ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফায় উল্লম্ফন

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফায় উল্লম্ফন

রহিম শেখ ॥ করোনা ছোট-বড় প্রায় সবার ব্যবসায় ধস নামিয়ে দিয়েছে। আর্থিক লোকসানে কর্মী ছাঁটাই থেকে শুরু করে নিতে হয়েছে অনেক পরিকল্পনা। কিন্তু এই করোনা কারও কারও ব্যবসার জন্য যেন আশীর্বাদই হয়েছে। করোনার মধ্যেও কিছু বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানি ভাল ব্যবসা করেছে। বিশেষ করে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী, তামাক ও প্রসাধন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা কিছু কোম্পানির মুনাফায় বড় উল্লম্ফন হয়েছে। মুনাফার সঙ্গে কোম্পানিগুলোর সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে। তবে সিমেন্টসহ কিছু কোম্পানির আবার মুনাফাও কমেছে। এদিকে করোনার মধ্যেও বড় অঙ্কের বিদেশী বিনিয়োগ আসছে দেশে। এর মধ্যে চলতি মাসেই চীনের ইয়াবাং গ্রুপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমিতে শিল্প স্থাপনের জন্য ইজারা চুক্তি করেছে। এই জমিতে ৩ শ’ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চীনের ইয়াবাং গ্রুপ। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০টি চীনা কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে উন্নয়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে করোনায় সংক্রমিত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চের প্রথমার্ধে। করোনায় প্রথম রোগী মারা যান ওই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। এরপর সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এতে জরুরী পণ্য ও সেবার বাইরে প্রায় সব ধরনের ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ কারণে এপ্রিল ও মে এই দুই মাস ছিল ব্যবসার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। কিন্তু তারপরও এই খারাপ সময়ে ভাল ব্যবসা করেছে কিছু বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পানি। জুনের শুরু থেকে ধীরে ধীরে ব্যবসা স্বাভাবিক হতে শুরু করায় মুনাফায় ভাল উল্লম্ফন দেখা গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দেয়া তথ্য মতে, করোনা মহামারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা বাড়ার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৫৭ টাকা ৫১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৭ টাকা ২৮ পয়সা। ওষুধ ও রসায়ন খাতের অপর বহুজাতিক কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনও মুনাফার দিক থেকে পিছিয়ে নেই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৬ টাকা ৩৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২২ টাকা ২৫ পয়সা। মুনাফায় বড় উল্লম্ফন হয়েছে আরও এক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশের। এপ্রিল-মার্চ আর্থিক হিসাববছর নির্ধারণ করা কোম্পানিটি চলতি বছরের এপ্রিল-জুনের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩১ টাকা ৬৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৬ টাকা ৯৫ পয়সা। করোনায় ভাল ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যারিকো বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ গোপাল বলেন, ‘করোনার এ সময়ে মানুষের আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মূলে ছিল সদস্যদের প্রতিভা ও মেধার দৃঢ়তা। মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা নতুন কিছু পণ্য বাজারে এনেছি। মানুষ আমাদের সেসব পণ্যে আস্থা রেখেছে, যা আমাদের ব্যবসায় সহায়তা করেছে।’ চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে লাফার্জহোলসিমের সিমেন্ট বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ শতাংশ কমে গেছে। টাকার অঙ্কে বিক্রি কমেছে ১৮৬ কোটি টাকার। এতে তিন মাসে কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে প্রায় ১২ কোটি টাকা বা ২৭ শতাংশ। জানতে চাইলে সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘করোনার কারণে এপ্রিল-জুন এ সময়কালে দেশী-বিদেশী সব সিমেন্ট কোম্পানির বিক্রি গড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে।’ একই সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ বিবেচনায় শেয়ারবাজারে শীর্ষ তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিদেশীদের শেয়ার ধারণের হারে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ছায়েদুর রহমান বলেন, শীর্ষ কোম্পানিতে গত কয়েক মাসে বিদেশী বিনিয়োগ খুব একটা কমেনি। প্রকৃতপক্ষে বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির বড় অংশই হয়েছে গত বছরে। সম্ভাবনা রয়েছে বলেই বিদেশীরা এখনও এসব কোম্পানির শেয়ার ধরে রেখেছেন। তাছাড়া কোভিডের কারণে পুঁজিবাজারের যে প্রভাব সেটি কিন্তু কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে পুঁজিবাজার আরও ভাল হবে। সে সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে বলে আমি মনে করি। এদিকে করোনকালীন সময়ে মুনাফা কমলেও নতুন পণ্য এনেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। তারা কাজ করেছে তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার এবং সাময়িক কর্মহীন হয়ে পড়া পেইন্টারদের জন্য। এ বিষয়ে বার্জারের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক মহসিন হাবিব চৌধুরী বলেন, করোনার প্রভাবে তাদের ১৭ হাজার ৫০০ পেইন্টার কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের এককালীন দুই কোটি টাকার মতো নগদ সুবিধা দিয়েছে বার্জার। চ্যানেল পার্টনারদের (যাদের প্রয়োজন) সুরক্ষা পণ্যসহ বীমা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। নতুন পণ্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার মি. এক্সপার্ট উৎপাদন করলেও বাজারজাত না করে ব্যবসায়ী অংশীদারদের মধ্যে বিনা মূল্যে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মহসিন হাবিব বলেন, দেশের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্যানিটাইজেশন সেবা নিয়ে এসেছে বার্জার। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কক্সবাজারকে এই সেবার আওতায় আনা হয়েছে। এই সেবা দেয়া হয় অফিস, কারখানা ও আবাসিকে। এজন্য বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়েছে বার্জারকে। এছাড়া কর্মহীন হয়ে পড়া কর্মীদের এ খাতে কর্মসংস্থানও করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে হাইটাচ পয়েন্ট যেমন হাসপাতাল, বিমানবন্দর ও লিফট এসব জায়গায় জীবাণু প্রতিরোধক পেইন্টের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। করোনার মধ্যেও আসছে বিদেশী বিনিয়োগ ॥ চলতি মাসের শুরুতেই চীনের ইয়াবাং গ্রুপ এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমিতে শিল্প স্থাপনের জন্য ইজারা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই জমিতে ৩শ’ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চীনের ইয়াবাং গ্রুপ। এতে বার্ষিক রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া বার্ষিক অভ্যন্তরীণ বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৭ দশমিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে স্থাপিত শিল্পে ২ হাজার ২শ’ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে। ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড একটি চীনা সংস্থা যা মূলত চীনের ইয়াবাং গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তারা ডাইং ও পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপটি জিয়াংসু স্টক এক্সচেঞ্জের একটি তালিকাভুক্ত সংস্থা। ডাই ও রং ছাড়াও পিগমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস, ভেটেরিনারি ওষুধ, কীটনাশক, ফটোভোলটাইকস, মাইনিং, লজিস্টিক্স, ফিনান্স এবং রিয়েল এস্টেটের সেক্টরে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। ইয়াবাং গ্রুপের বার্ষিক পরিচালন আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে টেক্সটাইল ও অন্যান্য রাসায়নিক শিল্প স্থাপনের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দিয়েছে। জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের এ প্রাদুর্ভাবেও বেজা বিভিন্নভাবে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে এবং উন্নয়ন কার্যক্রম কোথাও থেমে নেই।’ চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আনতে চায় চায়না হারবার ॥ বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য যে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানে উন্নয়নকারী হিসেবে কাজ করছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। চায়না হারবার বেজাকে এক চিঠিতে সম্প্রতি বলেছে, তারা চীন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তাদের মূল প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাজি থাকলে তারা চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের যৌথ অংশীদারত্ব চুক্তি করতে চায়। সিসিসিসি বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফরচুন-এ বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির একটি। ২০১৯ সালের তালিকায় এটি ছিল ৯৩তম। তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান চায়না হারবার বলছে, চুক্তি হলে তারা ১০ কোটি মার্কিন ডলারের মূলধন নিয়ে আসবে। চিঠিতে চায়না হারবার দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ৬০টি চীনা প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে যে জমি লাগবে, তা চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মোট জমির ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে বিনিয়োগ আসবে ২৮ কোটি মার্কিন ডলার। তারা আশা করে, চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে তারা ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারবে। এতে কাজ পাবে ৬০ থেকে ৯০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে চীনা বিনিয়োগ বেশি আসছে। সনি, টয়োটার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের বিনিয়োগ আনতে চেষ্টা করছে সরকার ॥ সনি, টয়োটার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড যাতে বাংলাদেশে আসে সেই অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে জাপান দূতাবাস, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) এবং জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বিনিয়োগ বাড়াতে জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। দেশে জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। যদিও তাতে বেশ কিছু সেবা যুক্ত করা এখনো বাকি।
×