ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি ॥ দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি ॥ দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

গাফফার খান চৌধুরী/মোঃ খলিলুর রহমান ॥ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে ২১ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে। নিহতদের দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে বিশ হাজার এবং চিকিৎসাধীনদের দশ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। মারাত্মক দগ্ধ আরও ১৬ জন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। নিহতদের পরিবারের চাহিদা মোতাবেক পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা; তা তদন্ত শেষে জানা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ ও মুসল্লিদের দাবি, মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের লাইন লিক হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গ্যাস বেরুচ্ছিল। জমে থাকা গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মেম্বার দাবি করেছেন, ৮ থেকে ৯ দিন ধরে মসজিদের গেটের সামনে থেকে গ্যাসের বুদবুদ বের হচ্ছিল। তা মেরামত করতে তিতাসের লোকজনকে এবং ঠিকাদারকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করা হয়। তারা ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। সেই টাকা যোগাড় করতে না পারায় আর গ্যাসের ত্রুটি মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তারই জেরে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় মসজিদের ছয়টি এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র) একসঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে মসজিদের ভেতরে আগুন ধরে গেলে ৪০ মুসল্লি দগ্ধ হন। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও মসজিদ কমিটির তরফ থেকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই, সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা। এমন মর্মাতিক মত্যুর ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। তাঁরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। আর চিকিৎসাধীনদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। দগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন। এমন ঘটনার পর সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুত সংযোগ ও এসিসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সার্বিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। যেখানে ঘটনাটি ঘটে ॥ শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে দোতলা মসজিদটিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুসল্লিদের দাবি, মসজিদটিতে দুই থেকে আড়াইশ’ মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। কিন্তু এশার নামাজের সময় স্বাভাবিক কারণেই মুসল্লির সংখ্যা কম থাকে। এমনিতেই মুসল্লি কম, তার ওপর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছিলেন। সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ মুসল্লি ছিলেন। এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ আদায় করার পর অনেক মুসল্লি চলে যান। এর পর যে যার মতো সুন্নত ও বেতের নামাজ আদায় করছিলেন। ঠিক তখনই বিকট শব্দে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এতে ৪০ জনের মতো দগ্ধ হন। তারমধ্যে ৩৭ জনকে রাতেই পোড়া রোগীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বাকি তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। হতাহতদের সম্পর্কে ডাঃ সামন্ত লাল সেনের বক্তব্য ॥ দগ্ধরা চিকিৎসাধীন থাকা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক দেশের খ্যাতিমান পোড়া রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জনকণ্ঠকে জানান, শুক্রবার রাতেই ৩৭ জনকে ভর্তি করা হয়। শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত তার মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের বাঁচানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। চিকিৎসাধীনরা জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। নিহতদের পরিচয় ॥ শিশু জুয়েল (৭), রিফাত (১৮), মোস্তফা কামাল (৩৪), জুবায়ের (১৮), সাব্বির (২১), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), হুমায়ুন কবির (৭০), ইব্রাহিম (৪৩), মসজিদের মোয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৮), জুনায়েদ (১৭), জামাল (৪০), রাসেল (৩৪), জয়নাল আবেদিন (৪০), মাইনুদ্দিন (১২), নয়ন (২৭), রাসেল (৩০), কাঞ্চন হাওলাদার (৫৩) ও বাহার উদ্দিন (৫৫), আব্দুল মালেক (৬০), মিজান (৩৪), স্থানীয় ফটোসাংবাদিক নাদিম (৪৫)। দগ্ধ চিকিৎসাধীনরা হচ্ছেন ॥ শেখ ফরিদ, মনির, আবুল বাশার মোল্যা, শামীম হোসেন, ফরিদ আক্তার, নজরুল ইসলাম, রিফাত, আব্দুল আজিজ, মোঃ কেনান, হান্নান, সাত্তার, জুলহাস, আমজাদ, মামুন ও ইমরানসহ ১৬ জন। সরকারী খরচে দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক সরকারী খরচে দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে। তাদের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজখবর রাখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ূয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানসহ সংশ্লিষ্টরা হতাহতদের দেখতে যান। তারা চিকিৎসাধীনদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলেন। হতাহত ও লাশ হস্তান্তরের তথ্য পেতে হটলাইন চালু ॥ বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের সম্পর্কে তথ্য পেতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একটি জরুরী সহায়তা কেন্দ্র বা হটলাইন খোলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়। হতাহতদের স্বজনরা সহায়তা কেন্দ্র থেকে সব ধরনের তথ্য ও সহযোগিতা পাবেন। এছাড়া লাশ হস্তান্তরের জন্য স্বজনদের ০১৭৩২-৮৯২-১২১ নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। পশ্চিম তল্লার ঘরে ঘরে কান্নার রোল ॥ পশ্চিম তল্লা এলাকায় ঘরে ঘরে চলছে শোকের মাতম। নিহত রিফাতের (১৮) মা রিনা আক্তার বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। অনবরত কাঁদছিলেন বড় দুই বোন ডলি আক্তার ও পলি আক্তার। ডলি আক্তার বলেন, আমার ভাইয়ে তো খারাপ কোন কাজ করতে যায়নি। মসজিদে গিয়েছিল নামাজ পড়তে। ওই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল দুই সহোদর সাব্বির (২১) ও জুবায়েদ (১৮)। বিস্ফোরণে দগ্ধ দুজনের কেউই বেঁচে নেই। মা পারুল বেগম মৃত ছেলেদের পাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। তাদের বাড়িওয়ালি নূরজাহান জানান, সাব্বির নারায়ণগঞ্জ কলেজে বিবিএ পড়ছিল এবং জুবায়েদ সরকারী তোলারাম কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা পারুল বেগম আরবী ভাষা শিক্ষা দিয়ে সংসার চালাতেন। বিস্ফোরণ হওয়া ওই মসজিদের পেছনে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন ব্যবসায়ী কুদ্দুস বেপারি (৭২)। নিয়মিত ওই মসজিদে নামাজ পড়তেন তিনি। শুক্রবার এশার নামাজও সেখানেই পড়ছিলেন। বিস্ফোরণে তার শরীরের অধিকাংশ পুড়ে যায়। রাতেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। কুদ্দুস বেপারির নাতি মাসুম বলেন, নিয়মিত ওই মসজিদে নামাজ পড়তেন। মুরব্বি মানুষ তাই মসজিদ থেকে দেরিতেই বের হতেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি মসজিদের ভেতরেই নামাজ পড়ছিলেন। একই এলাকার হমায়ুন কবীর (৭০) বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা যান। কাজ করতেন গ্রামীণ ডায়িং কারখানায়। ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে রয়েছে। তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। হুমায়ুন কবিরের আয় দিয়েই পুরো সংসার চলত। হুমায়ুন কবীরের মেয়ে রাবেয়া কাঁদছে আর বলছে আমার বাবা কোথা গেলো। কেন আমার বাবারে আল্লাহ নিয়া গেল। নিহত হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী ছালেহা বেগম বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। হুমায়ুন কবীরের মেয়ে রাবেয়া বার বার বলছিলেন, এখন আমাদের সংসার কিভাবে চলবে। আমার বাবা নেই আমরা মানতে পারছি না। নিহত হুমায়ুনের পরিবার জানান, যাদের গাফলতিতে এ ঘটনা ঘটেছে তাদের বিচার দাবি করছি। এ মসিজদের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আল-আমিন বলেন, যদি জুমা নামাজের সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত তবে পুরো এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়ত। আবার যদি এশার নামাজের ফরজ আদায়ের সময় বিস্ফোরণ ঘটত তা হলে এক থেকে দেড়শ’ লোক হতাহত হতো। পশ্চিম তল্লায় উড়ছে কালো পতাকা ॥ দ্বিতীয় তলাবিশিষ্ট মসজিদের নিচ তলায় বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় পুরো পশ্চিম তল্লা ও আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এলাকাবাসী ও স্বজনহারাদের আর্তনাদে এলাকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। শুধুই কান্নার শব্দ। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা লোকজনের চোখে-মুখে বিষাদের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। এলাকার অনেকেই ইতোমধ্যে কালোব্যাজ ধারণ করেছেন। অনেক বাড়ির গেটে কালো পতাকা সাঁটানো হয়েছে। এলাকার আসিফ হোসেন বলেন, এ ঘটনায় দুঃখ জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা এ ঘটনায় মর্মাহত। