ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীও চলে গেলেন

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীও চলে গেলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শনিবার সকাল ৮টায় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ও সামাজিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। আবু ওসমান চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তার স্মৃতিশক্তিও ক্রমে লোপ পাচ্ছিল। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর ৩০ আগষ্ট অসুস্থ অবস্থায় তাকে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষার পর তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর মধ্যে তার ব্রেন টিউমারও ধরা পড়ে। হাসপাতালে ভর্তির আগে সপরিবারে তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির বাসায় থাকতেন। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম জেমস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শনিবার বাদ আছর সেনানিবাসে সেনাকুঞ্জের পাশে সেন্ট্রাল মসজিদে আবু ওসমান চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বনানী সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। শনিবার এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আবু ওসমান চৌধুরীর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রপতি মরহুম আবু ওসমান চৌধুরীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আবু ওসমান চৌধুরীর বীরত্বপূর্ণ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে এই বীর সেনানীর অনবদ্য ভূমিকা সবসময় আমাদের প্রেরণা জোগাবে। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়াও শোক প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবু ওসমান চৌধুরী। ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৬০ সালে কুমিল্লার মৌলভীপাড়ার মনসুর আহম্মেদের বড় মেয়ে নাজিয়া খানমের সঙ্গে আবু ওসমানের বিয়ে হয়। তাদের দুই মেয়ে নাসিমা ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে আবু ওসমান পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয় সেই খবর আবু ওসমান পান কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে বসে। সে সময় তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চতুর্থ উইংয়ের কমান্ডার হিসেবে চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বে ছিলেন। পরদিন সকালে তিনি কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে একদল সৈনিককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে তাকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তার স্ত্রী নাজিয়া খানমও সে সময় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খাবার, পানীয় ও টাকা-পয়সা পৌঁছে দেয়া এবং প্রয়োজনে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দেয়ার মতো কাজ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে আবু ওসমান চৌধুরী এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবু ওসমান চৌধুরীকে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের সময় একদল সেনা সদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে হামলা করে। বাড়িতে না থাকায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তার স্ত্রী নাজিয়া খানম। পরবর্তী সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তার মৃত্যুতে গত ১১ দিনে মুক্তিযুদ্ধের দু’জন সেক্টর কমান্ডারকে হারালো দেশের মানুষ। এর আগে ২৫ আগস্ট মারা যান মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবু ওসমান চৌধুরীকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান করা হয়। স্বাধীনতা পুরস্কার জয়ী মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী চাঁদপুর জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতি চিরদিন তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে। তিনি মরহুম আবু ওসমান চৌধুরীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুম আবু ওসমান চৌধুরীর আত্মার শান্তি ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ ছাড়াও শোক প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাবউদ্দিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি প্রমুখ।
×