মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জ নগরীর পশ্চিম তল্লা এলাকায় একটি মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে অর্ধশত মুসল্লি দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধদের মধ্যে ৩৭ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের অধিকাংশের শরীরের ৬০ ভাগ পুড়ে গেছে। তবে কারও কারও শরীর ৯০-১০০ ভাগও দগ্ধ হয়েছে বলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মোঃ বাচ্চু মিয়া শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় নিশ্চিত করেছেন। বিস্ফোরণে মসজিদের ছয়টি এসি পুড়ে গেছে। থাই জানালার কাঁচ বিস্ফোরণে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে শত শত লোক ভিড় জমায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, রাত পৌনে নয়টার দিকে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের সময় ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ অর্ধশতাধিক মুসল্লি এশার নামাজ আদায় করছিলেন। বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরে থাকা সব মুসল্লি দগ্ধ হন। আগুনে তাদের শরীর ঝলসে যায়। দগ্ধ মুসল্লিরা দৌড়ে মসজিদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। তারা শরীরের আগুন নেভাতে সড়কে জমে থাকা পানিতে গড়াগড়ি করতে থাকে। বিস্ফোরণে মসজিদের ভেতরে থাকা ছয়টি এসি পুড়ে গেছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের ভেতরে থাই গ্লাস, জানালার কাঁচ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। মজিদের ভেতরে পানির সঙ্গে আহতদের রক্ত পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মসজিদের ভেতরে ফ্যান, বিদ্যুতের তার, প্যানেল বোর্ড পুড়ে গেছে। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আধা ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিস্ফোরণের মসজিদের ভেতরে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শত শত মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম এবং র্যাব ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ফজলুল হক ও সালাম মিয়া জানান, চার রাকাত ফরজ নামাজ শেষে অধিকাংশ মুসল্লি বেরিয়ে যান। সুন্নত ও বেতের নামাজের জন্য ৪০ থেকে ৫০ জন মুসল্লি মসজিদের ভেতরে ছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণে ওই মুসল্লিদের অনেকের শরীর আগুনে ঝলসে যায়। বিস্ফোরণে এসিসহ থাই জানালা, ফ্যান পুড়ে গেছে। এ সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী বজলুর রহমান বলেন, আমি এশার ফরজ নামাজ পড়েই মসিজদের পাশেই অবস্থিত দোকানটি খুলতে যাই। এ সময় হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে এসে দেখি মুসল্লিারা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পরে তাদের উদ্ধার করে লোকজন হাসপাতালে পাঠায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওই এলাকায় দীর্ঘ দিন গ্যাসের পাইপ লাইনের লিকেজ ছিল। ওই লিকেজ থেকে গ্যাস মসিজদের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি এর আগে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ করেন। তবে সরেজমিন গেলে অনেকেই বলেন, মসজিদ থেকে বুদবুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে। পানিতে মিশে আছে ঘটনায় আহতদের রক্ত। মসজিদজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানালার কাঁচ। মসজিদের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অংশের সঙ্গে বাইরের অংশ যে থাই গ্লাস দিয়ে আলাদা করা হয়েছিল সেটির ফ্রেম দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে। মসজিদের দেয়ালের কোন কোন অংশের টাইলস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়ে রয়েছে। অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে দগ্ধদের কাপড়। মসজিদের ছয়টি এসির একটিও অক্ষত নেই। প্রতিটিতেই বিস্ফোরণের চিহ্ন রয়েছে। মসজিদের ফ্যানগুলোর বেশির ভাগের পাখা-ই বাকা হয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের চিকিৎসক নাজমুল হোসেন জানান, হাসপাতালে নিয়ে আসা অন্তত ২০-২৫ জন দগ্ধ ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢামেকসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাই জরুরী ভিত্তিতে সরকারী-বেসরকারী ও ফায়ার সার্ভিসের এ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে দগ্ধদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন মোঃ ফরিদ, শেখ ফরিদ, মনির, মোস্তফা কামাল, রিফাত, মাইনুউদ্দিন, মোঃ রাসেল রাশেদ, নয়ন, বাসার মোল্লা, বাহাউদ্দিন, শামীম হাসান, জোবায়ের জয়নাল, মোহাম্মদ আলী সাব্বির, মোহাম্মদ আলী, মামুন, কুদ্দুস বেপারি, মোহাম্মদ নজরুল, সিফাত, আব্দুল আজিজ, নিজাম, মোঃ পেনান, নাদিম হুমায়ুন, ফাহিম, জুলহাস, ইমরান হোসেন, আব্দুস সাত্তার।
রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ বাচ্চু মিয়া বলেন, নারায়ণগঞ্জের দগ্ধদের মধ্যে ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। এদের প্রত্যেকের ৬০ ভাগ শরীর পুড়ে গেছে। তবে কারও কারও ৯০-১০০ ভাগও পুড়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের অবস্থা গুরুতর।
এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, বিস্ফোরণের মসজিদের ভেতরে ছয়টি এসি পুড়ে গেছে। মসজিদের ভেতরে থাকা সকল মুসল্লির শরীর ঝলসে গেছে। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আরেফিন বলেন, ওই মসজিদের সামনে তিতাস গ্যাসের পাইপ লাইনের গ্যাসের লিকেজ দেখতে পেয়েছি। প্রাথকিভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভেতরে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিস্ফোরণে অনেক দগ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম রাত পৌনে ১টায় বলেন, মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত দগ্ধ ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও কারও মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলাম বলেন, মসজিদের ভেতরে গ্যাসের কোন সংযোগ নেই। সেখানে গ্যাসের কানেকশন থাকলে তো মসজিদ করা হতো না। এর আগে তিতাস গ্যাসের লিকেজের বিষয়টি আমাদের কেউ জানায়নি। তবুও বিষয়টি জানার পর থেকে আমাদের তিতাস গ্যাসের একটি টিম কাজ করছে। আসলে কী তিতাসের লিকেজ হয়েছে কিনা? বিষযটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।