ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে স্থবিরতা

প্রকাশিত: ২২:১৮, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে স্থবিরতা

নিখিল মানখিন ॥ দেশের করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে করোনা মোকাবেলার নির্দেশনাসমূহ। নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিজেদেরই করে নিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বিধি-নিষেধসমূহ শিথিল করেছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও কঠোর বিধি-নিষেধ কার্যকর নেই। স্বাস্থ্যবিধি পালনসহ কিছু নির্দেশনা পালনের বিষয়টি বলবত রয়েছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে নেই কোন কর্তৃপক্ষ। ফলে করোনা পূর্বকালীন স্বাভাবিক সময়ের মতো চলাফেরা এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করছেন সাধারণ মানুষ। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় মনে হবে করোনার দিন শেষ হয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনও করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। করোনা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে বাংলাদেশ এখন বের হয়ে আসতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সারাদেশ করোনায় ছেয়ে গেছে। দৈনিক মৃত্যুহার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ধীরে ধীরে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটার পর তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই করোনায় জর্জরিত বিশ্বের অনেক দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে ব্যতিক্রম। এদেশে করোনার তাণ্ডব চলছে প্রায় ছয় মাস ধরে। ছয় মাসের প্রায় চার মাস ধরে দেশের করোনায় দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পৌঁছার পর প্রায় কাছাকাছি স্থানেই উঠানামা করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সীমিত নমুনা পরীক্ষার কারণে দেশের করোনার সার্বিক চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই দেশের করোনা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিধি-নিষেধসহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সরকার। পরবর্তীতে দেশের মানুষের জানমালের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একে একে প্রায় সব ক’টি বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা ছাড়া দেশের মানুষের জীবনযাত্রা যেন স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, মাস্ক পরিধান, অপ্রয়োজনে বাসার বাইরে না যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। শিথিল করা মানে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা নয়- এই নির্দেশনাটি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে ওই সব নির্দেশনা পালন না করার কারণে দেশে যেন করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থাৎ প্রতিদিনের কয়েক হাজার নতুন রোগী শনাক্ত এবং দৈনিক গড়ে ত্রিশজনের মৃত্যুর খবরও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সচেতন করে তুলতে পারছে না। করোনা প্রতিরোধ কমিটিসমূহের কার্যক্রমে স্থবিরতা ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিডিয়ায় দৈনিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো, সীমিত পরিসরে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা এবং সীমিত সংখ্যক করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান ছাড়া করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কমিটিসমূহের তেমন কার্যক্রম আর চোখে পড়ে না। বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত করোনা পরিস্থিতিকে হালকা করে তুলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। করোনা মোকাবেলা কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে গিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অকার্যকর হয়ে পড়ছে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম। মাঠ পর্যায়ের কমিটিগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পর্ক ও যোগাযোগ না থাকার অভিযোগ উঠেছে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে আলোচনা নেই। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অভিযান না চালানোর মনোভাবের বিষয়টিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সর্বশেষ উঠিয়ে দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক অনলাইন ব্রিফিং ‘হেলথ বুলেটিন’। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্তে অনাস্থা প্রকাশ করেছে চিকিৎসক সম্প্রদায়। জনবল পুনর্গঠনের বিষয়টি প্রশংসিত হলেও গত কয়েক সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বক্তব্য ও গৃহীত পদক্ষেপগুলো সমালোচনায় পড়েছে। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে গঠিত হয় জাতীয় করোনা প্রতিরোধ কমিটি। এই কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় পরবর্তীতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনা কমিটি গঠিত হয়। বর্তমানে ওই সব কমিটির দৃশ্যমান কর্মতৎপরতা নেই। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয় না। এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১৭ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন করে সরকার। