যান্য ফসলে ঝুঁকছেন কৃষক। বন্যার কারণে এখন থেকেই রবি ফসলেও গুরুত্ব দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যে সারাদেশে গত কয়েক মাসের তিন দফায় বন্যায় ৩৭টি জেলায় সর্বমোট ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৫১ জন কৃষক। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ও তা মোকাবেলায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বন্যায় ক্ষতি হওয়া ফসলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ২১৩ হেক্টর জমির আউশ ধান, ৭০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমির আমন ধান। এর মধ্যে বোনা আমন বেশি এবং ৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমির আমন বীজতলা। টাকার হিসেবে আউশ ধান ৩৩৪ কোটি, আমন ৩৮০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও সবজির ক্ষতি হয়েছে ২৩৫ কোটি টাকার এবং পাটে ২১১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। জনকণ্ঠকে কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা দেশের মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কোন শঙ্কায় রাখতে চাই না। বন্যার যে ক্ষতি তা কাটাতেও নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ এর অধীন সকল কর্মকর্তা করোনা ঝুঁকির মধ্যেও অত্যন্ত সজাগ, সক্রিয়। যে কোন পরিস্থিতিতে আমরা কৃষকের পাশে থেকে দেশে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। আবার বন্যা না হলে, ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে কাটিয়ে উঠা যাবে এবং এই ক্ষয়ক্ষতিতে আমাদের খাদ্য উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব দুর্যোগ মোকাবেলা করে খাদ্য উৎপাদন ধারা অব্যাহত শুধু নয় বরং তা আরও বৃদ্ধি করার প্রত্যাশাও করেছেন কৃষিমন্ত্রী। এদিকে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্যমতে, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়েও নবেম্বর শেষে সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। সংস্থাটির মতে, করোনা হলেও খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই। কেননা কোভিড পরিস্থিতিতেও চালের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে মোট চালের অর্ধেকের বেশি প্রায় ৬০ ভাগ আসে এই বোরো আবাদ থেকে। আর বাকি ৪০ ভাগের মতো আসে আমন ও আউশ থেকে। খাদ্য সংগ্রহের বড় জোগান বোরো ধানে ভাল ফলন হয়েছে এবার। মূল্য ভাল পেয়ে কৃষকরা ঝুঁকেন আউশ-আমনে। ইতোমধ্যেই অনেক এলাকায় আউশ কাটার ধুম লেগেছে। হেক্টর প্রতি আউশে এবার ফলন ভাল হয়েছে। করোনা পরবর্তী দিনগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তায় আমনেও গুরুত্ব পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই পানি কমতে শুরু করায় তৈরি হওয়া আমন মাঠে লাগানো শুরু হয়েছে। কোথাও জমি প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। মাঠে মাঠে রোপা আমন লাগানোর হিড়িক পড়েছে। দেশের একাধিক জেলায় কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে রোপা আমন লাগানোর তথ্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইং থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্য থাকলেও এর চেয়ে বেশি জমিতে অর্থাৎ ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬৬ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ হয়। যা গত বছরের চেয়ে দুই লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ বেড়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন। আবার বন্যায় আউশে ক্ষতিগ্রস্ত জমি মাত্র ৩২ হাজার হেক্টর। সে হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত জমি বাদ দিয়েও অনেক বেশি জমিতে আউশ আবাদ হয়েছে। এদিকে, আউশের মতো এই বছর আমনেরও বাড়ানো হয়েছে জমি ও উৎপাদন লক্ষমাত্রা। কৃষি সম্প্রসারণের সরেজমিন উইং থেকে জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ মৌসুমে বোনা ও রোপা আমন মিলিয়ে মোট ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। যেখানে বোনা আমন ৩ লাখ ৩২ হাজার ৯১৫ হেক্টর আর বাকি ৫৫ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ হেক্টর হচ্ছে রোপা আমন। এতে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০২০ মৌসুমে বোনা ও রোপা আমন মিলিয়ে মোট ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। সবসময়ই রোপা আমন বেশি আবাদের লক্ষ্য রাখা হয়। রোপা আমনের মধ্যে হাইব্রিড ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে, উফসি ৪৫ লাখ ৪২ হাজার চারশ’ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ৮ লাখ ২১ হাজার তিনশ’ হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্য রয়েছে। বন্যায় রোপা আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর কিছু বোনা আমন ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে রোপা আমন লাগানোর প্রস্তুতি চলছে ব্যাপকভাবে। বোনা আমনের ক্ষতি কাটানো সম্ভব নয় বলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অন্য ফসলের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। আবার উৎপাদন ঠিক রাখতে আউশের সঙ্গে রোপা আমন সার্বিকভাবে উৎপাদন ধরে রাখতেও প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। কেননা, যেসব এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে সেসব স্থানে দ্রুতই রোপা আমন লাগানো হচ্ছে। যেখানে বীজতলা নষ্ট হয়েছে সরকার থেকে করা বীজতলা থেকে কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে আমন-আউশ মিলিয়ে চাল উৎপাদনের প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। বন্যায় কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি থাকলেও ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তা হিসেবে চাল নিয়ে কোন সমস্যাই হবে না বলে জানিয়েছেন কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান। কৃষি সচিব জনকণ্ঠকে বলেন, শাক-সবজির ক্ষতি হয়েছে নতুন করে আবাদ করতে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তবে আমাদের যেটা ক্ষতি হয়েছে সেটা বোনা আমন ও রোপা আমন বীজতলা এবং কিছু আউশ। আমরা বীজতলার ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছি। প্রায় ৫০ হাজার মতো হেক্টর জমির বোনা আমন ক্ষতি হয়েছে, কিছু রোপা আমন এবং বীজতলা। আমরা হিসেব করে দেখেছি বোনা আমন ও আউশ মিলিয়ে যদি দেড় লাখ মেট্রিক টনের কিছু কম বা বেশি চাল কম পেতে পারি। তবে এবার আমাদের আউশে আবাদি জমি বেশি হওয়াতে কোন সমস্যা নেই। বন্যায় ক্ষতি হলেও আবাদ বেড়ে যাওয়াতে আমাদের সুবিধা হচ্ছে। আউশের আবহাওয়া এবার শুরু থেকেই ভাল, ফলনও ভাল। শুধু আউশে দুই লাখ হেক্টর জমি বেড়েছে। এতে এবার হেক্টর প্রতি ফলনও অনেক ভাল। ফলে যেটি ক্ষতি হয়েছে বন্যায় সেটি উঠে আসবে ফলে কোন সমস্যা নেই। কৃষি সচিব বলেন, রোপা আমনের বীজতলার যে ক্ষতি সেটি আমরা এবং কৃষকরা পুষিয়ে দিচ্ছি। আমরা কমিউনিটি বীজতলা করেছিলাম সেটি দিয়ে এখন লাগাচ্ছে। বোনা আমনের ক্ষতিটা যদি বলি তাহলে এর ফলন হয় সাধারণত হেক্টরে দেড় টন। আউশ ফলন হয় আড়াই টন হেক্টরে। বন্যায় ক্ষতি না হলে প্রচুর আউশের ফলন পেতাম। আমরা হিসেব করে দেখেছি টার্গেট ছিল ফলন ২.৫ টন সেখানে কোথাও কোথাও তিন টন হচ্ছে হেক্টরে। রোপা আমন শতভাগ অর্জন হয় আবার লক্ষ্যমাত্রাও বেশি আছে। এবার বোরোতে ধানের দাম বেশি পেয়েছে ফলে কোথাও কৃষক জমি ধান আবাদে বাদ রাখবে না। সরকারের সহায়তা নিয় সচিব আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক কৃষকদের কেস স্ট্যাডি করে যে যা করবে তাদের পুনর্বাসন দেব। বড় ছোট কৃষক বাছাই না করে সবাইকে দেব। যেসব বীজ আছে রবিতে আমরা দেব। মাষকলাই বীজ অলরেডি দেয়া হয়েছে, খেসারিকলাই দেব, গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ দেব, মরিচের চারা দেব। আউশ-আমন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বন্যার প্রভাব কোন সমস্যায় ফেলবে না বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মহাপরিচালক ড. মোঃ আবদুল মুঈদ। ডিএই মহাপরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, দেখুন আমাদের এবার গতবারের চেয়ে দুই লাখের বেশি হেক্টর জমিতে আউশ আবাদ বেশি হয়েছে সেখানে বন্যার প্রভাব মাত্র ত্রিশ হাজার হেক্টরের একটু বেশি জমি। এবার আউশে ফলনও ভাল হয়েছে হেক্টর প্রতি। আবার বোনা আমনে ক্ষতি হলেও রোপা আমনে সেটি কাভার হয়ে যাবে কেননা রোপা আমনে লক্ষ্যমাত্রাও বেশি আছে। কৃষক ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকার তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করছে। তবে জাতীয়ভাবে সামগ্রিক অর্থে উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোন প্রভাব পড়বে না বরং বেশিই উৎপাদিত হবে আশা করেন তিনি। এর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক (সরেজমিন উইং) জানিয়েছেন, কৃষককে আউশের মতো আমন চাষে প্রণোদনা ও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা এসেছে। এ অবস্থায় করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সব ধরনের ফল-ফসলের আবাদ বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে আমরা কাজ করছি। সারা পৃথিবীতে যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে আমরা সেটিকে বিবেচনায় রেখেই কাজ করছি। ভাতের নিশ্চয়তা নিয়ে কোন শঙ্কা থাকছে না। এদিকে, শুরু থেকেই দেশে আমনের উৎপাদন বাড়াতে ১০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে এবার সরকারীভাবে আমন বীজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ১০ টাকা। এতে করে চলতি মৌসুমে সাড়ে ২০ হাজার