ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী সরকার দেশী-বিদেশী অর্থের প্রবাহ বাড়বে

বিনিয়োগের নতুন নিরাপদ মাধ্যম মিউচুয়াল ফান্ড

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিনিয়োগের নতুন নিরাপদ মাধ্যম মিউচুয়াল ফান্ড

অপূর্ব কুমার ॥ বিশ্বব্যাপী নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের প্রথম পছন্দ মিউচুয়াল ফান্ড। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও স্বল্পপুঁজিতে টাকা খাটানোর সবচেয়ে সহজ উপকরণ হচ্ছে এটি। কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ড খাতটি পিছিয়ে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডের বিকাশের আরও সুযোগ রয়েছে। সরকারও দেরিতে হলেও মিউচুয়াল ফান্ড সেক্টরকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। সেক্ষেত্রে মেয়াদী-বেমেয়াদী সব ধরনের ফান্ডই নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে। ফান্ডগুলোকে জনপ্রিয় করার জন্য বাজেটে বিশেষ প্রণোদনাও দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ফান্ডগুলোকে কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড হলো পেশাদার ফান্ড ম্যানেজারদের দ্বারা নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত এমন একটি ব্যবস্থা যা ছোট ছোট বিনিয়োগকারী থেকে টাকা সংগ্রহ করার মাধ্যমে তার দ্বারা বড় পোর্টফোলিও বানিয়ে সেটি বহু সেক্টরে বিভক্ত করে বিনিয়োগ। যেহেতু অর্থনীতি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল বিষয় তাই পেশাদার ফান্ড ম্যানেজার ও তাদের গবেষকরা এই বিনিয়োগের পূর্বে অতীত ও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিসংখ্যান বিচারের নিরিখে এবং ভবিষ্যত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির বিচারের মাধ্যমে বিনিয়োগের কৌশল নির্ণয় করে থাকেন। যেহেতু বহু বিনিয়োগকারীর টাকা একত্র করে ও ভবিষ্যত মুদ্রাস্ফীতির সম্যক গণনার পর বিনিয়োগ করা হয় যার ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একক ঝুঁকির পরিমাণ অনেকাংশেই হ্রাস পায় যা বিনিয়োগে রাশির শ্রীবৃদ্ধির পথ সুগম করে তোলে । মিউচুয়াল ফান্ড হলো এমন এক ব্যবস্থা যা একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে ইক্যুইটি স্টক, বন্ড, কমোডিটি প্রভৃতি উপকরণে একত্রভাবে বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান করে ও তার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দামের ওপর লভ্যাংশের অংশীদার হতেও সাহায্য করে থাকে। মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো করে থাকে। এ ব্যবস্থায় যুক্ত সব এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে বাংলাদেশের আর্থিক বাজারের সর্বময় কর্তা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিবন্ধিকৃত হওয়া বাধ্যতামূলক। এসব এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বিনিয়োগকারী থেকে টাকা গ্রহণ ও তার বিনিয়োগ করার লাইসেন্সের অধিকারী হয়ে থাকেন। এ ব্যবস্থায় একজন বিনিয়োগকারীকে লগ্নিসংক্রান্ত কোন বিশ্লেষণেরই প্রয়োজন থাকে না। এসব দায়িত্ব এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে তার গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ফান্ড ম্যানেজার ও তার আর্থিক গবেষকরা করে থাকেন। করোনা আবহে বিনিয়োগের জায়গা কমে যাওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে মিউচুয়াল ফান্ডকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। সরকারী উদ্যোগের অংশ হিসেবে এখন থেকে বেমেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন দেশের বাইরে থাকা অনিবাসী বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে এই সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে অনিবাসী বিনিয়োগকারীদের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার জন্য অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিল বিএসইসি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বাড়াতে নিটা এ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় করা যাবে। এক্ষেত্রে ফান্ডটিকে বিএসইসির অনুমোদিত হতে হবে। অনিবাসীসহ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিপরীতে শেয়ার ইস্যুর ১৪ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগকে অবহিত করতে হবে। প্রযোজ্য কর পরিশোধ ও কর্তনের পর নিটা এ্যাকাউন্টে লভ্যাংশ আয়ের অর্থ জমা রাখা যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে নিটা এ্যাকাউন্টে মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট বিক্রির অর্থ জমা রাখা যাবে। যদি সংশিষ্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপক সাপ্তাহিক নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) প্রকাশের ক্ষেত্রে অধারাবাহিক