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা আল্লাহর ঘরে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। মসজিদে এভাবে মানুষকে জীবন দিতে হবে জানতাম না। বিস্ফোরণের আগে এশার ফরজ নামাজ আদায় করেই মসজিদ থেকে বের হয়ে আসেন বজলুল হক। তিনি বলেন, আমি দোকান খুলতে তাড়াতাড়ি করে মসজিদ থেকে বের হয়ে এসেছি। কয়েক মিনিট পড়েই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এতে আমি রক্ষা পেয়েছি। গ্যাস লাইনের মেরামত করতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি ॥ গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকেই জমে থাকা গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদ কমিটির লোকজন। বিস্ফোরণে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। দগ্ধ হন মসজিদের ৪০ মুসল্লি। মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মেম্বার বলেন, ৮/৯ দিন ধরে মসজিদের গেটের সামনে থেকে গ্যাসের বুদবুদ বের হতো। তা মসজিদের ভেতর পর্যন্ত চলে আসত। মুসল্লিরা গ্যাসের গন্ধ পেতো। এক সপ্তাহ আগে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি তিতাসের লোকজনকে এবং ঠিকাদারকে মৌখিকভাবে গ্যাস মেরামতের জন্য বলেছিলেন। তারা ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। সেই টাকা যোগাড় করতে না পারায় আর গ্যাসের ত্রুটি মেরামত সম্ভব হয়নি। তিনি দাবি করেন, তিতাসের গাফলতির কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে। নিহতের স্বজনরাও অভিযোগ করেন, গ্যাসের লিকেজ থেকেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ॥ নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি শনিবার থেকেই কাজ শুরু করেছে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববিকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, নারায়ণগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এ টি এম মোশাররফ হোসেন, ডিপিডিসি’র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার (পূর্ব) গোলাম মোর্শেদ, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জ জোনের ম্যানেজার মফিজুল ইসলাম। কমিটির আহ্বায়ক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বার্তা বলার পর তাদের বরাত দিয়ে জানান, মজিদের ভেতর দিয়ে তিতাস গ্যাসের সংযোগ লাইন গেছে। সেখান থেকে লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হচ্ছিল। আবার অনেকেই বলেছেন, ঘটনার সময় একবার বিদ্যুত গিয়েছিল। মিনিটপাঁচেক পরেই বিদ্যুত আসে। বিদ্যুত আসার পর পরই বিকট শব্দে এসিগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। মূলত গ্যাস ও বিদ্যুত সংযোগের বিষয়কেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত চলছে। তারা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যেই রিপোর্ট দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের প্রতিটি পরিবারকে লাশ দাফনকাফনের জন্য ২০ হাজার ও আহতদের চিকিৎসা বাবদ প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তিতাস গ্যাসের তদন্ত কমিটি ॥ তিতাস গ্যাস কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আব্দুল ওহাবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুসল্লি ও মসজিদ কমিটির অভিযোগ, গ্যাস লিকেজের বিষয়ে বহুবার অভিযোগ করা হলেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তা আমলেই নেয়নি। তারই জেরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোহাম্মদ মামুন জানান, গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আমি ও তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। দুর্ঘটনাটি তিতাস গ্যাসের কারণে হয়েছে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে বলা যাবে। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি ॥ সেবাদানকারী এই সংস্থাটির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপস) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি একসঙ্গে কেন ছয়টি এসিই বিস্ফোরিত হয়েছে তা তদন্ত করে দেখছে। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জানান, মসজিদে ছয়টি এসি ছিল। প্রাথমিকভাবে ছয়টি এসিই বিস্ফোরিত হয়েছে বলে জানা গেছে। কেন ছয়টি এসি একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলো তা তদন্ত করতেই মূলত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরণের সঙ্গে গ্যাস লিকেজ হওয়ার কোন সংযোগ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, বিস্ফোরণের পর তারা মসজিদে গ্যাস ডিটেক্টর দিয়ে ভেতরে প্রায় ৭০ ভাগ মিথেন গ্যাস থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। অন্যান্য সব বিষয় বিশ্লেষণ করে বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। এসি বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও এখানে গ্যাস পাইপ লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা বেশি। মসজিদের সামনে গ্যাসের লাইন লিকেজ এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে মসজিদের মেঝেতে পানি দেয়ার পর বুদবুদ উঠতে দেখা গেছে। এসির কারণে দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে থাকতে পারে। তবে মসজিদের ছয়টি এসিই একত্রে বিস্ফোরিত হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। তদন্ত শেষে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রসঙ্গত, বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জ স্টেশনের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরের সিলিং ফ্যানের পাখাগুলোও বাঁকা হয়ে গেছে। ভেতরে থাকা কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। নাশকতার আশঙ্কা আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমানের ॥ নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনাটি নাশকতার আশঙ্কা করছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি একেএম শামীম ওসমান। বিস্ফোরণের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ে তদন্তের দাবি করেছেন তিনি। তিনি বলেন, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বা এ সকল ঘটনা তদন্তে যারা অভিজ্ঞ তাদের ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হোক। কারণ গ্যাস জমে এসি বিস্ফোরণে ৪০ মানুষ পুড়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মসজিদের যেদিকে গ্যাসের লাইন সেদিকে খোলা বাতাস আছে। গ্যাস বাতাসে উড়ে যাবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্ত হয়েছে উল্টোটা। ১৩ জনের লাশ হস্তান্তর ॥ নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে শুক্রবার এশার নামাজ চলাকালে বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে ১৩ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একে একে লাশ এলাকায় আসতে শুরু করে। এ্যাম্বুলেন্সে করে আনা লাশগুলোগুলো তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের মধ্যে দুইজন কলেজ শিক্ষার্থী দুই ভাইও রয়েছেন। শনিবার রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত ৭ জনের লাশ দাফন করা হয়েছে এবং অপর লাশগুলো দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বজনরা। জানাজা ও দাফনে স্বজনরা ছাড়াও শত শত এলাকাবাসী অংশ নেন। পরে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও দগ্ধদের সুস্থতা কামনা করে দোয়া করা হয়। বিস্ফোরণে নিহত ও আহতরা অধিকাংশই নিম্ন পরিবারের ॥ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে শুক্রবার রাত পৌনে ৯টায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা যাওয়া ও দগ্ধদের মধ্যে অধিকাংশই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। বিস্ফোরণে মারা গেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোঃ ইব্রাহীম (৪৩) ও ড্রাইং কারখানার শ্রমিক হুমায়ূন কবির (৭০)সহ ১৮ জন। নিহত ইব্রাহীমের বড় ছেলে ফয়সালের সঙ্গে এশার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন তিনি। ছেলে ফয়সাল নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে এক শ’ গজ দূরে যান। এর মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। হঠাৎ তার বাবার কথা মনে পড়ে। দৌড়ে মসজিদের সামনে যান। ফয়সাল মসজিদের সামনে গিয়ে দেখেন মসজিদের থাইগ্লাস ভেঙ্গে আগুনের কুন্ডলী বের হচ্ছে। আগুনের কুন্ডলীর সঙ্গে মানুষও বের হয়ে আসছে। বার বার আগুনের কুন্ডলী বের হয়েছে। এরপর তার পিতা রাস্তায় পড়ে আছেন। দাড়ি, চুল, কাপড় সব পুড়ে গেছে। কিছু অবশিষ্ট নেই। দ্রুত তাকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান ছেলে ফয়সাল। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে যান। শনিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। চীনের শোক ॥ মসজিদে এসি বিস্ফোরণে মৃতদের স্মরণ করে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ঢাকার চীনা দূতাবাস। শনিবার দূতাবাসের এক বার্তায় শোক প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ সম্পর্কে জেনে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। প্রার্থনায় সমবেত ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাইদের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। যারা আহত অবস্থায় আছেন, সবার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। একইসঙ্গে বাংলাদেশের চীনা দূতাবাস শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনাও জানিয়েছে।
×