টন আমন বীজ বিক্রি করতে সরকারকে বাড়তি প্রায় ২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। তবে কেজিতে ১০ টাকা করে সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ কমার আমনের উৎপাদনও বাড়বে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সকলেই ছিলেন সতর্ক। ফসলের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য কৃষককে দেয়া হয়েছিল প্রয়োজনীয় পরামর্শ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় বীজ, সারসহ বিভিন্ন প্রণোদনামূলক কার্যক্রম বেগবান, তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ও যুগ্ম-সচিবদের নেতৃত্বে ১৪টি কমিটিতে ৭০ জন কর্মকর্তা কাজ করছেন বলে জানা গেছে। বন্যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ক্ষতি পুষিয়ে যেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সেজন্য বিভিন্ন প্রণোদনার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ইতোমধ্যে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩১ জন ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এর আওতায় স্বল্পমেয়াদী ও মধ্যমেয়াদী বিভিন্ন শাকসবজি চাষের জন্য প্রায় ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫২ হাজার কৃষককে লালশাক, ডাটাশাক, পালং শাক, বরবটি, শিম,শসা, লাউবীজ ইত্যাদি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ভিত্তিক বীজতলার মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, প্রায় ৭০ লাখ টাকার ভাসমান বেডে এবং ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে রাইস ট্রান্স প্লান্টারের মাধ্যমে রোপণের জন্য আমন ধানের চারা উৎপাদন/বীজতলা তৈরি ও বিনামূল্যে বিতরণ কাজ চলছে। ৩৫ জেলায় ৫০ হাজার কৃষককে তিন কোটি ৮২ লাখ টাকার মাষকালাই বীজ, ডিএপি, এমওপি সার বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেছেন, প্রায় ৭৫ কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচী প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ অর্থ দিয়ে ৯ লাখ ২৯ হাজার ১৯৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক কৃষককে গম, সরিষা, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী, খেসারি, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ইত্যাদি ফসল আবাদের জন্য বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হবে। মন্ত্রী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারিবারিক কৃষির আওতায় সবজি-পুষ্টি বাগান স্থাপন কর্মসূচীর আওতায় ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬৪ জেলায় মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ জন কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ/ চারা ও সার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, প্রকৃতির ঝুঁকিকে আমরা ইচ্ছে করলেই এড়াতে পারি না। এটা বিবেচনায় রেখেই আমরা আশা করছি (এই বন্যার ফলে) সার্বিকভাবে দেশে খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না এবং আমরা বড় কোন সঙ্কটে পড়ব না। মন্ত্রী বলেন, বাংলার কৃষকসহ এ দেশের মানুষ সরকারের সহযোগিতায় মহামারী করোনা, সুপার সাইক্লোন আমফান, চলমান দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আবার তারা ঘুরে দাঁড়াবে, সামনে এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষিবান্ধব সরকার সবসময় কৃষকদের পাশে আছে, অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। চালের মজুদ নিয়ে নিজস্ব জরিপ গবেষণার বরাতে ব্রি মহাপরিচালক শাহজাহান কবীর বলেছেন, নবেম্বরের মধ্যে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হলে বাংলাদেশে আপাতত খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা থাকবে না। ব্রি গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গতবছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০.৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নবেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানোর পরেও ৫.৫৫ মিলিয়ন টন চাল দেশের অভ্যন্তরে উদ্বৃত্ত থাকবে। নবেম্বর পর্যন্ত ১৬.৫০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটানোর পরেও ৩৬-৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া, নবেম্বরের মধ্যে দেশের ফুড বাস্কেটে নতুনভাবে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হবে। ২০১০ সালে যেখানে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বর্তমানে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, গবেষণা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল একটি অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় মাইলফলক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
×