হয় কিংবা অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে ৩০ শতাংশ বা এর বেশি বিনিয়োগ থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগে আবেদনপত্রসহ বিএসইসির লাইসেন্সপ্রাপ্ত মার্চেন্ট ব্যাংক কিংবা চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্টের মাধ্যমে ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ফান্ডে প্রকৃত মূল্যের বিষয়ে ট্রাস্টির সুপারিশপত্র জমা দিতে হবে। অনিবাসীদের লভ্যাংশ আয় কিংবা ইউনিট বিক্রির অর্থ তাদের আত্মীয় স্বজনদের (বাংলাদেশী নাগরিক) অনুকূলে হস্তান্তর করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজারের মাধ্যমে ইউনিটহোল্ডারদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করতে হবে। অবশ্য ইউনিট বিক্রির অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করলেই হবে। ব্যাংকে সেভিংস, ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা বিনিয়োগের পর অন্যতম ভরসার প্রতিষ্ঠান হলো মিউচুয়াল ফান্ড। অন্যদিকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে স্পন্সরদের জবাবদিহিতা বাড়াতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ ইউনিট ধারণ করার নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে। এর আগে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের আইন থাকলেও মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে এটি ছিল না। মেয়াদী-বেমেয়াদী দুই ধরনের মিউচুয়াল ফান্ডকেই আকর্ষণীয় করতে এমন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপির মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ লাভজনক বেশি। কিন্তু সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান কেন লাভজনক? কারণ, সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানের মাধ্যমে কোন মিউচুয়াল ফান্ডে নিয়মিত টাকা জমা দেয়া হয়। ফলে এ ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থায়ী সম্পদ তৈরি, বাড়ি নির্মাণ বা আপনার শিশুর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেক বেশি সহজ হয়। এসআইপির মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে হলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, তা হলো বিনিয়োগের সঠিক পরিমাণ আগে নির্দিষ্ট করতে হবে। এরপরের ধাপটি হলো একটি নির্দিষ্ট মিউচুয়াল ফান্ডের সুবিধাজনক স্কিমটি নির্বাচন করা। শুধু উপার্জন নয়, ভবিষ্যতে জীবন সুরক্ষিত করতে দরকার বিনিয়োগ এবং সঞ্চয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সব মিউচুয়াল ফান্ডের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিএসইসির নজর রাখে। এই তহবিলগুলোও স্বচ্ছ যেখানে এর মধ্যে; তাদের নিয়মিত বিরতিতে তাদের পারফরম্যান্স রিপোর্ট প্রকাশ করা দরকার হয় এই প্রতিবেদনগুলোতেও এই প্রকল্প সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত ফান্ডগুলোর সম্পদমূল্য প্রতি সপ্তাহেই প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে ভারতের মতো বাংলাদেশের কিছু কিছু মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগের তথ্যও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। শেয়ারবাজারে এখন ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। এই ফান্ডগুলোকে অনুমোদন দেয়ার সময়ই নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করা হয়। টাকা উত্তোলনের পরপরই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে ২০১০ সালের বাজার ধসের সময় অনুমোদন পাওয়া ফান্ডগুলোর নিট সম্পদ মূল্য কমে যায়। সম্পদ মূল্যের বিপরীতে লভ্যাংশ প্রদান করার কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে ফান্ডগুলো আগ্রহও হারাতে থাকে। যার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো যেন অপরিচিতই থেকে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশ সরকারও চায় বন্ডের মতো মিউচুয়াল ফান্ডকে শক্তিশালী করতে। স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনের অংশ হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ডকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, উন্নত বিশ্বে মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেখানে বাংলাদেশে ঘটেছে তার বিপরীত চিত্র। এর জন্য ফান্ড ম্যানেজাররা যেমন দায়ী তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ডকে গুরুত্ব কম দেয়া হয়েছিল। ফান্ডগুলোর বিনিয়োগও কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। আবার আইনের বাধ্যবাধকতায় নিম্নমানের আইপিওয়ের শেয়ার কিনতে ফান্ডগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে। শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে মিউচুয়াল ফান্ডকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।
×