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। আর গত ২৮ মার্চ ৮ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত হয় জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি। এই সব কমিটিরও কর্মতৎপরতা নেই। জনবল রদবদল ছাড়াও স্বাস্থ্য সেক্টরে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নতুন সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতে গিয়ে করোনা মোকাবেলায় গঠিত বিভিন্ন কমিটিসহ ইতোমধ্যে ঘোষিত কর্মসূচীসমূহ আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। করোনা পূর্বকালীন অবস্থা ॥ দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। স্বাস্থ্যবিধি না মানা লোকের চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি পালনকারী মানুষের সংখ্যা হিসাব করাটাই সহজতর হয়ে উঠেছে। করোনার মহামারীতেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগের পরিবেশ ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানসিকতা ও সচেতনতা অনেক আগেই উঠে গেছে। গত জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতেও একই চিত্র বেশ লক্ষ্যণীয়। খোদ রাজধানীতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, মুখে মাস্ক ব্যবহারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর সর্বত্র করোনাকালীন পূর্ব পরিবেশ বিরাজ করছে। ফুটপাথে জমে উঠেছে ভাসমান চা দোকানের ব্যবসা। চা দোকানগুলোর সামনে ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে বসে চা খাওয়ার ভিড়। বসার জায়গা না পেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন অনেকে। চা খাওয়ার অজুহাতে চলছে আড্ডা। নামমাত্র সামান্য পানিতে ধোয়া একই কাপ মিশে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের ঠোঁটে। চায়ের সঙ্গে চলছে সিগারেট। একই খোলা সিগারেটের প্যাকেটে হাত লাগাচ্ছে অনেক ক্রেতা। সিগারেট জ্বালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে একই লাইটার। একই সিগারেট কয়েকজনের মধ্যে ভাগভাগি করে খাওয়ার দৃশ্যও ফিরে এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই অপ্রয়োজনে বাইরে দলবদ্ধভাবে আড্ডা শুরু হয়ে গেছে। মাস্ক ছাড়াই কাছাকাছি, মুখোমুখি বসে যেখানে সেখানে আড্ডা জমিয়ে তুলছে। জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে এই চিত্র আরও সুস্পষ্ট। কারও কিছু বলার নেই। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন, এক সিটে একাধিক যাত্রী নেয়া, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রাখা, গাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার না করে বা হ্যান্ড গ্লাভস না পরে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে রাজধানীর অনেক গণপরিবহনে। অনেক সময় স্বাস্থ্যবিধিহীন পরিবেশ দেখেও যাত্রীরা পরিবহনে তুলতে হেলপারদের বাধ্য করান। রিক্সাচালকদের কারো মুখে মাস্ক নেই। যাত্রী সতর্ক না থাকলে চলন্ত অবস্থায় রিক্সাচালকের শ^াস-প্রশ^াস ও হাঁচি-কাশি অতি সহজেই যাত্রীকে আক্রান্ত করতে পারে। সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, কাঁচাবাজারসহ অলিগলির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দোকানগুলোতেও দেদারসে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা হচ্ছে। দোকানদার ও ক্রেতাদের অধিকাংশই মাস্ক পরে না। ক্রেতাদের মধ্যেও করোনা ভীতি আর নেই। অপেক্ষায় না থেকে আগে জিনিস কেনার জন্য এক ক্রেতা আরেক ক্রেতার মুখের কাছে হেলে গিয়ে পণ্য বাছাই করার দৃশ্য আজ যেন স্বাভাবিক ঘটনা। শাক-সবজির দোকানগুলোতে এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। আর এলাকার কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারগুলোর অবস্থা তো অনেকটা ভীতিকর। ঠেলাঠেলি ছাড়া বাজারের ভেতরে যাওয়া অসম্ভব বিষয়। তার ওপর আবার অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। এসব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় কার্যকর করা তো ভাবাই যায় না। সর্বশেষ গণপরিবহনে যাত্রী তোলার বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গণপরিবহনের চলাচল হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নির্ধারিত সিটের বাইরেও ঠেলাঠেলি করে যাত্রী উঠানো শুরু হয়ে গেছে। এমন পরিবেশে স্বাস্থ্যবিধি পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের মূল্য নিজেদেরই বুঝতে হবে ॥ বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ভার নিজেদেরই নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ মুস্তাক হোসেন। তিনি বলেন, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বিধি-নিষেধসমূহ শিথিল করেছে সরকার। করোনা সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে। করোনা প্রতিরোধের বিষয়সমূহও অজানা থাকার কথা নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিজেদেরই করে নিতে হবে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে সরকার। বিশ্ব ও দেশের করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমেও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও করোনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই সরকারী নির্দেশনাসমূহ পালনের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন দেশের মানুষ। শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা প্রতিরোধে দেশের প্রত্যেক মানুষকে আরও বেশি সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে করোনা মোকাবেলায় সফলতা বয়ে আনা সম্ভব নয়। একজন মানুষের জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্ত বিধি-নিষেধ ও নির্দেশনার মাধ্যমে মনিটরিং করা সম্ভব নয়। নিজেদের জীবনের মূল্য নিজেদেরই বুঝতে হবে।
×