ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহিদুল আলম জয়

মন ভেঙ্গেছে মেসির...

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

মন ভেঙ্গেছে মেসির...

খুদে জাদুকর লিওনেল মেসির সঙ্গে বার্সিলোনার সম্পর্কটা আত্মিক। এইতো সেদিনও শত্রু-মিত্র সবাই একবাক্যে বলতেন, তাদের বন্ধন কোনদিন ছিন্ন হবে না! কিন্তু সময়ের অমোঘ নিয়মে কত কিছুই না পাল্টে যায়। ২০ বছরের মায়াজাল আচমকাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে। তাইতো মেসি ও বার্সিলোনার ‘বিচ্ছেদ’ এখন সময়ে ব্যাপার মনে হচ্ছে! এখন যে অবস্থা তাতে সব গুঞ্জন আর জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে চলেছে। কেননা দীর্ঘ ২০ বছর পর প্রাণের ক্লাব বার্সিলোনা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন মেসি। চুক্তির শর্ত, রিলিজ ক্লজ, বেতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক ঝামেলা থাকলেও আর্জেন্টাইন অধিনায়ক নতুন মৌসুম (২০২০-২১) শুরুর আগেই বার্সা ছাড়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবের প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষোভ থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী মহাতারকা। ক্লাবের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা তারকাকে হারাতে বসে ক্ষোভে ফুসে উঠেছেন বার্সা সমর্থকরা। দুঃখের খবরটি জানার পর থেকেই ন্যক্যাম্পের সামনে ক্লাব সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্টোমেউয়ের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করে চলেছেন ভক্ত-সমর্থকরা। তবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সহসাই স্পেন ছাড়তে বেশ বেগ পোহাতে হবে ছয়বারের ফিফা সেরা তারকাকে। এ জন্য মেটাতে হবে চুক্তি-রিলিজ ক্লজ-বেতনের ঝামেলা। অবশ্য ধারণা করা হচ্ছে, সব ঝামেলা চুকিয়ে সহসাই মেসি নূক্যাম্প থেকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেবেন। ইতোমধ্যে ক্ষুদে এই জাদুকরের সম্ভাব্য নতুন ঠিকানার সন্ধানও মিলতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার সিটি ও ফরাসী পরাশক্তি প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের (পিএসজি) কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। জানা গেছে, ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্ডিওলার সঙ্গে কথা বলেছেন বার্সা ডায়মন্ড। তারকা এই কোচের সঙ্গে বার্সাকে স্বর্ণযুগ উপহার দিয়েছিলেন মেসি। এছাড়া বার্সায় সাবেক সতীর্থ নেইমারের সঙ্গেও জুটি গড়ার কথা চাউর হয়েছে। ব্রাজিলিয়ান তারকা বর্তমানে পিএসজিতে খেলে থাকেন। যে কারণে প্যারিসে মেসি-নেইমার জুটি হওয়ারও জোর সম্ভাবনা আছে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মেসির ফুটবল সক্ষমতা উন্মচিত হয়। ওই সময় তাঁর হরমোনের ঘাটতি থাকলেও প্রতিভার কমতি ছিল না। এ জন্যই বার্সা অসুস্থ মেসিকে তাদের তাঁবুতে ভিড়িয়ে ধীরে ধীরে শাণিত করে তোলে। যার ফলশ্রুতিতে কৈশোর পেরুনোর আগেই কাতালানদের জার্সি গায়ে ক্লাব ফুটবলে অভিষেক ঘটে। প্রতিপক্ষ পোর্তোর বিরুদ্ধে ওই ম্যাচের দিন মেসির বয়স ছিল ১৬ বছরের সামান্য বেশি। স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসে সেটাই সবচেয়ে ক্ষুদে ফুটবলারের ম্যাচ খেলার ঘটনা। ২০০৪ সালের ওই অভিষেক মৌসুমেই মেসির ড্রিবলিং ভেল্কিতে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ে ফুটবল লা লীগা। এরপর আর কাল বিলম্ব না করে বার্সিলোনা ২০১৪ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টাইন লিটল ম্যারাডোনার সঙ্গে চুক্তি পাকাপোক্ত করে। অবশ্য বর্তমানে স্প্যনিশ ক্লাবটির সঙ্গে মেসির বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ২০২০-২১ মৌসুম পর্যন্ত। ২০০৪ সালে বার্সার মূল দলে অভিষেকের আগে ২০০১ সালে স্বদেশী ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ থেকে বার্সার যুব দলে নাম লেখান মেসি। এই হিসেবে ২০ বছর বার্সার তাঁবুতে থাকার পর ক্লাব ছাড়ছেন ২০১৪ বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার। চলতি বছরের শুরু থেকেই মেসির সঙ্গে বার্সিলোনার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। আর দিনকয়েক আগে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্য়োর্ন মিউনিখের কাছে ৮-২ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে বার্সার বিদায়ের পর মেসির ক্লাব ছাড়ার বিষয়টি আবারও সামনে চলে আসে। এই হারে ২০০৭ সালের পর প্রথমবারের মতো শিরোপাবিহীন মৌসুম শেষ করেছে বার্সা। মেসির সঙ্গে বার্সার চুক্তির মেয়াদ এখনও এক বছর বাকি আছে। তবে বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়ার সুযোগ আছে মেসির। সেক্ষেত্রে রিলিজ ক্লজও প্রযোজ্য হবে না। কারণ মেসি যেতে চাইলে তিনি ফ্রি এজেন্ট হিসেবে পরিগণিত হবেন। কিন্তু তিনি যেতে না চাইলে এবং বার্সা ছাড়তে না চাইলে তাকে কিনতে যে কোন ক্লাবকে রিলিজ ক্লজের ৭০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করতে হবে। যে কারণে মেসির বিদায়ে আইনি জটিজলতার বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। কারণ চুক্তিপত্র অনুযায়ী, গত ১০ জুনের মধ্যে মেসি তার ইচ্ছার কথা জানালে তিনি বিনা ফিতে ক্লাব ছাড়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু সেই সময় পেরিয়ে যাওয়ায় চুক্তিপত্রের ওই ধারা এখন আর কার্যকর নয় বলে বার্সা কর্মকর্তারা দাবি করছেন। অবশ্য মেসি ও তার আইনজীবী মনে করছেন, করোনাভাইরাস সঙ্কটে ফুটবল মৌসুম দেরি হওয়ায় ওই শর্তের কার্যকারিতাও ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়বে। রিলিজ ক্লজ যাই হোক না কেন, কিংবা বার্সিলোনা যতই দাবি করুক না কেন, মেসিকে নিতে কেমন মূল্য দিতে হবে সংশ্লিষ্ট ক্লাবকে এখন এই বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এক খবরে জানা জানানো হয়েছে, মেসির বর্তমান মূল্য ধরেছে ১১২ মিলিয়ন ইউরো বা ১১ কোটি ২০ লাখ ইউরো। যা নেইমারের দামের ঠিক অর্ধেক। উল্লেখ্য, বার্সিলোনার বর্তমান সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্টোমেউর অধীনে মেসির সর্বশেষ চুক্তিতে ‘রিলিজ ক্লজ’ (বার্সিলোনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন ক্লাব মেসিকে কিনতে চাইলে যে টাকা কাতালানদের দিতে হবে) ৭০ কোটি ইউরো। কিন্তু এত টাকা দিয়ে মেসিকে কেউ কিনবেনা এটা বলাই যায়। যে কারণে বোঝাপড়ার মাধ্যমে আর্জেন্টাইন তারকার বার্সা ছাড়ার বিকল্প নেই। অথচ একটা সময় মেসি বলতেন, ‘আমি তখনই ন্যূক্যাম্প ছাড়বো যখন বার্সিলোনা আমাকে ছুঁড়ে ফেলবে’। মেসি যে বার্সা ছাড়তে কতটা মরিয়া সেটা তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বার্সা কর্তারা এখনও দলের সেরা তারকাকে ধরে রাখতে আশাবাদী হলেও মেসি তাতে সায় দিচ্ছেন না। বরং দলবদল যেন নির্বিঘেœ হয় সেজন্য মেসি ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা বরাবর আবেদনও করেছেন। এর একটাই উদ্দেশ্য, কোন ঝামেলা ছাড়াই যেন দ্রুত বার্সা ছাড়ার বিষয়টা নিষ্পত্তি করা যায়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সেরা তারকাকে পেতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ক্লাব আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ইন্টার মিলান, পিএসজি। তবে ম্যানচেস্টার সিটি সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইতোমধ্যে মেসির সিটিজেন তাঁবুতে যাওয়ার সব আলামত মিলতে শুরু করেছে। ম্যানসিটি নাকি মেসিকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, মেসির জন্য ৫ বছর মেয়াদী চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে ম্যানসিটি। ইংলিশ জায়ান্টদের মালিকপক্ষ নাকি মেসিকে ৩ বছর ইতিহাদে রাখতে চান। বাকি ২ বছর তাদের মালিকানাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউইয়র্ক সিটি এফসিতে খেলাতে চান। মেসি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ জায়ান্টদের ঘরে যাবেন, এমন গুঞ্জন তার বার্সা ছাড়ার সিদ্ধান্তের পর থেকেই জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এরই মধ্যে নাকি সিটির বর্তমান ও সাবেক বার্সা কোচ পেপ গার্ডিওলার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাও হয়ে গেছে ৩৩ বছর বয়সী মেসির। বার্সিলোনায় দু’জনের পুরনো সম্পর্ক এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর গার্ডিওলাও নাকি মেসিকে কেন্দ্র করেই নবরূপে সিটির পরিকল্পনার ছক কষতে শুরু করেছেন। তবে শেষ খবর অনুযায়ী বার্সিলোনা থেকে মেসির চলে যাওয়াটা খুব সহজে হচ্ছে না। দিনকে দিন জটিলতা বেড়েই চলেছে। স্প্যানিশ লা লীগা কর্তৃপক্ষ বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে, ফ্রি ট্রান্সফারে এই মুহূর্তে ন্যূক্যাম্প ছাড়ার কোন সুযোগ নেই আর্জেন্টাইন অধিনায়কের। বার্সাও পুরো টাকা দাবি করে বসে আছে। যে কারণে দিনকে দিন জটিলতা আর নাটকীয়তা বেড়েই চলেছে। অথচ চুক্তির একটি ধারা সক্রিয় করে ফ্রি ট্রান্সফারে বার্সিলোনা ছাড়ার ইচ্ছার কথা জানান মেসি। এজন্য তিনি বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার দরবারেও আপিল করেছিলেন। এমন অবস্থায় লা লীগা জানিয়েছে, বার্সিলোনার সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করার শর্তটি এখনও কার্যকর আছে। তাই আগেভাগে তার দল ছাড়তে হলে অবশ্যই রিলিজ ক্লজের পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হবে। দু’পক্ষই তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় পুরো বিষয়টি ঘিরে জটিলতা আরও বেড়ে চলেছে। এর মাঝে স্পেনের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, হাসিমুখে বিদায় নিতে ক্লাবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন মেসি। কিন্তু বার্সার পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব নাকি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বার্সা বোর্ড জানিয়ে দিয়েছে, বিদায় নিয়ে কোনো কথা হবে না। কথা হবে নতুন চুক্তি নিয়ে। আর যেতে চাইলে পুরো ৭০০ মিলিয়ন ইউরো দিতে হবে। নতুন মৌসুম শুরুর আগে অনুশীলন শুরুর লক্ষ্যে গত রবিবার ছিল বার্সার খেলোয়াড়দেও কোভিড-১৯ পরীক্ষার দিন। করোনাভাইরাস পরীক্ষা করানোর জন্য ক্লাবের অনুশীলন মাঠে আসার কথা ছিল মেসির। কিন্তু আসেননি তিনি। এমনকি বার্সার অনুশীলনেও আসবেন না বলে জানা গেছে। এমন অবস্থায় আধুনিক ফুটবলের সেরা তারকাকে নিজ দেশে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন খাদ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ। রোজারিওর নিওয়লেস ওল্ড বয়েজ ক্লাব, যে ক্লাবে শৈশবের একটা অংশ কাটিয়েছেন মেসি, সেখানেই ক্যারিয়ার শেষ করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তুমি (মেসি) আমাদের সবার হৃদয়ে আছো এবং আমরা কখনও আমাদের দেশে (আসলে আর্জেন্টিনার ক্লাবে) তোমাকে খেলতে দেখিনি। তুমি যদি তোমার (শৈশবের) ক্লাব নিওয়লেস ওল্ড বয়েজে ক্যারিয়ার শেষ করো, তাহলে আমরা অনেক খুশি হব।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেসি যদি বার্সিলোনায় অবসর না নেয়, তাহলে সে মার্সেলো বিয়েলসার (আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান লিডস ইউনাইটেড কোচ) মতো নিওয়লেসে আসতে পারে।’
×