ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যবিধি মেনে মোকাবিলা করতে হবে করোনা

প্রকাশিত: ১৮:২৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

স্বাস্থ্যবিধি মেনে মোকাবিলা করতে হবে করোনা

বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা। জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে অনেক দেশ। ভ্যাকসিন আবিষ্কার এখনো প্রায় অনিশ্চিত। তবু কি জীবন থেমে থাকে বা থাকবে। গবেষকরা বলছেন, করোনাকে সঙ্গী করেই মানুষের পথ চলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা নির্মূল হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। কিছু দেশ সময়মতো যথাযথ ও সময়োপযোগী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভাইরাসটির বিস্তার কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে তারা ফিরতে চেষ্টা করছে। ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, নেপাল তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া এক্ষেত্রে বেশ সফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকালীন এ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রতিদিন গণমাধ্যমে সংস্থাটির মহাপরিচালক বিশ্বের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা বিরতিহীনভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দিচ্ছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, যে সব দেশ এসব দিকনির্দেশনা গুরুত্বসহকারে অনুসরণ করেছে, সেসব দেশ করোনাভাইরাস সফলতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। যে সব দেশ প্রথমে গুরুত্ব দেয় নি, অবহেলা করেছে, সেসব দেশগুলো তার মাশুল গুণছে। যেসব দেশ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে ভিয়েতনামের নাম। সে দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি। এ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ২৩ জানুয়ারি। তখন থেকে ভিয়েতনাম সরকার স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক ত্বরিত সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। এ দেশের জনসংখ্যা ১০ কোটি। অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি খুব বেশি উন্নত নয়। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল চীনের সঙ্গে দূরত্ব মাত্র এক হাজার ৩০০ কিলোমিটার। চীনের সঙ্গে রয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। আড়াই লাখের বেশি মানুষের পিসিআর টেস্ট করেছে। আক্রান্তের রোগীর সংখ্যা পাঁচ শতের গণ্ডি পেরুয়নি। ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। স্বাস্থ্যবিধির পাশাপাশি জরুরি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সীমানা বন্ধ, বিমানবন্দরে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা জোরদার, কোয়ারেন্টাইনে থাকা এবং সংস্পর্শে আসা মানুষদের শনাক্তকরণ এর সফল বাস্তবায়ন। এদিকে বাংলাদেশেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট সন্তোষজনক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থা ততটা খারাপ নয়, বিশেষ করে করোনায় মৃত্যুহারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। করোনা সংক্রমিত শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ২৪.০৮.২০২০ তারিখে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫তম। এই দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র সৌদি আরবের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার কিছুটা বেশি। সৌদি আরবে মৃত্যুহার ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ আর বাংলাদেশে মৃত্যুহার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সুস্থতার হারেও বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে নেই। আক্রান্তদের মধ্যে ৬২ শতাংশের বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুহার বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। একইভাবে দেশটি সুস্থতার হারেও বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশ রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালির তুলনায় মৃত্যুহার বাংলাদেশে কম। করোনা সংক্রমণের বিষয় নিয়ে বিশ্বে খুব একটি গবেষণা না হলেও ভারতের একটি অঞ্চলে খুব সীমিত পরিসরে একটি বস্তি এলাকায় গবেষণা হয়। এতে দেখা যায়, বস্তি অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষতাও বেড়েছে। এ কারণে তাদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ কম হয়েছে। বাংলাদেশের বস্তি অঞ্চল, শ্রমিক ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষের মধ্যেও সংক্রমণ তুলনামূলক কম। তবে এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে, তাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, নাকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে তাদের করোনা সংক্রমণ হচ্ছেনা। এ বিষয়ে জানতে গবেষণার প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, শারীরিক পরিশ্রম কম করে, এমন মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও এ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের দাবীদার। আমাদের দেশে মৃত্যুহার কম, আবার সুস্থতার হারও বেশি। বাড়িতে অবস্থান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করেও অধিকাংশ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আবার হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যেও অধিকাংশ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। টেলিমেডিসিন সেবা অনেক বেশি সক্রিয় করা হয়েছে। ফোনের মাধ্যমে উপদেশ নিয়ে ওষুধ সেবনসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে আক্রান্তদের উল্লেখযোগ্য অংশ সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি ও সমাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সংক্রমণ রোধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে-এ লক্ষ্যে কাজ করছেন তিনি, দিচ্ছেন সঠিক নেতৃত্ব। একদিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ, অন্যদিকে জীবন-জীবিকা, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই বাস্তব কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করছেন তিনি। জীবন সবার আগে হলেও। লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে আসছে। আস্তে আস্তে কর্মক্ষেত্রে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসছে। অর্থনীতির চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে। সুস্থ জীবনে ফিরতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে আমাদের। শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব মেনে সবার চলাফেরা করতে হবে। এ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। মাংস ও ডিম অবশ্যই ভালোমতো সিদ্ধ করে খেতে হবে। হাঁচি ও কাশির সময় অবশ্যই হাত বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে এবং টিস্যু ফেলে দিতে হবে ও অবশ্যই হাত ধুতে হবে। ব্যবহার করা টিস্যু খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুতে হবে। কোনো প্রাণীর যত্ন নিলে বা স্পর্শ করলে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুতে হবে। রান্না ও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নিজে সুরক্ষিত না থেকে বা হাতে গ্লাভস না পরে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাঁচা মাংস, মাছ, সবজি, ফলমুল বাজার থেকে আনার পর ভালো করে ধুয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। অসুস্থ প্রাণীর মাংস একেবারেই খাওয়া যাবে না। কাঁচাবাজারে গিয়ে মাংস, মাছ বা সবজি হাতে ধরলে দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। অযথা মুখ-চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কর্মস্থলে কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিধেয় পোশাক অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুয়ে ফেলতে হবে। ভ্রমণের সময় যদি জ্বর-সর্দি অনুভূত হয়, তাহলে যে কোনো ভ্রমণ বাতিল করাই ভালো। পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে। করমর্দন ও কোলাকুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। একই মাস্ক বারবার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেখানে সেখানে থুথু ফেলা যাবে না। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে হবে এবং জীবাণুনাশক নিজের সঙ্গে রাখতে হবে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবারো ফিরে আসতে পারি আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। জীবন থেমে থাকবে না, তাই নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। সবাই সুস্থ থাকুক এই প্রত্যাশায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের করোনা মোকাবিলা করতেই হবে।
×